বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের রাখাইন রাজ্যে তাৎপর্যপূর্ণ বেশ কিছু ঘটনা ঘটছে। আরাকান আর্মি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী-তাতমাদাওয়ের কাছ থেকে রাখাইনের ১৭টি টাউনশিপের মধ্যে ১৩-১৪টির নিয়ন্ত্রণ নেয়। এখন পাল্টা অভিযান শুরু করেছে তাতমাদাও। এ অভিযান রাখাইনের মাঠ-বাস্তবতায় তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের কৌশলগত বিশেষজ্ঞরা দেশের নিরাপত্তা ও রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের স্বার্থে পরিস্থিতি ও কৌশল নিয়ে নতুন করে ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজনের কথা বলছেন। তাতমাদাও রাখাইন রাজ্যে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সহযোগিতায় নতুন সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে। এতে কতটুকু ভূমি তাতমাদাও পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে, তা স্পষ্ট নয়। তবে আরাকান আর্মির অগ্রাভিযান যে থেমে গেছে, তা অনেকখানি স্পষ্ট।
তাতমাদাওয়ের নতুন অভিযানে মনে হচ্ছে চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর পাশে বিশেষ সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার জন্য সমস্যা হলো- ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার পেছনে তাতমাদাও-আরাকান আর্মির অভিন্ন ভূমিকা ছিল। কিন্তু পরে বহুমুখী চাপে জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়। তবে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা অঞ্চল দখলের পর নতুন করে তাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ ও উচ্ছেদ অভিযান চালানোর তথ্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
এ অবস্থায় আরাকান আর্মির সাথে ঢাকার আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক কোন পর্যায়ে থাকা উচিত, তা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণিত রেকর্ডে আরাকান আর্মির সাথে সম্পর্ক কূটনৈতিক রীতির খেলাপ হওয়ার পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে রোহিঙ্গাদের নাগরিক স্বীকৃতি বা পুনর্বাসন বিপজ্জনক হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মাঠের বাস্তবতায় পরিবর্তন?
সর্বশেষ পাল্টা অভিযানে তাতমাদাও এখন পর্যন্ত আরাকান আর্মির কাছ থেকে অল্প অংশ পুনর্দখল করতে পেরেছে। পুরো রাখাইনের বড় অংশ এখনো আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে আছে বলে মনে হয়। নিরপেক্ষ প্রতিবেদন ও ম্যাপিংগুলোতে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে ৭৬-৮২ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ দেখা যায়। ফলে তাতমাদাওয়ের পুনর্দখল হলো তাৎক্ষণিক ও সীমিত। কিছু টাউন বা আউটপোস্ট আবার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে মাত্র।
রাখাইনের মোট আয়তন ৩৬ হাজার ৭৭৮ বর্গমাইল। সিএসআইএস রিপোর্ট অনুসারে আরাকান আর্মি ১৭টি টাউনশিপ থেকে ১৩-১৪টি টাউনশিপ নিয়ন্ত্রণ করে। এ হিসাবে আরাকানে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা ৭৬-৮২ শতাংশ। তাতমাদওয়ের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ১৮-২৪ শতাংশ ভূমি। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এপি ও রয়টার্সের মতো গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুসারে উত্তরের কিছু টাউনশিপ (মংডু, বুথিডং, পালাতুয়া প্রভৃতি) সম্পূর্ণভাবে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে; তাতমাদাও কেবল বিচ্ছিন্ন ঘাঁটি বা টাউন সাময়িকভাবে পুনরুদ্ধার করেছে। সার্বিক বিবেচনায় একটি বাস্তবসম্মত বলা যায়- তাতমাদাও এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক বা কার্যকরভাবে রাখাইনের ২৪ শতাংশ পর্যন্ত ভূমি দখল করেছে বা রাখতে পেরেছে। এখানে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ- ‘নিয়ন্ত্রণ’ মানে পুরো প্লট-লেভেল মালিকানা নয়, কখনো সামরিক উপস্থিতি, কখনো প্রশাসনিক অনুপস্থিতি, কখনো কেবল রুট-প্যাট্রোল; ফলে একই জমির মালিকানার ব্যাখ্যা বদলে যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে মংডু ও বুথিডংয়ে জমি দখল ও পুনর্বিন্যাস এমনভাবে হচ্ছে, যা স্থানীয় রোহিঙ্গাদের ভূমিস্বত্ব, বসতি ও জীবনধারা সরাসরি অকার্যকর করে দিচ্ছে। ঘটনাগুলোতে দু’টি ধারা মিলতে দেখা যায়: ক. আরাকান আর্মির একক বা অনানুষ্ঠানিক সার্ভে-চালনা ও জমি হস্তান্তর; খ. সামরিক (তাতমাদাও) বা অন্যান্য গোষ্ঠীর পূর্ববর্তী ধ্বংস ও নিরাপত্তা-উদ্দেশ্যে জমি ব্যবহার- দুই ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের কাঠামোগতভাবে নাই করা লক্ষ্য হিসেবে উঠে আসে।
২০২৫ সালের জুন-জুলাইয়ে স্থানীয় সূত্রে রিপোর্ট হয়, আরাকান আর্মির মংডুতে রোহিঙ্গা-নিবাস ও কৃষিজমির ‘সার্ভে’ শুরু করেছে; একই সময়ে কয়েকটি গ্রাম থেকে উচ্ছেদ ও জমি হস্তান্তরের খবর আসে। স্থানীয় আক্রান্ত পরিবারগুলো বলে, তারা আগে সেখানে বসবাস করত। তাদের ঘর, পুকুর ও ক্ষেত ছিল। আরাকান আর্মি কিংবা অনানুষ্ঠানিক স্থানীয় প্রশাসন তাদের সে জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়ে জমি রাখাইন বসতি বা কৃষকদের নামে দেখাচ্ছে। প্রতিটির বিবরণে বাড়ি-নথি, ফসলিজমির চিহ্ন ও প্রতিবেশীদের স্টেটমেন্ট অন্তর্ভুক্ত।
২০২৫-এর প্রথমার্ধে বুথিডংয়ে একাধিক প্রতিবেদনে আরাকান আর্মির ভূমি-হস্তান্তরের অভিযোগ উঠে আসে। যেখানে নির্দিষ্ট রোহিঙ্গা বস্তি থেকে তাদের সরিয়ে ওই জমি অন্য সম্প্রদায়ের জন্য উন্মুক্ত করা হচ্ছে। কিছু প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, রোহিঙ্গা জমি রাখাইন গোষ্ঠীর কাছে হস্তান্তর হচ্ছে।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ আইনে জমির অধিকার ও দখলের নিয়ম আছে; তবে বাস্তবে নাগরিকত্ব-অবস্থা, নথি-অপ্রাপ্তি ও বৈষম্য সমস্যাগুলো ন্যায্যতায় বাধার সৃষ্টি করছে; অর্থাৎ কাগজভিত্তিক প্রমাণ থাকলেও কার্যকরী আইনি প্রতিকার প্রায়ই অনুপস্থিত। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যদি প্রমাণিত হয়- উচ্ছেদগুলো ধারাবাহিকভাবে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত ও বৈষম্যমূলক; তাহলে তা ‘নির্বাসন’, ‘নির্যাতন’ বা ক্ষেত্রবিশেষে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ বা যুদ্ধাপরাধের উপাদান ধারণ করতে পারে।
ওই পুনর্দখল ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের অধিকার, সহায়ক অবকাঠামো, নিরাপদ প্রত্যাবাসনের সুযোগবিষয়ক বড় উদ্বেগ রয়েছে। একই সাথে জমি পুনর্বণ্টন ও রিসেটলমেন্ট প্রক্রিয়া ভূপ্রকৌশল ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে বলে অনুসন্ধানগুলো দেখাচ্ছে।
রাজনৈতিক ও কৌশলগত অর্থ
সিএসআইএসের প্রতিবেদন অনুসারে, এ নিয়ন্ত্রণ ও ভূমি পুনর্দখল প্রক্রিয়াগুলো শুধু স্থানীয় শক্তি বিন্যাস নয়, বরং জাতীয় ও আঞ্চলিক কৌশলগত পরিবর্তনের অংশ। এক দিকে আরাকান আর্মির প্রতিষ্ঠিত হওয়া (বা প্রসার) এবং অন্য দিকে কেন্দ্রীয় মিয়ানমার সেনাবাহিনী (তাতমাদাও) ও অন্যান্য সশস্ত্রবাহিনীর ভূমিকা পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশের সীমান্ত প্রদেশ হওয়ায়, ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের বিষয় এবং ভূমি অধিকার ও পুনর্বাসন বিষয়ে আন্তর্জাতিক মনোযোগ বাড়ছে।
এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ও পরবর্তী যেসব প্রশ্ন রয়েছে, তাতে পুনর্বাসনের বিষয়টি মুখ্য। যারা উচ্ছেদ হয়েছেন, তাদের জন্য উপযুক্ত ভূমি, ঘর, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা রয়েছে কি না। আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারসংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি তথা ভূমি আবার দখল বা পুনর্বাসন প্রক্রিয়াতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক আইন কতটা মানা হচ্ছে। রাজনৈতিক সমাধান বা এ পরিবর্তনগুলোর মধ্য দিয়ে রাখাইন (আরাকান) রাজ্যে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা আসবে কি না অথবা নতুন ধরনের উত্তেজনা তৈরি হবে কি না। সীমান্ত থেকে উচ্ছেদ হওয়া বা পুনর্বাসনপ্রাপ্তদের জন্য সহায়তা ও পর্যবেক্ষণ গ্রহণযোগ্য কি না।
আরাকান আর্মির রোহিঙ্গা এলাকায় দখল প্রতিষ্ঠার পর অভিবাসন-ঝুঁকি ও অতিরিক্ত শরণার্থী ঢেউ লক্ষণীয়ভাবে দেখা গেছে। জমি-তলব ও সশস্ত্র সংঘর্ষে স্থানীয় রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন অসম্ভব হলে ফের আশ্রয় চাহিদা বাড়তে পারে, বিশেষত বাংলাদেশের কক্সবাজার ও সীমান্ত এলাকার ওপর প্রভাব পড়বে। ২০২৫-এ আবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন-দাবি নিয়ে আলোচনার প্রেক্ষাপটেও এটি জটিলতা তৈরি করছে বলে রয়টার্স উল্লেখ করেছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবিরের বাইরে ফেরত পাঠানো হলে নিরাপত্তা, নাগরিক অধিকার ও জীবিকার নিশ্চয়তা ছাড়া ফেরানো ‘দমনমূলক পুনর্বাসন’ হবে বলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা সতর্ক করেছে।
প্রত্যাবাসন অঙ্গীকার ছাড়া আরাকান আর্মিকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা
আরাকান স্ট্র্যাটেজিক ফোরাম মিয়ানমারের আরাকান (রাখাইন) সঙ্কটে এক ভয়াবহ প্রবণতা দেখা দিয়েছে বলে সতর্ক করেছে। ফোরামের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়- যখন নিরপেক্ষতা সহায়তায় পরিণত হয়; তখন মানবাধিকার ও নীতিনির্ধারকদের কাজ হওয়া উচিত ন্যায়বিচার রক্ষা, নাগরিকদের সুরক্ষা এবং দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকা। কিন্তু এখানে একদল তথাকথিত ‘রাখাইন বিশেষজ্ঞের’ উদ্ভূত হয়েছে- যারা মাদকচক্র-অর্থায়িত আরাকান আর্মিকে (এএ) তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধ উপেক্ষা করে মহিমান্বিত করছেন। নিজেদের বিশ্লেষণ-নীতিগত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এ গোষ্ঠীকে আন্তর্জাতিকভাবে ন্যায়বোধ ও সততা বিসর্জন দিয়ে খ্যাতি অর্জনে বৈধতা দিতে সাহায্য করেছেন। এখনো করছেন।
ফোরাম ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের থমাস কিয়ান, স্টিমসন সেন্টারের (ওয়াশিংটন ডিসি) সিনিয়র ফেলো স্টিভ রস, সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ, কম্বোডিয়ার সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ড. এমা লেসলি, ভিকটিম অ্যাডভোকেটস ইন্টারন্যাশনাল, অস্ট্রেলিয়ার নির্বাহী পরিচালক ও নিউ সাউথ ওয়েলস বার অ্যাসোসিয়েশন মানবাধিকার কমিটির সদস্য ইভা বুজোর নাম উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- তারা এমন এক বয়ান গড়ে তুলেছেন, যা নীরবে আরাকান আর্মিকে বৈধতা দেয়। নীতিপত্র, সাক্ষাৎকার ও জনসভায় এএ-কে ‘অবশ্যম্ভাবী শাসনক্ষমতা’ হিসেবে উপস্থাপন করেন তারা- যেন এটি মানবিক সহায়তা ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের অংশীদার। বাস্তবে সংগঠনটি সেনা জান্তার নিপীড়নের নকশা অনুকরণ করছে- দশকের পর দশক ধরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত একই নির্যাতন ও বাস্তুচ্যুতির টুলস প্রয়োগ করছে। তবু তারা এএর উত্থানকে ‘স্থানীয় প্রশাসন’ বা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক স্থিতিশীলতা’ হিসেবে তুলে ধরেন। এর মাধ্যমে তারা যুদ্ধাপরাধ, মাদক অর্থায়ন ও পদ্ধতিগত নিপীড়নে জড়িত এক গোষ্ঠীকে স্বাভাবিক ও বৈধ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রচার করছেন। আর ভুক্তভোগীদের কষ্ট আন্তর্জাতিক আলোচনার প্রান্তে ঠেলে দিচ্ছেন।
আরাকান স্ট্র্যাটেজিক ফোরাম বলেছে- আরাকান আর্মির রেকর্ড একেবারে অস্পষ্ট নয়। স্বতন্ত্র মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রমাণ করেছে- আগস্ট ২০২৫-এ মংডু হত্যাযজ্ঞে ১৭৫ জনের বেশি রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন, এপ্রিলে বুথিদংয়ে গণহত্যা হয়েছে- বুথিদংয়ের হথান শাউক খান গ্রামে (২ মে ২০২৪) ৬০০ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করে এএ। এতে দুই লাখের বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হন। এ ছাড়া অন্তত এক লাখ ১৮ হাজার বাংলাদেশে পালিয়ে গেছেন। তবু ২০২২ সালের পর থেকে বহু নীতিগত বিশ্লেষক এএ-কে ‘ডি ফ্যাক্টো অথরিটি’ বা ‘প্রটো-স্টেট’ হিসেবে আবার প্রচার করেন।
আরাকান স্ট্র্যাটেজিক ফোরাম উল্লেখ করেছে- থমাস কিয়ান নিয়মিতভাবে পরামর্শ দেন, ‘প্রত্যাবাসন ও স্থিতিশীলতা’র জন্য এএর সাথে সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। স্টিভ রস লেখেন, ‘নিরাপত্তা ও প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত’। এতে এএ সীমান্তের নিয়ন্ত্রক হিসেবে স্বীকৃতি পায়, অথচ রোহিঙ্গা নিপীড়নের প্রসঙ্গ চাপা পড়ে যায়। ড. এমা লেসলির ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের’ প্রস্তাব কার্যত এএ’র জন্য দায়মুক্তির পথ উন্মুক্ত করে।
‘নন-স্টেট কাউন্টারপার্ট’, ‘প্রটো-স্টেট’, ‘ডি ফ্যাক্টো অথরিটি’- এসব শব্দ নিছক নিরপেক্ষ নয়; এগুলোর আইনি-রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে। এগুলো ব্যবহারে অপরাধী সত্তাকে দায়মুক্ত রেখে দাতারা তহবিল দিতে পারে এবং সরকারগুলো আলোচনায় বসতে পারে। প্রতিবার এএ যখন এমন কূটনৈতিক বা মানবিক নথিতে স্থান পায়, তখন যুদ্ধক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক পুঁজি হয়ে ওঠে। আর ভুক্তভোগীরা পান অনির্দিষ্টকালের অপেক্ষা।
ফোরামের বক্তব্য অনুসারে যদি আরাকান আর্মিকে বৈধতা দেয়া হয়, তা হবে এক গভীর অন্যায়। অপরাধের স্বীকৃতি ছাড়া ন্যায়বিচার সম্ভব নয়; রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনও সম্ভব নয়। এক সক্রিয় নিপীড়নকারীকে রাজনৈতিক স্থান দিলে; তা জবাবদিহি বন্ধ করে, ভুক্তভোগীদের কণ্ঠরোধ করে এবং ‘প্রত্যাবাসন’ প্রক্রিয়া তাদের হাতে তুলে দেয়; যারা বাস্তুচ্যুতি ঘটিয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক আইনের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল করবে। সেই সাথে রোহিঙ্গাদের স্থায়ী অনিরাপত্তায় আটকে রাখবে।
বাংলাদেশের জন্য কৌশলগত ইস্যু ও ঝুঁকি
রোহিঙ্গা সঙ্কটে সবচেয়ে ভুক্তভোগী বাংলাদেশ। আরাকান আর্মির সমুদ্রে উপস্থিতি এবং কিছু ঘটনায় বাংলাদেশী জেলেদের নিশানা হওয়া (নৌজাহাজ লুট, জেলেদের হুমকি) বাংলাদেশের সমুদ্র-অর্থনীতিকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এনেছে।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা পুনর্বিন্যাসের (তাতমাদাও বনাম আরাকান আর্মির বা ইএও) কারণে বাংলাদেশের জন্য স্থায়ী প্রত্যাবাসন আলোচনা জটিল হয়ে পড়েছে। আরাকান আর্মি দীর্ঘ সময় ধরে এ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে রাখলে সেখানে একটি ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘নতুন ডি-ফ্যাক্টো প্রশাসন’ গড়ে উঠতে পারে, যা মান্যতা পাবে না, কিন্তু স্থানীয় ক্ষমতা বাস্তবে প্রয়োগ করবে।
চীন, ভারত ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর কূটনৈতিক অবস্থান আরাকান আর্মির কার্যকলাপ ও তাতমাদাওয়ের কৌশলের ওপর বড় প্রভাব ফেলবে; আন্তর্জাতিকভাবে যদি আরাকান আর্মিকে অংশগ্রহণযোগ্য মনে করা হয়, তবে স্থানীয় পুনর্বাসন ও অধিকার বিষয়ে আলাদা রাজনীতিক চ্যালেঞ্জ আসবে।
রাখাইন-আরাকানে যে নতুন বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে- এটি শুধু সামরিক ভূখণ্ড পরিবর্তন নয়; এটি জমি-সামর্থ্য ও জনগণের নাগরিকত্ব-অধিকারের ওপর পুনর্বিন্যাস। অনেক ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের জমিস্বত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া পুনর্বাসনের নামে কার্যক্রম পরিচালিত হলে তা আবার মানবাধিকারভিত্তিক সঙ্কট তৈরি করবে। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের জন্য এটি কেবল শরণার্থী সঙ্কট নয়- এটি সীমান্ত নিরাপত্তা, সামুদ্রিক অর্থনীতি ও কূটনীতিতে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। এমন পরিস্থিতিতে সঙ্কট-প্রতিরোধের কার্যকর উপায় হলো- দ্রুত তথ্যভিত্তিক কৌশল, আঞ্চলিক কূটনীতি, প্রয়োজনে সামরিক চাপ এবং আন্তর্জাতিক তদন্ত নিশ্চিতকরণ।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক নয়া দিগন্ত



