প্যালিয়াটিভ কেয়ার : একটি সুন্দর জীবন ও সুন্দর মৃত্যুর জন্য

প্রতিটি রোগীর অধিকার মৃত্যু পর্যন্ত আরাম ও সম্মানের সাথে বেঁচে থাকা; প্রশমন সেবা এটিই নিশ্চিত করে।

ডা: নুসাইবা জেসমিন

‘তুমি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তুমি আছ, তুমি আমাদের বাস্তবতায় মিশে আছ। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তুমি গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তোমার শান্তিতে মৃত্যুর জন্য নয়; বরং মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তুমি যাতে শান্তিতে বেঁচে থাকতে পারো এ জন্য আমাদের পক্ষে সম্ভব সব কিছুই আমরা করব।’ -প্যালিয়াটিভ কেয়ার আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ডেইম সিসিলি সনডারসের এই উক্তির মাধ্যমে প্যালিয়াটিভ কেয়ারের মূলমন্ত্রের ধারণা পাওয়া যায়। ১৯৬০ সালে তার হাত ধরেই ইংল্যান্ডে ক্যান্সার রোগীদের নিয়ে আধুনিক প্যালিয়াটিভ কেয়ারের যাত্রা শুরু হয়। ‘রোগটি বর্তমানে শেষপর্যায়, এখন আর কিছু করার নেই’-এ কথার বিপরীতে গিয়ে প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিশ্বাস করে ‘জীবনের শেষ পর্যন্ত অবশ্যই অনেক কিছু করার আছে’ যাতে রোগী ও তার পরিবারের দুর্দশা লাঘব করা যায়। এ বছর ১১ অক্টোবর হচ্ছে বিশ্ব হসপাইস ও প্যালিয়াটিভ কেয়ার দিবস। দিবসটি দীর্ঘমেয়াদি ও অনিরাময়যোগ্য রোগীর অধিকার, সুখ এবং মানসম্মত জীবনযাপন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে উদযাপিত হয়। ২০১৪ সালে, জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংসদে (World Health Assembly, WHA) প্রথমবারের মতো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং তার সদস্য দেশগুলোকে প্যালিয়াটিভ কেয়ারকে স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার রেজুলিউশন পাস করা হয়। ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য হলো : ‘প্রতিশ্রুতি অর্জনের লক্ষ্য- প্রশমন সেবায় সর্বজনীন প্রবেশাধিকার।’ বর্তমানে এখনো অনেক দেশে বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোতে জীবনের শেষ মুহূর্তে রোগীরা প্রাপ্য মানসম্মত ও মানবিক যত্ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্যালিয়াটিভ কেয়ার সেবা এখনো অনেক দেশে সীমিত এবং এই সেবার প্রতি যথাযথ মনোযোগ ও সম্পদ বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে।

প্যালিয়াটিভ কেয়ার কী

‘প্যালিয়াটিভ’ (PALLIATIVE) শব্দের অর্থ হচ্ছে- প্রশমন। প্যালিয়াটিভ কেয়ার বা প্রশমন সেবা হচ্ছে এমন একটি চিকিৎসাসেবা যা নিরাময় অযোগ্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির দুঃসহ কষ্ট কমাতে ও কঠিন সঙ্কটময় মুহূর্ত অতিবাহিত করতে সাহায্য করে। প্যালিয়াটিভ কেয়ার প্রতিটি রোগীকে একজন পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করে, যার মধ্যে তার শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্য, আত্মবিশ্বাস, মানসিক সুস্থতা, আধ্যাত্মিকতা এবং মর্যাদা অন্তর্ভুক্ত থাকে। যেহেতু পরিবারের সদস্যরা একজন রোগীর সেবায় যুক্ত থাকে, প্যালিয়াটিভ কেয়ার টিম তাই রোগীর সাথে সাথে তার পরিবারের সদস্য বা আপনজনদেরও সহায়তা করার চেষ্টা করে।

বাংলাদেশে প্রশমন সেবা

২০২০ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর এক লাখ আট হাজার ৯৯০ জন ক্যান্সারে মারা যায়। Quality of Death Index-2015 ৮০টি দেশের মধ্যে প্যালিয়াটিভ কেয়ার সেবার গুণমান অনুযায়ী দেশগুলোকে র‌্যাংকিং করেছে। এই র‌্যাংকিং বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে, যেমন প্যালিয়াটিভ কেয়ার সেবার প্রাপ্যতা, প্রয়োজনীয় ব্যথার ওষুধ প্রাপ্যতা, স্বাস্থ্যনীতি এবং প্যালিয়াটিভ কেয়ারের প্রতি সার্বিক প্রতিশ্রুতি। দুঃখজনক হচ্ছে, ৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৯ যা তখন শুধু যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকের ওপরে ছিল।

২০১৪ সালের আরেকটি গবেষণায় পাওয়া গেছে, বাংলাদেশে প্যালিয়াটিভ কেয়ারের প্রয়োজন এমন প্রতি বছর সাত লাখ রোগী ক্যান্সারসহ অন্যান্য নিরাময়-অযোগ্য রোগে ভুগছে যার মধ্যে ৪০ হাজার হচ্ছে শিশু। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (NIPORT) এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালিয়াটিভ মেডিসিন বিভাগের গবেষণায় দেখা গেছে- ০.০১ শতাংশেরও কম মানুষ প্যালিয়াটিভ কেয়ার পায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকা অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে Category 3a অর্থাৎ বাংলাদেশ বর্তমানে সীমিত আকারে কিছু বিক্ষিপ্ত প্রশমন সেবার ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে প্যালিয়াটিভ কেয়ার ঢাকা শহরের কিছু সীমিত হাসপাতালে অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও স্টাফদের দেয়া হয়। বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালিয়াটিভ মেডিসিন বিভাগ ২০০৭ সালে প্রফেসর নিযামউদ্দিন আহমেদের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে চেয়ারম্যান প্রফেসর এ কে এম মতিউর রহমান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ইনডোর ও আউটডোর সেবা, হোম কেয়ার, টেলিফোন সার্ভিস, কমিউনিটি সার্ভিস (মমতাময়ী নারায়ণগঞ্জ প্রজেক্ট), পোস্ট গ্র্যাজুয়েট রেসিডেনসি কোর্স, সার্টিফিকেট কোর্স, অন্যান্য কোর্স পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ও হাসপাতাল (NICRH), বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে স্বল্প পরিসরে এ সেবা দেয়া হয়। এ ছাড়াও কিছু প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে ও এনজিওতে রোগীরা প্যালিয়াটিভ কেয়ার সেবা পেয়ে থাকেন।

উন্নত বিশ্বে প্রশমন সেবা বর্তমানে বহুল প্রচলিত। কিন্তু এ ধারণাটি বাংলাদেশে তেমন প্রচলিত নয়। এখন এ রকমই ধারণা করা হয়, দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের যখন রোগ নিরাময়ী কোনো চিকিৎসায় আর কাজ হয় তখন যেন আর কিছু করার নেই। কিন্তু প্রশমন সেবা কখন বলে না, কিছু করার নেই।

প্রতিটি রোগীর অধিকার মৃত্যু পর্যন্ত আরাম ও সম্মানের সাথে বেঁচে থাকা; প্রশমন সেবা এটিই নিশ্চিত করে। এ ছাড়া অন্তিম মুহূর্তে হাসপাতালে গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগীদের ‘নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র’ বা আইসিইউতে পাঠানো হয়। কিন্তু এ ধরনের রোগীকে আইসিইউতে নেয়া আদৌ যৌক্তিক কি না- এমন একটি যান্ত্রিক মৃত্যু সেই রোগী বা তার পরিজনের আদৌ কাম্য ছিল কি না, সেসব বিবেচনা না করে নেহাত শেষ চেষ্টার নামে অনেক সময় রোগীর অন্তিম দিনগুলোকে ওই আইসিইউর গুমোটে কাটাতে বাধ্য করা হয়। আর সেই সময় রোগীর পরিজন তার রোগীকে আইসিইউতে রাখবেন কি রাখবেন না এ নিয়ে এক চরম নৈতিক, মানসিক ও আর্থিক সঙ্কটের ভেতর থাকেন। বিশেষ করে নিরাময় অসম্ভব রোগী বা ইররিভার্সেবল কেসকে আইসিইউতে না এনে প্যালিয়াটিভ কেয়ারের আওতায় আনা উচিত।

লেখক : এমবিবিএস, এফসিপিএস (মেডিসিন)

এমডি (কোর্স), প্যালিয়াটিভ মেডিসিন বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

মেডিসিন স্পেশালিস্ট, ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ধানমন্ডি।