নতুন দলের প্রতি শুভ কামনা

নতুন দলটি যথার্থ মধ্যপন্থী হয়ে উঠলে তাদের সাফল্য আশা করা যায়। এ জন্য প্রথম থেকেই চেষ্টা করা দরকার। হঠাৎ মধ্যপন্থী হওয়া যায় না। সংবিধান গঠনতন্ত্র কর্মকৌশল, সাংগঠনিক কাঠামো, ঘোষণাপত্র ইত্যাদি চূড়ান্ত করতে হবে। মধ্যপন্থা অনুসরণে তা করতে হবে। তবেই এটিকে একটি কার্যকর দল বলা যাবে।

‘গণতন্ত্রে জনগণই প্রধান’এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর পরই আসে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলের কথা। আরও একটি রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করেছে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ নামে। এর আহ্বায়ক হয়েছেন পদত্যাগী তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। সবার চোখ ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে অপর উপদেষ্টা সজীব ভূঁইয়া বা আসিফ মাহমুদের উপর। নাহিদ ইসলাম তথ্য মন্ত্রণালয় পেলেও সজীব ভূঁঁইয়া পেয়েছিলেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। তিনি নতুন দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে থাকেন কি না এ দিকে সবার চোখ ছিল। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস সম্পর্কে কী বলেন, সে দিকেও সবার নজর ছিল। তারা বিএনপির সমালোচনা করেন কি না, এটিও ছিল লক্ষণীয় বিষয়। তারা এ অনুষ্ঠান সম্পর্কে তেমন কিছু বলেননি। নাহিদ ইসলাম উপস্থিত থাকলেও সজীব ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন না। জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দল তাদেরকে স্বাগত জানিয়েছে। আমরাও তাদের কর্মকাণ্ড দেখার অপেক্ষায়। তাদের মধ্যে যুব শ্রেণীই প্রধান; বয়স্ক লোক কম। আমরা তবুও তাদের সাগত জানাই, শুভ কামনা করি।

জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন। এটি আত্মপ্রকাশ করে ৭ মার্চের এক সপ্তাহ আগে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউতে। ওদের ছাত্র শাখার নাম ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’। এই দলের ভাবাদর্শ হচ্ছে ‘বহুত্ববাদ’ ‘মধ্যপন্থী’ রাজনৈতিক অবস্থান এবং সেøাগান হচ্ছে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। তাদের সদস্যপদ আনুমানিক ১০ হাজার।

৫ আগস্ট ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে বিগত সরকারের পতনের পর একটি নতুন রাজনৈতিক দলের গুঞ্জন ওঠে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা ঘোষণায় একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা উল্লেখ ছিল। এর পর সেপ্টেম্বর ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ গঠিত হয়। গত ডিসেম্বরে জানা যায়, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে নতুন দল গঠন করা হবে এবং সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি থানায় কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। ফেব্রুয়ারিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসে এবং ২৩-২৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়।

শুরু থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে দলটির জন্য নানা নাম পাওয়া গেলেও ২৭ ফেব্রুয়ারি দলটির চূড়ান্ত নাম হিসেবে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ প্রকাশ করা হয়। তবে বর্তমানে দলটির কোনো নির্দিষ্ট প্রতীক এখনো বাছাই করা হয়নি। ২ মার্চ দলটির পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটির ২১৭ সদস্যের নাম প্রকাশ করা হয়। কমিটিতে বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ রাখা হয়েছে। কমিটির সদস্য তালিকায় আহ্বায়ক হিসেবে নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব হিসেবে আখতার হোসেন ছাড়াও আরো আছেন সামান্তা শারমিন ও আরিফুল ইসলাম আদিব; যারা জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করবেন। ডা: তাসনিম জারা ও নাহিদা সরোয়ার নিভা আছেন জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব হিসেবে। সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ আছেন যথাক্রমে উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠকের দায়িত্বে। এ ছাড়া মুখ্য সমন্বয়কারী হিসেবে নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী ও জ্যেষ্ঠ মুখ্য সমন্বয়কারী হিসেবে আব্দুল হান্নান মাসউদ আছেন কমিটিতে।

আত্মপ্রকাশে এনসিপি নিজেদের মধ্যপন্থার দল বলে দাবি করেছে। দল ঘোষণার সময় বলা হয়েছে, সবার মতকে প্রাধান্য দিয়ে মধ্যপন্থার ভিত্তিতে দলের কার্যক্রম চলবে। ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ও ‘গণপরিষদ নির্বাচন, ‘সংবিধান পরিবর্তন’সহ অনেক বিষয়ই এসেছে দলের আত্মপ্রকাশের সময়। তবে দলের গঠনতন্ত্র, ঘোষণাপত্র, সাংগঠনিক কাঠামো বা কর্মকৌশল কোনোটিই এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। নতুন দলকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ প্রায় সব ক’টি রাজনৈতিক দল স্বাগত জানিয়েছে। পাশাপাশি তারা দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট নয় বলেও সমালোচনা করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, দলটিতে ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ থেকে আসা নেতাদের একত্রে এনে মধ্যপন্থার লক্ষ্য নিয়ে কিভাবে সামনে যাবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, নতুন দলের ঘোষণার মধ্যে এখনো দলটির কর্মপন্থা বা কৌশল কিছুই পাওয়া যায়নি। তারা একটি ধারণা দিয়েছে। তাই তাদের গঠনতন্ত্র ও কর্মপদ্ধতির চূড়ান্ত ঘোষণা না আসা পর্যন্ত এই দলের নীতি-আদর্শের বিষয়টি বোঝা যাবে না।

‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র) প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা এই দলের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। তারা বলেছে, সেকেন্ড রিপাবলিকে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলা ও গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে তাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন দলের সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ থেকে আসা নেতাদের একমতের পক্ষে এনে সামনে এগিয়ে যাওয়া। বিশ্লেষকদের মতে, দু-একটি বিশেষ আদর্শের দল ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রায় সব ক’টি দলই মধ্যপন্থার কথা সরাসরি না বললেও তাদের রাজনৈতিক দর্শন একই ধরনের। সেখানে নতুন এই দলটি মধ্যপন্থার রাজনীতির কথা বলে কতটা চমক দেখাতে পারবে তা নিয়ে সবারই আগ্রহ আছে।

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বলেন, ‘আমরা মধ্যপন্থা বলতে বিভাজনের রাজনীতির অবসান হওয়ার কথা বলছি। যেখানে কেউ কাউকে বাদ দিতে পারবে না। তবে জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো এ মুহূর্তে আমরা দলীয় ক্ষেত্রে বিবেচনা করছি না।’ হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমরা কিছুটা সময় নেবো কমিটিগুলো গঠন করতে। এর কারণ, আমরা চাই না বিতর্কিত কেউ কমিটিতে আসুক। তাই সব কিছু যাচাই-বাছাই করেই কমিটি ঘোষণা করব।’ আগামী নির্বাচনে তারা ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবেও বলে জানায়।

নতুন দলটি মধ্যপন্থা কতটুকু অবলম্বন করতে পারে এটি হচ্ছে বড় কথা। আমরা আশা করব, দলটি আসলেই মধ্যপন্থী হবে। আমরা সে দিনের অপেক্ষায় আছি। বাংলাদেশে একটি নতুন দলে শুধু তরুণদের সম্পৃক্ত করলেই চলবে না, সব বয়সী মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ দেশে নতুন দলের চলা খুব কঠিন। এর পরও চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। মধ্যপন্থী দল হিসেবে চলাটা কঠিন। তবু উপায় নেই, ওই পথই গ্রহণ করতে হবে। নতুন দলটি যথার্থ মধ্যপন্থী হয়ে উঠলে তাদের সাফল্য আশা করা যায়। এ জন্য প্রথম থেকেই চেষ্টা করা দরকার। হঠাৎ মধ্যপন্থী হওয়া যায় না। সংবিধান গঠনতন্ত্র কর্মকৌশল, সাংগঠনিক কাঠামো, ঘোষণাপত্র ইত্যাদি চূড়ান্ত করতে হবে। মধ্যপন্থা অনুসরণে তা করতে হবে। তবেই এটিকে একটি কার্যকর দল বলা যাবে।