খালেদা জিয়ার প্রত্যাবর্তন রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন

বেগম খালেদা জিয়ার দীর্ঘ সংগ্রামে তাকে ডানে কিংবা বামে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা ও প্রয়াস অনেকবার লক্ষ করা গেছে; কিন্তু তিনি বাংলাদেশী জাতিসত্তার আলোকে তার নীতি ও কর্মসূচি সাজিয়েছেন, যা এ জাতির ঐক্য ও সংহতিকে নিশ্চিত করেছে।

নয়া দিগন্ত

মহৎজন সম্পর্কে শেকসপিয়রের বিখ্যাত উক্তিটি এ রকম- কিছু মানুষ মহত্ত্ব নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। কিছু লোকের ওপর মহত্ত্ব আরোপ করা হয়। আর কিছু লোক তার শ্রম, সাধনা ও সময়ের পরীক্ষা দ্বারা মহত্ত্ব অর্জন করে। বাংলাদেশের শত শত রাজনীতিকের ভিড়ে তার অনন্যসাধারণ ভূমিকার দ্বারা প্রমাণ করেছেন- তিনি অর্জিত মহত্তে¡র অংশীদার। তিনি জনগণের রাজনীতিবিদ। আদর্শ, নিষ্ঠা, মিতাচার ও উন্নত নৈতিকতা দ্বারা তিনি মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন অলঙ্কৃত করেছেন। তাই শেকসপিয়রের উক্তিটি তার বেলায় শতভাগ প্রযোজ্য- তিনি মহত্ত্ব অর্জন করেছেন।

জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ক্রান্তিকালে তার উত্থান। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী হিসেবে তার একক পরিচয়। তিনি গৃহবধূ। অনেকেরই ধারণা ছিল, জিয়াউর রহমানের শাহাদতের পর তার প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী দলের অবলুপ্তি ঘটবে। পৃথিবীর ইতিহাস প্রমাণ করে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর শাসন থেকে সৃষ্ট রাজনৈতিক দল সময়ের পরীক্ষায় বিলীন হয়ে যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিকদের সুবিধাবাদী চরিত্র, বিশ্বাসঘাতকতা ও কোন্দল আকীর্ণতা বিএনপির অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। আপনাদের মনে করিয়ে দিই- এরশাদের আগমন ঘটেছিল বিএনপির একাংশের বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা। আবার একটি পর্যায়ে আরেকটি অংশ এরশাদের সাথে হাত মেলায়। সেই দুঃসময়ে অত্যন্ত সতর্কতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সবাই জানেন, এরশাদ তাকে উপরাষ্ট্রপতি করতে চেয়েছিলেন। ক্ষমতার আহ্বানে সাড়া না দেয়ায় পরবর্তী প্রায় এক দশক প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে বেগম খালেদা জিয়াকে চ্যালেঞ্জ করেই এগোতে হয়েছে। দীর্ঘ ৯ বছরের আন্দোলন, সংগ্রাম ও দৃঢ়তার দ্বারা তিনি আপসহীন নেত্রীর অবিধা অর্জন করেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে অসাধারণ ভূমিকা ও কিংবদন্তিতুল্য জনপ্রিয়তা তাকে অতি উচ্চতায় স্থাপন করেছে। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে তার অনন্যসাধারণ ভূমিকা তাকে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্থায়ী আসন দিয়েছে। এ ধরনের উক্তি ভক্তের প্রশস্তি নয়। দেশের শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান মন্তব্য করেন, ঝযব ংঁপপববফবফ রহ ঃৎধহংভড়ৎসরহম ঃযব ইঘচ ভৎড়স ধ ংঃধঃব-ংঢ়ড়হংড়ৎবফ ংধৎশধৎর ঢ়ধৎঃু ঃড় ধহ ড়ঢ়ঢ়ড়ংরঃরড়হ ঢ়ধৎঃু...’ (চড়ষরঃরপধষ চধৎঃরবং রহ ইধহমষধফবংয, চৎড়ঃযড়সধ, ২০১৫ ঢ় : ৩১). অবশ্য এ ধারার রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিএনপিকে বরাবরই সেনাছাউনি থেকে গঠিত রাজনৈতিক দল বলে গালমন্দ করছিলেন। বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের সে এক নিয়তি যে, জিয়া ও জিয়া পরিবারের হাতে বারবার গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সেনা রাজনীতিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নেতিবাচকভাবেই দেখা হয়। অথচ নিপাতনে সিদ্ধ ঘটনার মতো সেনাশাসক জিয়াউর রহমান একদলীয় শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেন। বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯০ সালে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করেন। এক-এগারোর ষড়যন্ত্র ও নীলনকশার পর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণতন্ত্রের সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে স্বৈরাচার পরাভূত হলেও বিগত ১৫ বছরে ক্রমেই সংগ্রামের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এর ভিত্তিটি স্থাপিত হয়। অবশেষে শহীদ জিয়াউর রহমানের যথার্থ উত্তরাধিকারী তারেক রহমানের দূরবর্তী, দূরদর্শী নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। প্রত্যাশিত গণতন্ত্রের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিরন্তর সে সংগ্রাম অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের মানুষ যে জিয়া পরিবারের প্রতি আস্থা ও ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে আছে বেগম খালেদা জিয়ার প্রত্যাবর্তনের পথে লাখো মানুষের উপস্থিতি তাই প্রমাণ করে।

শুধু গণতন্ত্রের জন্য নয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শোভন, সুন্দর ও সৌজন্যের অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। রাজনীতিতে আগমনের পর থেকে তিনি নিপীড়িত হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন; কিন্তু তিনি কারো প্রতি কটাক্ষ বা অসৌজন্যমূলক একটি কথাও উচ্চারণ করেননি। এরশাদ এবং তার পাণ্ডারা তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য নানা কথা বলেছে। কিন্তু তিনি নীরবতার মাধ্যমে তার প্রতিবাদ করেছেন। এ ক্ষেত্রে পলাতক স্বৈরাচার বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিত্ব শেখ হাসিনা সীমা লঙ্ঘন করেছেন। তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে তার বাড়ি থেকে এক কাপড়ে উৎখাত করেন। মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে কারারুদ্ধ করেন। এতিমের টাকা মেরে দেয়ার অভিযোগ তুলেছেন। অথচ এখন জাতি দেখতে পাচ্ছে- এক লাখ ৩৬ হাজার ৭১০ (বিভিন্ন অভিযোগের সর্বমোট) কোটি টাকা তারা লুট ও পাচার করেছে। তার বাপের সময়ে বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়েছিল। তার সময়ে সমৃদ্ধ ঝুড়ি আবার তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়েছে। গ্রাম্য প্রবাদ ‘সুচ বলে চালনিকে, তোর কত ফুটো!’ সেরকম আরকি।

বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার হিংসা-বিদ্বেষ, ক্ষোভ-ক্রোধ, নিপীড়ন-নির্যাতন তথা নিঃশেষ করার একমাত্র কারণ ছিল ক্ষমতা। বাংলাদেশে যেকোনো সাধারণ মানুষ বোঝে, জিয়া পরিবার হচ্ছে শেখ পরিবারের একমাত্র প্রতিদ্ব›দ্বী। তাদেরকে নিঃশেষ, নির্মূল করে দিতে পারলেই শেখ বংশের সিংহাসন চিরকালের জন্য নিরাপদ। শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়াকে নিঃশেষ করে দেয়ার প্রয়াস নিয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং নিঃশেষ করার জন্য হাত বাড়িয়েছিলেন তারেক রহমানের দিকে। এক-এগারোর সময় তারেক জিয়ার প্রতি যে নেতিবাচক ব্যবহার করা হয় তার পেছনেও ছিল আওয়ামী ঘরানার মদদ। ভাবতে অবাক লাগে, শেখ হাসিনা নিজে তার সন্তানতুল্য তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে যে ভাষায় কথা বলেছেন তা যেকোনো বিবেকবান মানুষকে হতভম্ব করবে। তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন, লন্ডন থেকে তারেক জিয়াকে নিয়ে এসে শাস্তি দেবেন। তিনি তাকে নিয়ে আসতে পারেননি; বরং তাকেই পালাতে হয়েছে। এটিই নিয়তির নির্মম পরিহাস।

অনেকেরই আশঙ্কা ছিল, বেগম খালেদা জিয়াকে তারা বাঁচতে দেবেন কি না! অনেকবার খবর হয়েছে- জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বেগম খালেদা জিয়া। আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি সুস্থ শরীরে দেশে ফিরেছেন। তার এই আগমন বাংলাদেশের মানুষের জন্য আশীর্বাদসম। তিনি দীর্ঘ ১৭ বছর অন্যায়-অত্যাচার ও জুলুমের শিকার হয়েছেন। তিনি একাধিকবার বলেছেন, তিনি প্রতিশোধের বা প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না। এমনকি গত ৮-৯ মাসে এমন কোনো উচ্চারণ তিনি করেননি, যা বিপরীত শক্তির জন্য বিব্রতকর হতে পারে। এখন দেশে এমন একটি সুন্দর রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যেখানে দল-মত নির্বিশেষে সবার কাছে নন্দিত নেত্রী হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলো তার প্রতি অপূর্ব সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস সশস্ত্রবাহিনী দিবসে সেনাকুঞ্জে তার প্রতি যে সম্মান ও সমীহ নিবেদন করেছেন তা গোটা জাতির মনোভাবের প্রতিফলন। স্মরণ করা যেতে পারে, প্রফেসর ইউনূসের ওপর যখন আওয়ামী খড়গের সূচনা ঘটে তখন বেগম খালেদা জিয়া শক্ত ভাষায় ওই নিগ্রহের নিন্দা করেছিলেন। বেগম খালেদা জিয়া আজ আর বিএনপির চেয়ারপারসনই নন, তিনি পুরো জাতির নেত্রী। এই মহীয়সী নারী গোটা জাতির আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছেন। রাজনীতির প্রয়োজনে তিনি আবার দেশের নেতৃত্ব নিতে পারেন, না-ও নিতে পারেন; কিন্তু তার যে স্থান জনমনে অর্জিত হয়েছে তা ম্লান হওয়ার নয়। তিনি হয়ে উঠুন বাংলাদেশের একজন নেলসন মেন্ডেলা বা ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির মতো কেউ। ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে সচেতন নাগরিকদের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে একটি সাংবিধানিক সর্বোচ্চ অবস্থান বা পদ দেয়ার প্রস্তাব করেছে। তিনি পুরো জাতির অভিভাবক ও মাতৃসম। আগামী সরকার তা বিএনপির হোক অথবা অন্য কারো হোক, খালেদা জিয়ার অভিভাবকত্বকে ইতিবাচক হিসেবে দেখবে। বাংলাদেশে যখন ভাবাদর্শের সঙ্ঘাত খুবই তীব্র, অতীতে অথবা বর্তমানে তিনি কখনোই জাতির মূল জীবনবোধ থেকে বিস্তৃত হননি। সব বিতর্ক সত্তে¡ও সবাইকে নিয়ে পথ চলার চেষ্টা করেছেন। ডান-বাম, উত্তর-দক্ষিণ সবদিকেই তিনি কুশলতার সাথে সমদূরত্ব বজায় রেখে গণতন্ত্রের পথপরিক্রমা পরিচালনা করেছেন।

আশা করা যায়, বেগম খালেদা জিয়ার এই প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের রাজনীতিতেও গুণগত পরিবর্তন ঘটাতে সহায়তা করবে। এমনিতেই আমরা একটি অস্থির সময় অতিক্রম করছি। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে জাতীয় ঐক্য সূচিত হয়েছিল তা আজ প্রশ্নসাপেক্ষ। এর সারথিরা নানাভাগে বিভক্ত। অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে ভাবাদর্শের উত্থান হয়েছে তা পুরনো ভাবধারার সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থার মোকাবেলা করছে। এই সঙ্ঘাতময় অবস্থায় খালেদা জিয়া প্রাসঙ্গিক এই কারণে যে, জিয়াউর রহমান সবসময়ই একটি মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ জাতিগোষ্ঠীর নাড়ির খবর রাখতেন। এই জাতির অনুভূতি উপলব্ধি তিনি ধারণ করতেন।

বেগম খালেদা জিয়ার দীর্ঘ সংগ্রামে তাকে ডানে কিংবা বামে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা ও প্রয়াস অনেকবার লক্ষ করা গেছে; কিন্তু তিনি বাংলাদেশী জাতিসত্তার আলোকে তার নীতি ও কর্মসূচি সাজিয়েছেন, যা এ জাতির ঐক্য ও সংহতিকে নিশ্চিত করেছে। জাতির এই সঙ্কটময় সময়ে সবচেয়ে প্রয়োজন যা তা হচ্ছে জাতীয় সমঝোতা (ঘধঃরড়হধষ ঈড়হংবহংঁং)। বেগম খালেদা জিয়ার অভিভাকত্ব, উপদেশনা ও নেতৃত্বে তা অর্জিত হবে বলেই কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস করে। সুতরাং সবার সম্মিলিত প্রার্থনা- বাংলাদেশ জাতির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে খালেদা জিয়া- ‘জিও হাজারো সাল’। হাজার বছর বেঁচে থাকো তুমি।

লেখক : অধ্যাপক (অব:), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়