সেদিন গিয়েছিলাম একটি ইসলামী ব্যাংকে যেটি একীভূত হওয়ার তালিকাভুক্ত ব্যাংক। নীরব পরিবেশ, কোনো কোনো কর্মকর্তা মোবাইলে কী যেন দেখছেন, মহিলা কর্মকর্তারা পারস্পরিক কথোপকথনে ব্যস্ত, নেই কোনো গ্রাহক, অফিস সহকারী একটি চেয়ারে ঝিমোচ্ছেন। কিছুদিন আগেও এখানে গ্রাহকের ভিড় ছিল। কেউ যেখানে অন্যান্য সেবা যেমন- বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল দিতে যেতেন, এখন তারাও যান না। কিছুক্ষণ পর যাও দুই-একজন আসেন তারা টাকা তুলতে আসেন। কর্মকর্তারা বললেন, এখন কেউ টাকা জমা দেন না। একীভূতকরণ খবরে গ্রাহকের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। আবার কেউ চিন্তা করছেন, তাদের জমা দেয়া টাকা ঠিক থাকবে কিনা। প্রশ্ন হলো- বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণের যে পদক্ষেপ নিয়েছে; তা কতটুকু সফল হবে। সেই সাথে এতে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা হবে কি? প্রকৃত বাস্তবতায় এটি নির্ভর করবে একীভূতকরণ প্রক্রিয়া কতটা সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হবে, ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যাবে কি না এবং আমানতকারীদের আস্থা কতটুকু ফেরানো যায়, তার ওপর। অবশ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং তাদের আমানত ফেরত দিতে কাজ করছে বলে জানা গেছে।
দুর্বল যে পাঁচটি মিলে বড় শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, সেখানে আইনি জটিলতাসহ কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে। এগুলোর সমাধান না এলে ঝুলে যেতে পারে একীভূতকরণের এ প্রক্রিয়া। ব্যাংকগুলোতে প্রশাসক নিয়োগ, আমানতকারী ও পুঁজিবাজারের ব্যাংকগুলোর শেয়ার ধারকদের বিষয়গুলো কিভাবে নিষ্পত্তি হবে, রাজনৈতিক সরকার আসার আগে একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শেষ করা যাবে কি না, সেসব প্রশ্ন সামনে রেখে আইনি সমাধান খুঁজতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অবসায়ন না হয়ে একীভূত হলে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, আমানতকারীদের পুরো অর্থ ফেরত দিতে হবে, এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে হবে সরকারকে।
অন্য দিকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসির নিয়ম অনুযায়ী, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ পুরো সংরক্ষণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, একীভূত হতে যাওয়া ব্যাংকগুলোতে বর্তমানে এক লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকার আমানত রয়েছে। বিপরীতে প্রদত্ত ঋণ ছাড়িয়েছে দুই লাখ কোটি টাকা। মোট আমানতের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (৪৬ হাজার কোটি টাকা) ব্যক্তি আমানতকারীদের। বাকিটা প্রাতিষ্ঠানিক আমানত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ব্যক্তি আমানতকারীদের ফেরত প্রদানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হবে। দুই লাখ টাকার মধ্যে আমানত থাকলে তা বীমার আওতায় দ্রুত ফেরত দেয়া হবে। দুই লাখ টাকার বেশি হলে ধাপে ধাপে ফেরত দেয়া হবে। তবে এর সময়সীমা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
একীভূতকরণের সময়ে আমানতকারীরা ৪ শতাংশ হারে রিটার্ন পেতে পারেন, তবে বিদ্যমান সব আমানত স্কিম বাতিল হয়ে যাবে। একজন আমানতকারীর একাধিক ব্যাংকে হিসাব থাকলেও তা একটি হিসাবে গণনা করা হবে এবং সর্বোচ্চ বীমা সীমা দুই লাখ টাকার মধ্যে থাকবে।
অন্যদিকে, প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীরা নগদ অর্থের পরিবর্তে নতুন ব্যাংকের শেয়ার পেতে পারেন। তবে ঋণগ্রহীতাদের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হবে না। কিস্তি নিয়মমতো পরিশোধ করতে হবে, আর খেলাপি হলে আগের নিয়মে শাস্তি কার্যকর হবে।
মূলধন সহায়তা ও নতুন ব্যাংকের কাঠামো
পাঁচ ব্যাংক একীভূত হওয়ার পর নতুন ব্যাংকের সম্পদ দাঁড়াবে প্রায় দুই লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা দেবে সরকার, ১০ হাজার কোটি টাকা আসবে ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স ফান্ড থেকে এবং পাঁচ হাজার কোটি টাকা আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা যেমন- আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকে পাওয়া যাবে। ইতঃপূর্বে সবার যা জানা, তা হলো- একীভূত হতে যাওয়া ব্যাংকগুলো হলো- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। এর মধ্যে চারটি দীর্ঘদিন ধরে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। প্রস্তাবিত পাঁচটি ব্যাংক বর্তমানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত। যতদূর জানা গেছে, একীভূত হওয়ার পর এগুলো ডিলিস্ট করা হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা আছে- অবসায়ন বা একীভূতকরণের ক্ষেত্রে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী নন। যদিও অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্ষতিপূরণের বিষয়ে ভাবছে। তবে বাজারে ইতোমধ্যে বড় ধস দেখা গেছে। পাঁচ ব্যাংকের শেয়ারের দাম ১০ টাকার ফেস ভ্যালুর বিপরীতে পাঁচ টাকার নিচে নেমে গেছে। ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে পাবলিক শেয়ারহোল্ডিং ছিল ৬৫ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ৩১.৪৬ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ১৮ শতাংশ, এক্সিম ব্যাংকে ৩৯.২৮ শতাংশ এবং ইউনিয়ন ব্যাংকে ৩১ শতাংশ। এ ধস গোটা ব্যাংক খাতের বিনিয়োগকারীদের মনোভাবেও প্রভাব ফেলতে পারে। বর্তমানে তালিকাভুক্ত ৩৬টির মধ্যে ডজনখানেক ব্যাংকের শেয়ার ১০ টাকা ফেস ভ্যালুর উপরে লেনদেন হচ্ছে।
এদিকে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে রেজ্যুলুশন বিষয়ে পরামর্শ দিতে নতুন পদক্ষেপ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া অবসায়ন বা একীভূতকরণের তালিকাভুক্ত ব্যাংককে যেকোনো আদেশ-নির্দেশ দিতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যাংক পরিপালন করতে বাধ্য। এমন সব বিধান রেখে অকার্যকর ব্যাংক অবসায়ন বা একীভূতকরণের লক্ষ্যে একটি নতুন নীতিমালা তৈরি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইতোমধ্যে নীতিমালার খসড়া তৈরি শেষ। এটি অচিরে চূড়ান্ত করে সার্কুলার আকারে জারি করা হবে।
খসড়ায় আরো বলা হয়- ইসলামী ব্যাংকগুলোকে রেজ্যুলুশন বিষয়ে পরামর্শ দিতে নিজস্ব শরিয়াহ বোর্ড গঠন করতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আলোচিত নীতিমালার আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাংক রেজ্যুলুশন অধ্যাদেশের আওতায় যেকোনো সময় যেকোনো বিধিবিধান যুক্ত করতে পারবে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে আরো জানা যায়, নীতিমালাটি এমনভাবে প্রণয়ন করা হচ্ছে যাতে যেকোনো ব্যাংক এটির সাথে নিজেদের আর্থিক অবস্থার তুলনা করলে বুঝতে পারবে কখন কোন স্তরে পৌঁছাবে। ব্যাংকটি কিভাবে তদারকি করা হবে। ব্যাংকগুলো যদি আগে থেকে নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে বুঝতে পেরে আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারে, তবে নিজেদের অবনতি রোধ করতে পারবে। সে লক্ষ্যে ব্যাংক রেজ্যুলুশন অধ্যাদেশ জারি হয়েছে। পাশাপাশি এর আওতায় নতুন নীতিমালা করা হচ্ছে।
এখানে একটি বিষয় খেয়াল রাখা উচিত, তা হলো- যে উদ্দেশ্যে একীভূত হচ্ছে অর্থাৎ আর্থিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি, দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূত করে একটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল ব্যাংক তৈরি করা, যা সামগ্রিক ব্যাংক খাতের জন্য ভালো।
মূলধন ও সম্পদ যেন ধাপে ধাপে বাড়ে
একীভূতকরণে নতুন ব্যাংকটির মূলধন, সম্পদ এবং আমানতের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে। দেখতে হবে আমানতকারীরা তাদের আমানত ফেরত পাবেন কি না এবং তাদের আস্থা ফিরে আসবে কি না। আস্থা ফিরিয়ে আনার উপর নির্ভর করছে একীভূতকরণের সফলতা। এছাড়া ব্যাংক খাতে দীর্ঘদিন ধরে খেলাপি ঋণের প্রকোপ, রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ বিতরণ, দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো ও মালিকানার দ্ব›দ্ব মিলিয়ে দেশের আর্থিক খাত এক ধরনের আস্থাহীনতায় ভুগছে। এ আস্থাহীনতা কাটিয়ে ওঠাসহ পাঁচটি ইসলামী ব্যাংককে একীভূতকরণের উদ্যোগ আমানত-কারীদের মধ্যে কতটুকু আস্থা ফিরে আসবে তা দেখার বিষয়। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, একীভূতকরণের মাধ্যমে ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলে আমানতকারীদের সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত দিতে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। তবে, এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, যেমন- আমানতকারীদের আস্থার অভাব, কর্মীদের চাকরি হারানো এবং শাখা বন্ধ হওয়ার মতো বিষয়গুলো আমানতকারীদের অসন্তুষ্টি সৃষ্টি করতে পারে। সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ এমন হওয়া উচিত, যেন আমানতকারীদের আস্থা ফিরে আসে এবং ব্যাংকগুলো যেন সফলতার মুখ দেখতে পায়। সর্বোপরি, দেশের সম্পদের সুরক্ষার, দুর্নীতি দূরীকরণ এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমে ব্যাংক খাতের দীর্ঘদিনের ক্ষত দূর হোক, এটি সবার প্রত্যাশা।
লেখক : ব্যাংকার