অযাচিত সমালোচনা-অতিরঞ্জিত অপপ্রচার সত্যেও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাজনীতিতে টিকে আছেন বহাল তবিয়তে। তার বিরুদ্ধে হাসিনা ও তার দোসররা সীমাহীন গুজব রটিয়েছে। এরপরও ১৭-১৮ বছর ধরে বিএনপিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ওয়ান ইলেভেনের দু’বছর এবং আওয়ামী লীগ আমলের ১৫-১৬ বছর কখনো কখনো দল ভাঙার উপক্রম ঠেকিয়েছেন সুদূর ব্রিটেন থেকে। দলীয় শৃঙ্খলা ধরে রাখতে এখন নিচ্ছেন কঠোর পদক্ষেপ। দলের সব স্তরে অভিযোগদৃষ্টে বহিষ্কার, পদাবনতি, পদ স্থগিত, শোকজসহ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলে যাচ্ছেন মানুষ অপছন্দ করে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে। আওয়ামী লীগের পরিণতি থেকে শিক্ষা নেয়ার আহ্বানও জানিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। দুই দশক ধরে বহু সঙ্কট মোকাবেলা করে এগিয়েছেন তিনি। যে কারণে হাসিনা তাকে সহ্য করতে পারেননি। যার প্রকাশ চাপা রাখতে পারেননি তিনি। প্রসঙ্গ ছাড়াও তারেক রহমানের নাম উচ্চারণ করতেন। অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করেছেন প্রতিনিয়ত। তুই-তুকারিসহ নিম্নমানের ভাষায় আক্রমণ করেছেন অসংখ্যবার। শেখ হাসিনার ওই সব অশালীন ভাষার কখনো কোনো জবাব দেননি তারেক রহমান।
২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তারেক রহমান। দেশে ফিরতে মানা, কথা বলতে মানা, কথা প্রচারে আদালতের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও এগিয়েছেন। তার দৃঢ়তায় নির্যাতকদের পরাস্ত হতে হয়েছে নিদারুণভাবে। চব্বিশের বিপ্লব-পরবর্তী স্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপট তৈরি করেতেও তিনি ভূমিকা রেখেছেন। একজন নির্যাতিত হিসেবে প্রতিহিংসাপরায়ণ ও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার শঙ্কা করেছেন অনেকে, বাস্তবে দেখা গেল সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন শান্ত থাকার।
বিগত সরকারের অবিরাম অপপ্রচার, পতিত প্রধানমন্ত্রীসহ কয়েক মন্ত্রীর নিয়মিত গালমন্দ, ভেংচি, খিঁচুনির জবাব কখনো মন্দ কথায় দেননি তারেক রহমান। তার কাজ তিনি করে গেছেন নীরবে-নিভৃতে, যা ক্রমে তাকে আরো শক্তিশালী করেছে। খাদের কিনার থেকে দলকে টেনে তোলার শক্তি দেখিয়েছে। দলের তৃণমূলের কাছে হয়ে উঠেছেন ছায়াসঙ্গী। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে দলীয় লাখ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গুম হয়েছেন ৫০০-এর বেশি। হত্যার শিকার হয়েছেন অসংখ্য। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন বহু নেতাকর্মী। হামলা-মামলা, জীবিকা, ব্যবসাবাণিজ্য খুইয়ে পথে বসেছেন বিপুলসংখ্যক বিএনপি নেতাকর্মী। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষকে হারিয়ে অসহায়ের মতো দিনাতিপাত করেছে গুম-খুনের শিকার পরিবারগুলো। তাদের সবার সাথে নিজে একটি সেতুবন্ধ গড়েছেন তারেক রহমান। পরিবারগুলোর খোঁজ বর নিয়েছেন নিয়মিত। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর দেশে তৈরি হওয়া নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে নিজ দলকে সামলিয়েছেন কঠোর নির্দেশনায়। এ পদক্ষেপের কথা এসেছে, ‘দ্য উইক’ ম্যাগাজিনে, যার শিরোনাম ‘ডেসটিনি’স চাইল্ড’ বা নিয়তির সন্তান।
দ্য উইক ম্যাগাজিনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপি ভাঙার চেষ্টার বিপরীতে তারেক রহমানের নেতৃত্বে দল ঐক্যবদ্ধ রয়েছে, যা দিন দিন তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পরিবর্তন তারেক রহমানকে একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হতে পারে তারেক রহমানের জন্য।
ওয়ান ইলেভেন জমানায় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ গ্রেফতার করা হয় তারেক রহমানকে। গ্রেফতারের পর অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি। আর রচনা করা হয় বদনাম-কলঙ্ক। ১৮ মাস কারান্তরীণ থাকার পর জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দেশ ছাড়েন যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে। সেই থেকে এখনো লন্ডনে আছেন। সেখান থেকে দল পরিচালনা করছেন। পতিত স্বৈরাচারের পক্ষ থেকে একেক সময় দলটি ভেঙে টুকরো টুকরো করার আয়োজন হয়। এসব নোংরামিতে দল ভাঙেনি; বরং হয়েছে আরো টেকসই-সংগঠিত। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি যা হারিয়েছেন, তা ফেরত পাওয়ার নয়।
অন্য দিকে, তার স্ত্রী ডা: জুবাইদা রহমানও স্বামীর সাথে এই পুরো সময় নির্যাতন হজম করেছেন। কেবল তারেক রহমানের স্ত্রী হওয়ায় ডা: জুবাইদাকে হেন অপদস্ত নেই, যা না করেনি হাসিনা সরকার। ডা: জুবাইদা বাংলাদেশের চিকিৎসাশাস্ত্রের অত্যন্ত মেধাবী একজন শিক্ষার্থী। তার পরীক্ষার ফল চিকিৎসাশাস্ত্রের অনেক শিক্ষার্থীর কাছে ঈর্ষণীয় বিষয়। সেই তাকে শুধু চাকরিচ্যুত নয়, মামলা-মোকদ্দমায় জড়ানো হয়।
এমন কঠিন সময়েও টলেননি, ভাঙেননি তারেক রহমান। লন্ডনের নির্বাসন তাকে করেছে অপ্রতিরোধ্য, দেশের মিডিয়া তার বক্তব্য প্রচার করতে না পারলেও ভিডিও কনফারেন্স, সোস্যাল মিডিয়া ও আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে দেশের আনাচে-কানাচে তৃণমূল থেকে জাতীয় পরিসরে আরো দীপ্তমান করেছে। দলীয় নেতাকর্মীকে করেছে আরো যূথবদ্ধ।
তারেক রহমান তার মা বেগম খালেদা জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন উল্লেখ করে দ্য উইক ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার পদচ্যুত হওয়ার পর বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ঢাকায় তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন নিয়ে তুমুল উত্তেজনা বিরাজ করছে। যিনি ভার্চুয়ালি দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখছেন, ঢাকায় নামার পর তার জীবনে পূর্ণচক্র সম্পূর্ণ হবে। খালেদা জিয়া আশা করছেন, তারেক রহমান আসন্ন নির্বাচনে দলের মুখ হিসেবে আবির্ভূত হবেন।
তারেক রহমান ইতোমধ্যে একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করে রেখেছেন। চাকরি, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষক, শ্রমিক বা শ্রমজীবী যেই হোন না কেন, তাদের সমান সুযোগ, ন্যায্য মজুরি এবং দুর্নীতিমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দিতে চান তিনি। পাশাপাশি একটি জ্ঞানভিত্তিক ও উন্নয়নকেন্দ্রিক রাজনীতি গড়ে তুলতে তার দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নে কাজ চলছে। সব নজর এখন থাকবে এ দিকে যে, কতটা দক্ষতার সাথে বাংলাদেশের নেতৃত্ব নিতে সক্ষম হবেন; যখন তিনি ঢাকায় নামবেন।
বিগত সেনা-সমর্থিত সরকার তারেক রহমানকে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করেছিল। সেই ধারাবাহিকতা হাসিনা আমলেও বহান ছিল। একই সাথে সামরিক-প্রশাসনিক কর্তৃত্ব তার কাছ থেকে লিখিত অঙ্গীকার নিয়েছিল যে, তিনি ভবিষ্যতে আর রাজনীতি করবেন না। এটি ছিল তার রাজনৈতিক অধিকারের প্রতি চরম লঙ্ঘন। বহু আইনি ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন তিনি।
২০০৯ সালে দলের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে তারেক রহমান বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৬ সালে হন পুনঃনির্বাচিত। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় মায়ের কারাবরণের পর থেকে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কঠিনেরে জয় করে আরো কঠিনের পথে তিনি। আগামী নির্বাচন হবে ইতিহাসের অন্যতম কঠিন পরীক্ষা। এ বার্তা দলের নেতাকর্মীদের দিয়ে রেখেছেন তিনি আরো আগে। তবে সবার কাছে তা বোধগম্য হয়নি। যারা যদ্দুর পেরেছেন বুঝেছেন। দলের ভেতর-বাইরেসহ গোটা রাজনীতিতে যে উচ্চতায় এখন তার অবস্থান, সেটির ফলোআপ এবং আপডেট আরেক দায়; সাথে কঠিন দায়িত্বও।
তারেক রহমান নিজেকে ক্রমেই একটা উচ্চমাত্রায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন পরিস্থিতির এই হেরফেরেও। ব্রিটিশ সাপ্তাহিক ‘দ্য উইক’ সাময়িকীটিতে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশে পরিবর্তন তারেক রহমানের জন্য একটি সুযোগ, যাতে তিনি তার পূর্বসূরিদের ধারা ভেঙে নিজস্ব একটি রাজনীতির উত্তরাধিকার তৈরি করতে পারেন। অবশ্য বাচনে বচনে এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার যোগ্যতার ছাপ সম্প্রতি আরো বেশি দৃশ্যমান। দেশের এ কঠিন সময়ে তার এই পরিপক্বতা অনেকের কাছেই আশাজাগানিয়া।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট