ভারত সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সাথে দু’টি দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা/প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত ভূদৃশ্যকে নতুন আঙ্গিকে সংজ্ঞায়িত করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ১০ বছরের নিরাপত্তা ফ্রেমওয়ার্ক এবং ইসরাইলের সাথে সমান মেয়াদের প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা চুক্তি ভারতের বহুপক্ষীয় কৌশল ও আত্মনির্ভরতা অর্জনের নতুন কৌশল হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। ইসরাইলের সাথে ভারতের সম্পর্কের ধারাবাহিকতা অবিচ্ছেদ্যভাবে চললেও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের বিষয়টি সেরকম নয়।
ভারত ব্রিকসের সদস্য এবং অন্য প্রধান সদস্য রাশিয়া ও চীনের সাথে এর একটি কৌশলগত সমীকরণ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের বিষয় যখন আসবে তখন ব্রিকস দেশগুলো বিশেষত রাশিয়া চীনের সাথে সম্পর্কের সমীকরণও চলে আসবে। এ কারণে ভারতীয় মিডিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নিরাপত্তা চুক্তিকে যতটা গভীর বিষয় বলে তুলে ধরতে চাইছে ততটা আতঙ্ক প্রতিপক্ষ দেশ বিশেষত পাকিস্তানে দেখা যাচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের ১০ বছরের ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তিতে অস্ত্র হস্তান্তর বা যৌথ মিশন সমন্বয় করার পাশাপাশি এটি ইন্টার-অপারেবিলিটি, সাইবার নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা তথ্য শেয়ারিং পর্যন্ত বিস্তৃত। এতে ভারতীয় সামরিক বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রীয় সিস্টেমের সাথে সমন্বয় বাড়াতে পারবে, যা সীমান্তে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং মহাসাগরীয় অঞ্চলে শক্তি প্রদর্শনে গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা দিতে পারে।
অন্যদিকে ইসরাইলের সাথে চুক্তি প্রযুক্তি ও কৌশলগত ক্ষেত্রে দেশটিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে। ড্রোন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আইএসআর (ইন্টেলিজেন্স, সার্ভেইল্যান্স, রিকনাইসান্স) এবং মিসাইল-নেভিগেশনের ক্ষেত্রে যৌথ গবেষণা ও উৎপাদন ভারতকে অত্যাধুনিক সামরিক সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করবে।
এই দুই চুক্তির সমন্বয় ভারতের বহুপক্ষীয় কৌশল দৃঢ় করবে বলে দিল্লির নীতিপ্রণেতারা মনে করছেন। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় চীন ও পাকিস্তানের প্রতি ভারসাম্য রক্ষায় কতটা সাহায্য করবে সে প্রশ্নও রয়েছে। ইসরাইলের সাথে চুক্তি ভারতকে প্রযুক্তিগত অগ্রসরতা বজায় রাখার সুযোগ দিলেও ভারতকে সবকিছু করতে হবে রাশিয়ার সাথে পারস্পরিক অস্ত্র ও প্রযুক্তি সম্পর্কের সূ² ভারসাম্য রক্ষা করে। অন্যথায় এক ধরনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দিল্লির জন্য থাকবে।
বাংলাদেশসহ আঞ্চলিক ছোট দেশগুলোর জন্য এই চুক্তির তাৎপর্য কী সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। এটি দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আনছে নাকি এটি ভারতের তাৎক্ষণিক ট্যারিফ ও রাজনৈতিক চাপ মোকাবেলার মাধ্যমে বিজেপি সরকারের বিপদ ঠেকানোর জন্য আমেরিকান প্রতিরক্ষা সামগ্রী কেনাকাটার ব্যবস্থা সেটি পর্যবেক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এর আগে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে কৌশলগত ভারসাম্যের দোহাই দিয়ে নয়াদিল্লির আমেরিকার প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ফ্রেমওয়ার্ক থেকে এক রকম বেরিয়ে আসা- বিশেষত মস্কো থেকে এস-৪০০ কেনা এবং সস্তার জ্বালানি তেল কিনে অর্থনীতি মোটাতাজা করার কৌশলকে পেন্টাগন ভালোভাবে নেয়নি। এরপর বাইডেন জমানা এক প্রকার পার করে দিতে পারলেও ট্রাম্প প্রশাসনকে সেভাবে পার করতে পারেনি মোদি সরকার। একের পর এক ট্যারিফ নিষেধাজ্ঞা, ভারতীয় অভিবাসীদের ওপর অভিযান ও কার্গো বিমানে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো আর সেই সাথে নির্বাচনে জাল-জালিয়াতি করে ক্ষমতায় আসার বিষয় প্রকাশ করে দেয়া মোদির জন্য বিব্রতকর অবস্থা সৃষ্টি করে। এছাড়া পাকিস্তানকে শায়েস্তা করার অভিযানে ভারতের আটটি জঙ্গিবিমান হারানো এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধ বন্ধে বাধ্য হওয়ার মতো অনেক অস্বস্তিকর বিষয় রয়েছে দিল্লির জন্য।
এসবের পর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমঝোতার জন্য রাশিয়ান তেল কেনা কমানো এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ১০ বছরের নিরাপত্তা চুক্তি করার নানা তাৎপর্য রয়েছে। তবে এটি দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে কোনো নিয়ন্ত্রক বিশেষ সুবিধা দেবে কিনা নিশ্চিত নয়। বুশ বাইডেনের সময় দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে মোড়ল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সাথে এবারের সমঝোতা বেশ আলাদা। অনেক বিশ্লেষকই বলছেন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ভারতের সতর্ক নীতি গ্রহণ অপরিহার্য।
কারা কিভাবে দেখছে
পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ : পাকিস্তান ‘ভারত-যুক্তরাষ্ট্র’ নিরাপত্তা সংযোগকে সাধারণভাবে তার বিরুদ্ধে বলেই দেখে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের প্রতিরক্ষা, উপকূলীয় নিরাপত্তা, প্রযুক্তি চুক্তি বাড়িয়ে নেয়া পাকিস্তানে নিরাপত্তা-ঝুঁকি হিসেবে ধরা হয়। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা উদ্বেগ ভারত-সংশ্লিষ্ট। সে হিসেবে, পাকিস্তানে হয়তো যুক্তরাষ্ট্র-ভারতীয় ফ্রেমওয়ার্ককে ভারসাম্যহীন বলা হবে, কারণ সেটা ভারতের সক্ষমতা ও প্রভাব বাড়াবে এবং পাকিস্তানের হাত সঙ্কুচিত করতে পারে।
পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রকে তার ঐতিহ্যবাহী সামরিক অংশীদার হিসেবে দেখত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখন ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা-প্রযুক্তি, গোয়েন্দা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোট জোরদার করায় ইসলামাবাদ মনে করছে, এই ফ্রেমওয়ার্ক দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্য ভারতমুখী করে দিচ্ছে, যা কাশ্মির ইস্যু ও আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাকিস্তানের অবস্থান দুর্বল করে।
এর জবাবে পাকিস্তান চীনের সাথে সামরিক সহযোগিতা আরো গভীর করতে পারে। মার্কিন-ভারত ঘনিষ্ঠতা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও ক‚টনৈতিক বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। ইসলামাবাদের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘ভারত-মার্কিন নিরাপত্তা সমন্বয় দক্ষিণ এশীয় ভারসাম্যকে নত করে, পাকিস্তানকে চীনের সাথে আরো খোলামেলাভাবে জোটবদ্ধ হতে বাধ্য করে।’
চীনের দৃষ্টিকোণ : চীন স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতা ‘তৃতীয় পক্ষকে নিশানা করে নয়’ এমন হওয়া উচিত। অর্থাৎ ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের একরোখা প্রতিরক্ষা চুক্তি চীন বা তার স্বার্থকে প্রভাবিত করতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সংযোগ দক্ষিণ এশিয়া-ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় চীনের ভূমিকা ও প্রভাব সঙ্কুচিত করে দিতে পারে। তাই চীন এটিকে ‘চীন নিয়ন্ত্রণ বা চীনের প্রভাব প্রতিরোধ’ হিসেবে দেখছে।
চীন এটিকে কোয়াড-এর সামরিক শাখা হিসেবে দেখে, যা দক্ষিণ চীন সাগর থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত চীনের সামুদ্রিক বাণিজ্য রুটকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের মধ্যে এন্টি-চায়না স্ট্র্যাটেজিক চিন্তা উৎসাহ দিচ্ছে এমন ধারণা বেইজিংয়ের ক‚টনীতিকদের মধ্যে স্পষ্ট।
প্রতিকৌশল হিসেবে চীন পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কা প্রতিরক্ষা বিনিয়োগ বাড়াতে পারে। চীনের পিএলএ নেভি ভারত মহাসাগরে গোয়াদর, হাম্বানতোতায় স্থায়ী উপস্থিতি বাড়িয়েছে। বেইজিং এখন ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে ‘আঞ্চলিক মেরুকরণ ত্বরান্বিতকারী’ বলছে, যা সঙ্ঘাতের সম্ভাবনা বাড়াবে।
চীনের গ্লোবাল টাইমস মন্তব্য করেছে : ‘চীনের বিরুদ্ধে পূর্ব দিকে তার কৌশলগত সীমান্ত সম্প্রসারণের জন্য ওয়াশিংটন ভারতকে ব্যবহার করছে। কিন্তু ভারত খেলোয়াড় হওয়ার পরিবর্তে কেবল একটি ঘুঁটি হয়ে ওঠার ঝুঁকিতে রয়েছে।’
রাশিয়ার দৃষ্টিকোণ : রাশিয়া ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সাথেই সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। ভারত-রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা অংশীদার, তবে রাশিয়া একরোখা নিরাপত্তা ব্লকের প্রতি একটু সতর্ক ভাবাপন্ন। রাশিয়ার জন্য, ‘মাল্টিপোলার বিশ্ব’ বা ‘একাধিক শক্তি কেন্দ্রের বিশ্বব্যবস্থা’ হওয়া গুরুত্বপূর্ণ; এই দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের এমন যৌথ চুক্তি রাশিয়ার জন্য বিষয়বস্তু হিসেবে অনাহূত। তবে রাশিয়া ভারতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করছে না। ভারতে রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রয়েছে।
রাশিয়ার বিশ্লেষকদের মতে, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের অংশীদারত্ব মস্কোর বহুমেরু বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিকে দুর্বল করে দেয়।’ তবে তারা মনে করেন, ভারতের ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ বজায় থাকলে রাশিয়া-ভারত সম্পর্ক টিকে যাবে।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা ফ্রেমওয়ার্ক কেবল একটি দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা চুক্তি নয়, এটি হতে পারে নতুন ভূরাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু। পাকিস্তানের জন্য এটি নিরাপত্তা-আশঙ্কা, চীনের জন্য কৌশলগত অবরোধ, রাশিয়ার জন্য প্রভাব হারানোর সঙ্কেত। এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়া এখন এক ‘তিনমুখী ভারসাম্যের রাজনীতিতে’ প্রবেশের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে- ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ, চীন-পাকিস্তান জোট, আর রাশিয়াকেন্দ্রিক এক ‘সমঝোতাপূর্ণ মধ্যপথ’।
বাংলাদেশের জন্য কী বার্তা
২০২৪-২৫ পর্বে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত পরিবেশ বদলে দিতে পারে; এটি প্রধানত ইন্দো-প্যাসিফিক সার্কেলে চীনা প্রভাব সীমাবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হচ্ছে। একই সময়ে বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে ভারতনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে বহুমুখী কৌশলে যেতে শুরু করেছে। এর প্রেক্ষিতে ঢাকা-দিল্লির ক্রমশ দূরত্ব দেখা যাচ্ছে। অর্থনৈতিক এবং ক‚টনৈতিক সরঞ্জামে এ সময়কালেই বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্ক পুনরায় জোর পেয়েছে, যা কৌশলগত অপশন বাড়ায় কিন্তু একই সাথে দিল্লির উদ্বেগও বৃদ্ধি করে।
ভারতের সাথে তাৎক্ষণিক ক‚টনৈতিক টানাপড়েন বেড়ে গেলে বাংলাদেশের জন্য বাণিজ্য ও স্থল-প্রবাহে বাধা পড়ার ঝুঁকি আছে। সামরিক ব্লকচিত্রে আটকে পড়া স্বল্পকালীন স্বাধীনতা শেষ করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়া আরো দ্বিধাবিভক্ত হতে পারে; বাংলাদেশের সামনে বাছাই করার চাপ বাড়বে। আবার এতে বৈচিত্র্যপূর্ণ জিওইকোনমিক সুযোগ আসতে পারে। মার্কিন বিনিয়োগ, উচ্চ-মান প্রযুক্তি ও বাজার-অ্যাক্সেস বাড়ানো সম্ভব।
বাংলাদেশের জন্য কৌশলগত বিকল্পের মধ্যে অপশন এ হতে পারে- স্বাধীন, বহুমুখী কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন রক্ষা করা। সব বড় অংশীদারের সাথে একই সময়ে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখা। চীন (অবকাঠামো, এনার্জি), ভারত (পরিবহন, সীমান্ত), যুক্তরাষ্ট্র (বাণিজ্য, প্রযুক্তি) ও রাশিয়া/পাকিস্তান (নানাভাবে ক‚টনৈতিক)। এর পাশাপাশি কাস্টোমাইজড চুক্তি- প্রতিরক্ষা-প্রশিক্ষণ/ব্যবহারিক সহযোগিতা সীমিত রাখা এবং ভারী সামরিক চুক্তি এড়িয়ে চলা।
অপশন বি হলো, অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে সিকিউরিটিতে লো প্রোফাইল বজায় রাখা। বিদেশনীতি-ফ্রেমে ‘অস্ত্রহীন’ কৌশল- অর্থনৈতিক অংশীদারত্বকে অগ্রাধিকার দিয়ে সামরিক জোট এড়ানো। বিদেশী বিনিয়োগের জন্য পরিষ্কার নীতিমালা, বাণিজ্য চুক্তি ও বাজার সুরক্ষা।
অপশন সি হলো, দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র-সামরিক সমন্বয় ও মধ্যস্থতা নীতি রক্ষা করা। বিমসটেক, সার্ক, অন্যান্য মধ্যপন্থী ফোরামে সক্রিয় মধ্যস্থতার ভূমিকা নেয়া।
ঝুঁকি-সম্ভাবনার মধ্যে রয়েছে, ভারতের কাছ থেকে বাণিজ্য/ভিসা/সীমান্ত-নিষেধ দ্রুত করা হলে- তা কূটনৈতিক সঙ্কটের সূচক হতে পারে। ভবিষ্যতে ভারত-মার্কিন সামরিক একীকরণ আরো দৃঢ় হলে দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক-মেরুকরণ তীব্র হবে।
তবে, শেষ কথা হলো- বাংলাদেশ এখন এক জটিল সন্ধিক্ষণে এসে উপনীত হয়েছে। বলা যেতে পারে পাকিস্তান জুনিয়র জর্জ বুশের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সময় যে অবস্থায় পড়েছিল অনেকটা সে রকম। নিরাপত্তা বিশ্লেষক আবু রুশদের ভাষায়- টাইরানি অব জিওগ্রাফি ও বাস্তবতার মরণফাঁদ।
তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা কাঠামো এতটাই দুর্বল যে, ইউরেনিয়াম থাকলেও তা তোলা বা ব্যবহারের স্বপ্ন কেবল কল্পনা। রাষ্ট্রটি ৫৪ বছরেও নিজস্ব নিরাপত্তা সক্ষমতা তৈরি করতে পারেনি। দেশটিতে এক অদৃশ্য পঞ্চম বাহিনী আছে- যারা রাষ্ট্রের ভেতর থেকেই রাষ্ট্রকে দুর্বল করে। এই বাহিনী ভবিষ্যতেও থাকবে। এটা আমাদের জাতিগত নিয়তি বললে ভুল হবে না। চীনা মডেল এখানে চলবে না, কারণ মানুষ গণতন্ত্র চায়। আবার গণতন্ত্রও কার্যকর নয়, যখন রাষ্ট্রের ভেতরে ভাঙন ও আস্থাহীনতা চরম।
এই অবস্থায়, কোনো বৃহৎ শক্তির সাথে সামরিক ও কৌশলগত জোট ছাড়া বাংলাদেশের টিকে থাকা কঠিন। ‘সম্পূর্ণ সার্বভৌমত্ব’-এই ধারণা বাস্তব নয়। ১৯৭১-এর পর থেকে বাংলাদেশ কখনোই পূর্ণ সার্বভৌম ছিল না। আমাদের একমাত্র বিক্রয়যোগ্য সম্পদ আমাদের ভূ-কৌশলগত অবস্থান-সিঙ্গাপুরের মতোই আমরা সেটি বিক্রি করতে পারি। গার্মেন্টস ও রেমিট্যান্স দিয়ে এই বাস্তবতার জট খোলা যাবে না।
দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতা ভয়ঙ্কর জটিল, আর বাংলাদেশের জন্য তা আরো কঠিন। ভূগোল আমাদের শত্রু, তবু সেই ভূগোলই আমাদের কৌশলগত অস্ত্র। বঙ্গোপসাগর একটি চোকিং পয়েন্ট, যেখানে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। এই খেলায় একা বাংলাদেশ সুবিধা করতে পারবে না। আমরা নিজেরাই আমাদের ভঙ্গুরতা প্রমাণ করেছি- যেখানে কখনো জাতীয় ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি, আর বিশাল পঞ্চম বাহিনী ভেতর থেকে সব ভেঙে দিয়েছে।
বাস্তবতার মরণফাঁদে বাংলাদেশ আটকে গেছে। জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি, শিক্ষা- সব ক্ষেত্রে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। নিজ সম্পদ দিয়ে বিশাল সশস্ত্র বাহিনী চালানোও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, আর ‘পিপলস আর্মি’ কনসেপ্ট কেবল ইউটোপিয়া। অতএব, যত দ্রুত সম্ভব আঞ্চলিক নিরাপত্তা চুক্তি ও কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করাই হতে পারে একমাত্র কার্যকর সমাধান।
ইন্দো-মার্কিন ফ্রেমওয়ার্কের বৃদ্ধির মধ্যেই বাংলাদেশের সবচেয়ে উপযুক্ত পথ হবে ‘স্বাধীনতা বজায় রেখে বহুমুখী কৌশল’ অর্থাৎ কেবল একপাশে ঝোঁকা নয়, বরং বাণিজ্য ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় ক্ষমতা বাড়ানো, কূটনৈতিক যোগাযোগের চ্যানেল জোরদার করা এবং সামরিক জটিলতা এড়িয়ে চলা। এই উপায়ে ঢাকা নিজেদের প্রয়োজনমতো দামের বিনিময়ে সমঝোতায় যেতে পারবে, অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক নিরাপত্তাও বজায় থাকবে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক নয়া দিগন্ত



