ভারত ও ভারতের গণমাধ্যমের একটি অংশ বাংলাদেশ সম্পর্কে চরম মিথ্যা ও পক্ষপাতদুষ্ট তথ্য ছড়াচ্ছে। কেন এমনটি হচ্ছে বুঝতে হলে একাধিক স্তরে চিন্তা করতে হবে- যেমন রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং গণমাধ্যমের কাঠামোগত প্রবণতা।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক চেতনার পুনরুত্থান ভারতীয় কিছু মহলের অস্বস্তির কারণ। বিশেষ করে যখন এই পরিবর্তন ভারতের কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
ভারতের কিছু গণমাধ্যম, বিশেষ করে উগ্র জাতীয়তাবাদী চ্যানেল ও পোর্টাল বাংলাদেশের সংখ্যালঘু পরিস্থিতি নিয়ে অতিরঞ্জিত ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে যাচ্ছে। যেমন ২০২৪ সালে রিউমর স্ক্যানার বাংলাদেশ দেখায় যে, অন্তত ৭২টি ভারতীয় গণমাধ্যম ১৩৭টি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যার অধিকাংশই ছিল বিভ্রান্তিকর বা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এই অপপ্রচারের একটি বড় অংশ সংখ্যালঘু নিপীড়নের ‘গল্প’ তৈরি করেছে, যা বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অথচ বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য দীর্ঘ দিনের এবং সরকারও সম্প্রীতি রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এই অপপ্রচারের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও স্পষ্ট। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও ক্ষমতার পালাবদল ভারতের কিছু শাসকগোষ্ঠীর জন্য অস্বস্তিকর, কেননা তারা দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশে একটি অনুগত সরকার দেখেছে। যখন সেই কাক্সিক্ষত রাজনৈতিক কাঠামো ভেঙে গেল, তখন গণমাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্টের চেষ্টা চলছে। এতে এক দিকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, অন্য দিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক এজেন্ডা শক্তিশালী করা যাচ্ছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ভারতীয় গণমাধ্যমের একটি অংশ ‘গদি মিডিয়া’ হিসেবে পরিচিত, যারা শাসকদলের স্বার্থে কাজ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের ৫৩ জন বিশিষ্ট নাগরিক এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, এসব গণমাধ্যম বিভাজনমূলক বর্ণনা দিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অনাস্থা তৈরি করতে এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে দিতে চায়।
তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এই ধরনের অপপ্রচার শুধু সীমান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং তা আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করতে পারে। তবে আশার বিষয় হলো, ভয়েস অব আমেরিকা, দ্য কুইন্ট, মিনিট মিররের মতো আন্তর্জাতিক ও ভারতীয় বিকল্প গণমাধ্যমগুলো এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে যুক্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানাচ্ছে এবং প্রকৃত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করছে। সার্বিকভাবে ভারতীয় গণমাধ্যমের এই মিথ্যাচার একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কৌশলের অংশ, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র এবং বহুত্ববাদকে চ্যালেঞ্জ করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নাগরিকসমাজ, গণমাধ্যম এবং কূটনৈতিক মহলের উচিত ঐক্যবদ্ধভাবে সত্য তুলে ধরা, অপপ্রচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা।
ব্রহ্মা চেলানি নামে এক বিতর্কিত বিশ্লেষক সম্প্রতি তার এক নিবন্ধে বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে এমন কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন, সেগুলো ভারতেরই অন্য এক সংবাদ বিশ্লেষক ‘পক্ষপাতদুষ্ট’, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ এবং ‘ভুল তথ্য ও পরিসংখ্যান’ হিসেবে বর্ণনা করেন। চেলানি মূলত ভারতের বিজেপি সমর্থক এবং ডানপন্থী বিশ্লেষক। তিনি ‘দ্য জাপান টাইমসে’র নামে একটি নিবন্ধ শেয়ার করেন। তার নিবন্ধটি বাংলাদেশের সাথে জাপানিদের কিছু ভুলবোঝাবুঝির সৃষ্টি করে।
ব্রহ্মা চেলানি একজন পরিচিত ভারতীয় জিওস্ট্র্যাটেজিস্ট এবং কলাম লেখক। তিনি সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চে কাজ করেছেন। ভারতের পারমাণবিক নীতিনির্ধারণেও ভূমিকা পালন করেন। চীনের ঋণব্যবস্থাকে তিনি ঋণ-ফাঁদ কূটনীতি এবং কৌশলগত প্রভাব সাধনের টুলস হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাতে বিশ্বে স্কলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরিবর্তে তিনি আজ ধোঁকাবাজ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।
চেলানি তার নিবন্ধে বাংলাদেশের অর্থনীতির পতন নিয়ে যেসব দাবি উত্থাপন করেছেন সেগুলো মূলত ভারতীয় অপপ্রচারেরই অংশ। যেমন চেলানি বাংলাদেশকে একটি ‘দক্ষিণ এশীয় টাইম বোম’ হিসেবে প্রচার করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ‘প্রতিশ্রুতি থেকে বিপদের দিকে’ যাচ্ছে এবং শেখ হাসিনার পতনের পর দেশটি ‘পাকিস্তান-স্টাইলের বিশৃঙ্খলার’ দিকে ছুটছে। কী বিশৃঙ্খলা তা তিনি উল্লেখ করেননি। বলেছেন, ‘কট্টর ইসলামিক শক্তিগুলো প্রভাব বিস্তার করছে’, ‘তরুণরা ক্রমবর্ধমানভাবে উগ্রবাদী হয়ে উঠছে’, ‘আইনহীনতা বাড়ছে’ এবং ‘ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা অবরুদ্ধ’। ভারতের সাংবাদিকরাই এই দাবিকে ‘ভুল, বানোয়াট’ এবং ‘সাজানো ভাষা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, অর্থনীতি দ্রুত পতন হচ্ছে এবং হাসিনার আমলে অর্থনীতির অবস্থা ভালো ছিল। অর্থনীতির সূচক নিয়ে তিনি লিখেন, জিডিপি থমকে গেছে, অথচ বাংলাদেশ ‘দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে’র তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের জিডিপি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ৩.৯৭ শতাংশ হারে বেড়েছে। তিনি বলেন, মুদ্রাস্ফীতি ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। অথচ দেখা গেছে, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে মুদ্রাস্ফীতি যেখানে ১১.৬৬ শতাংশ ছিল (হাসিনার সরকারে), ২০২৪ সালের জুলাই মাসে তা কমে ৮.৫৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, অর্থাৎ বাড়েনি।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির কারণ সম্পর্কে চেলানি দাবি করেছেন যে, ইউনূসের নোবেল পুরস্কার তার গ্রামীণ ব্যাংকের প্রকৃত প্রভাবের জন্য দেয়া হয়নি; বরং এটি ছিল ‘ভূরাজনৈতিক সঙ্কেতের’ (geopolitical signaling) কারণে। তিনি ব্যাখ্যা করেন, পুরস্কার দেয়ার সময় নোবেল কমিটির চেয়ারপারসন ইউনূসকে ‘ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মধ্যে একটি প্রতীকী সেতুবন্ধ’ (symbolic bridge between Islam and the West) হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
নিবন্ধে ইঙ্গিত দেয়া হয় যে, প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লি¬নটন নোবেল প্রাপ্তিতে ইউনূসের জন্য লবিং করেন। বাস্তবে নোবেল কমিটি কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নয় যে, তারা ভূরাজনৈতিক কোনো সঙ্কেত দেবে। এখানে লবিংয়ের কোনো সুযোগ আদৌ নেই। চেলানিকে জানাতে হয়, ভারত নিজেও ব্র্যান্ড মোদি তৈরিতে লবিং ফার্মের সাহায্য নেয় এবং বিভিন্ন মিডিয়াকে নিয়োগ দিয়ে থাকে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও নোবেল পুরস্কারের জন্য নরওয়ের প্রেসিডেন্টকে ফোন করেছিলেন।
ব্রহ্মা চেলানি ড. ইউনুসকে আক্রমণ করতে গিয়ে আরো বলেন যে, নির্বাচন বারবার স্থগিত করা হয়েছে। এটা কত বড় মিথ্যা বাংলাদেশর কোটি কোটি মানুষ তা জানে। কেননা নির্বাচনের তারিখ ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সব রাজনৈতিক দল প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের পদক্ষেপ, যেমন বাংলা ভাষাভাষীদের ঠেলে দেয়া, ভিসা নিষেধাজ্ঞা, বন্দর নিষেধাজ্ঞা, রফতানি নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতকে ধ্বংস করার ধারাবাহিক পদক্ষেপ বলে মনে করেন বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা। এটি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং কৌশলগত বিষয়। এগুলো একটু কাছে গিয়ে পরখ করলে দেখা যাবে, বন্দর ও বাণিজ্যসংক্রান্ত বিধিনিষেধে ভারত কয়েকটি বন্দর দিয়ে বিশেষ করে বাংলাদেশী তৈরী পোশাক রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘নিয়ন্ত্রক’ বা ‘নিরাপত্তা সম্পর্কিত’ ব্যবস্থা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হলেও ঢাকার দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলো শুল্কবহির্ভূত বাধা। এই ধরনের পদক্ষেপ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্নায়ুকে আঘাত করে। নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘায়িত হলে এগুলো শুধু বাংলাদেশের রফতানি রাজস্বকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না; বরং সরবরাহকারী হিসেবে ঢাকার নির্ভরযোগ্যতার প্রতি ক্রেতাদের আস্থাও ক্ষুণ্ণ করবে।
অভিবাসন ও নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ভারত বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য ভিসা নীতিমালা কঠোর করেছে। বাস্তবে এটি অভিবাসী শ্রমিক, শিক্ষার্থী এবং ব্যবসায়িক ভ্রমণকারীদের ভোগান্তির সৃষ্টি করেছে।
বাংলাভাষী মানুষকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে পুশব্যাক বড় রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা তৈরি করেছে। এটি বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী আবেগ উজ্জীবিত করছে এবং একটি জনতাত্তি¡ক ও শরণার্থী সঙ্কটের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে, যা বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অপচেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে।
ভারত এর আগে কোনোরকম আগাম নোটিশ ছাড়াই বাংলাদেশে পেঁয়াজ, গম, চিনির মতো প্রয়োজনীয় পণ্যের রফতানি নিষিদ্ধ করেছিল। যদিও ভারত প্রায়ই এই নিষেধাজ্ঞাগুলোকে অভ্যন্তরীণ মূল্য-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হিসেবে ন্যায্যতা দেয়, তবে যে সময়ে তারা এটি করে যেমন, বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে বা অর্থনৈতিক চাপের সময়, সেটি উদ্দেশ্যমূলক সঙ্কোচনের সন্দেহ বাড়িয়ে তোলে।
প্রতিটি ভারতীয় পদক্ষেপকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, সংরক্ষণবাদ বা নিয়ন্ত্রক সমন্বয় হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ঢাকাকে ভূরাজনৈতিকভাবে দিল্লির কৌশলগত স্বার্থের সাথে সংযুক্ত রাখার জন্য একটি চাপ-প্রচারণার ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছে। এই কাজ সহজ করার জন্য বিকৃত মিডিয়া ও ব্যক্তি কাজ করছে। ভারত ইঙ্গিত দিচ্ছে যে চীন, তুরস্ক, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের অংশীদারদের সাথে সম্পর্ক গভীর করার মতো বিকল্প প্রান্তিকীকরণের দিকে ঢাকা ঝুঁকে গেলে অর্থনৈতিক লাইফলাইন বাণিজ্য, বন্দর, প্রয়োজনীয় আমদানি সীমাবদ্ধ করা ভারতের রুটিন কাজের মতো হবে। অর্থাৎ রীতিমতো হুমকি। ভারতের এসব কৌশলের অতিরিক্ত চাপের কারণে বাংলাদেশকে বেইজিংয়ের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার বা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতবিরোধী মনোভাব উসকে দিয়ে ব্যাকফায়ার করানো যেতে পারে, যা মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে গড়ে ওঠা দ্বিপক্ষীয় আস্থাকে দুর্বল করে দিতে পারে। এটি বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের কাছে বার্তা।
ভারতের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংসের সুস্পষ্ট ষড়যন্ত্র হিসেবে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ ও কৌশলগত সঙ্কেতের সংমিশ্রণের মতো একটি বিষয়, তবে এর প্রভাব অনস্বীকার্যভাবে অস্থিতিশীল। বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারে প্রতিদ্ব›দ্বীদের মধ্যে চীন, পাকিস্তান, তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ রয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, দিল্লি বর্তমান কর্মকাণ্ড থেকে বিরত না হলে বাংলাদেশে তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার