জাতি-জনতা যাকে খুঁজছে

অতীত বারবার এ কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চায়, রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সর্বত্র কারো কোনো একান্ত বলয় গড়ে তোলা কখনোই সমীচীন নয়। বলয় তৈরি এক অর্থে বৃহত্তর লোকসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া। তখন কারো ডাক শুনে কেউ পাশে আসবে না। দেশের রাজনীতিতে এমন এক গণবিচ্ছিন্নতার প্রচ্ছন্ন আলামত যেন স্পষ্ট ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হয়ে উঠছে।

অবিভক্ত ভারতে হাতেগোনা দুই-তিনজন রাজনৈতিক নেতার অন্যতমের মাঝে অনন্য একজনের কাছে কখনো কোনো বিষয় নিয়ে মতামত জানতে চাইলে বা ঘটে যাওয়া ঘটনার সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে, তিনি কখনো তাৎক্ষণিকভাবে মতামত বা প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকৃতি জানাতেন। তিনি মুহূর্তকাল নীরব থেকে প্রশ্নকারীকে বলতেন, অপেক্ষা করো। আমাকে একটু ভেবে নিতে দাও। ইতিহাসের ঠাসা বুননে এমন বহু গল্প আছে। ধৈর্য ধারণের এমন স্থির চিত্তের ব্যক্তিদের প্রো-অ্যাকটিভ রাজনীতিক হিসেবে ধরে নেয়া হয়। হয়তো এ কারণে তারা কোনো ঘটনা বা বিষয়ে মত দেয়া নিয়ে বিরতি নিতেন। বিষয়গুলো নিয়ে তাৎক্ষণিক মতামত দেয়া হলে পূর্বাপর ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, এ নিয়ে হিসাব কষতে সময় নিতেন। যাতে ভবিষ্যতে তার মত নিয়ে কোনো বিতর্কের সূচনা বা সমস্যা তৈরি না হয়।

এমন ব্যক্তিত্বদের রাজনীতিক না বলে বলতে হবে রাষ্ট্রনায়ক বা ‘স্টেটম্যান’। সব দেশে এমন ক্ষণজন্মা ব্যক্তিরা জাতি ও দেশের কাছে ‘মেন্টর’ হয়ে থাকেন। সময়ের বাঁকে বাঁকে তারা ইতিহাস তৈরি করেন। আবার ইতিহাসের বাঁক-বদল করতেও সহজে সক্ষম হন। এমন রাষ্ট্রনায়ক জাতির বাতিঘর হয়ে থাকেন। অতীতের দিকে কখনো ফ্লাস করতেন ও ভবিষ্যতের পথনকশায় আলো ছড়াতেন।

যাই হোক, এ সূচনার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন। এর সহজ উত্তর হচ্ছে, যার যা নেই বা থাকে না, তিনি তা কামনা করতে পারেন। এই জল-জলাঙ্গিক দেশে এখন কেউ যদি একজন ‘মেন্টর’ খুঁজতে চান তাতে দোষের কী আছে। এসব মেন্টর বা বৃন্দ এক দিনে এমন অবস্থানে এসে পৌঁছেননি। অধ্যয়ন-অনুধাবন, অনুশীলন ও অভিজ্ঞতা তাদের এখানে নিয়ে এসেছে। ধৈর্য তাদের অলঙ্কার, জ্ঞান তাদের বর্ম, ইতিবাচক বা নেতিবাচক কথা শোনা ছিল তাদের কাছে মাটিতে কান পেতে কালের কণ্ঠ ধ্বনী শ্রবণের মতো। এমন সব মেন্টরের একমাত্র স্বপ্ন সাধন, যে লোকসমাজে তার জন্ম ও বসবাস সেই সমাজের প্রত্যেক মানুষের মুখোমণ্ডল হাস্যোজ্জ্বল করে তোলা। তাদের মনে ন্যূনতম কোনো অভিলাষ থাকে না। থাকে না নিজস্ব কোনো এজেন্ডা। তারা জীবনের অর্থ ও জীবনের ব্যাপ্তি সম্পর্কে পুরো ওয়াকিবহাল থাকতেন। এর অর্থ নিছক কোনো পিছুটান নয়, জীবন শেষে কিছু সাথে নিয়ে যাওয়া যায় না। কেননা শুভ্র কাফনের কোনো পকেট থাকে না। ৬ (ছয়) ফুট আর আড়াই ফুট জমি তার শেষ ঠিকানা। অথচ আজ রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা যায়, জমিজিরাত পেতে কত না বাহানা। দুই ১০ জন নন, মাত্র একজন ‘মেন্টর’ এখন খুঁজে পাওয়া যাবে বলে কেউ মনে করেন না। জাতি এখন শোক দুঃখ বেদনায় নিমজ্জিত। বলতে গেলে জনগণ এখন মুহ্যমান।

এ বদ্বীপে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কত বাগাড়ম্বর ও বাকপটুতা বা বাক-চটুলতা ও অসার যত গল্প সবার জন্য তিক্ত এক অভিজ্ঞতা। অন্তঃসারশূন্য সব বক্তব্য দিয়ে দেশকে ভাসিয়ে নেয়া হচ্ছে এক ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে। তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বোদ্ধাসমাজ গভীর হাতাশায় ভুগছে, আবার না সব ওলট-পালট হয়ে যায়। তাতে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা স্থিতিশীলতা কতটা বিঘœ হতে পারে, আবার কত শত অমূল্য জীবন একেবারে মূল্যহীন হয়ে যেতে পারে; সে ভাবনা সবার মন মস্তিষ্কে আছে বলে অনেকে মনে করেন না। মাত্র কিছুকাল আগে পতিতজনরা ভাবতেন, এ ভূখণ্ড যেন তাদের জন্ম-জন্মান্তরের তালুকদারি। এখানে তাদের কথাই সবার জন্য শেষ কথা। তাদের সব চাওয়া পূরণ করতে প্রয়োজন হলে আসমান থেকে তা নামিয়ে আনতে হবে। ধরাকে সরা জ্ঞান করে তাদের খামখেয়ালির কোনো শেষ ছিল না। নিকট অতীতে এরা সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়ে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে লুটে পুটে খেয়েছেন। অথচ নীতিবাক্য হচ্ছে, যে দিন যায় ভালো যায়, আগামী দিনের খবর কেউ-ই জানেন না। পরের দিন তাদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে মানুষের ধৈর্যের সীমানা যে অতিক্রম করবে- এমনটি তাদের কল্পনাও ছিল না। সেই দিন নিষ্পেষিত সব মানুষ তাদের মুখ খুলেছিলেন, মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে রাস্তায় নেমেছিলেন। গণবিস্ফোরণে পতিতদের তালুকদারি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল। সেই তালুকদারি আবারো ফিরে পেতে, জমানো অর্থকড়ি সোনাদানা তারা ব্যয় করছেন। অনেকে সোনাদানা নজরানা পেতে হাত বাড়িয়ে বসে আছেন। তাদের ফিরিয়ে আনতে গলদঘর্ম হচ্ছেন। অথচ তারাও জানেন না কাল সকালে কোথায় কী হবে।

এ শতাব্দীর প্রথম অধ্যায়ের শেষপাদে যে জেন জির জন্ম প্রথমে সেই জেন জিদের গণবিস্ফোরণ ঘটেছিল শ্রীলঙ্কায়, তারপর ঢাকায়, এখন সে বিস্ফোরণ চলছে নেপালে পাহাড়ি উপত্যকায়। তিন দেশের জেন জির এমন গণবিস্ফোরণ দেখে উপমহাদেশের কথিত মোড়লদের এসব দেখেশুনে শিক্ষা নিতে হবে। বুঝতে হবে তাদের এমন মোড়লিপনা এখন কেউ আর সহ্য করছেন না। এ উপমহাদেশে জেন জির যে উত্থান তাকে বুঝতে হবে। মূল্যায়ন করতে হবে।

এসব উত্থানের পেছনে নিছক কোনো একটি ইস্যু কাজ করেনি। এই জেগে ওঠার পেছনে নানা তত্ত¡ ও তথ্য আছে। ব্যঞ্জনা আর বৈষম্যের দীর্ঘ এক ইতিহাস আছে, ক্ষোভ আছে, দুঃখ আছে। ভূমিপুত্রদের অতীতে কখনোই চাওয়া-পাওয়ার মূল্যায়ন করা হয়নি। নিজেদের এমন অবমূল্যায়নকে তরুণরা কখনো নিয়তি বলে মনে করেনি। তাদের মনোজগতে ঝড় তুলেছিল তাদের ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতি যে বঞ্চনা-বৈষম্য এবং বিমাতাসুলভ আচরণ।

স্রোতস্বিনী নদীতে যেমন কোনো বাঁধ টিকে না তেমনি সর্বত্র তরুণদের আজকে এ গণজোয়ার অতীতেও কখনো রোধ করা যায়নি, বর্তমান- ভবিষ্যতেও কারো পক্ষে রোধ করা সম্ভব হবে না। এখানে একটা বিষয় বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য, পতিতজনরা পালিয়ে গিয়ে এখন আবার ফিরে আসার দিবাস্বপ্ন দেখছেন। তাদের সে দিবাস্বপ্ন নিয়ে এ দেশের সবার আদ্যোপান্ত ভেবে দেখা দরকার। পুনরায় এমন ক্ষতি কোলে তুলে নিলে, পরিণাম কী হবে। তখন জেন জি’রা কি কাউকে ছেড়ে কথা বলবে, না কাউকে রেহাই দেবে। পতিতদের নিজের অতীত ও বর্তমানের কর্মকাণ্ড নিয়ে স্থির মস্তিষ্কে সবার এখন ভাবা দরকার। যে কাব্য কেবল কল্পনা দিয়ে গড়া, সে কাব্যাসরে যোগ দেয়ার কোনো মানে হয় না।

যে নদীর পানি একবার যখন সমুদ্রে গড়ায়, তা কি আর কখনো ফিরতে পারে। এতকাল কেবল চাটুকারদের বেষ্টনীর মধ্যে ছিল পতিতদের বসবাস। সেখানে বাস্তবতার স্পর্শ ছিল না। আকাশকুসুম গল্প ছিল, মরীচিকা নিয়ে যেমন, এই দেখিলাম সোনার ছবি আবার দেখি নাইরে। বাস্তবে এখন এ ভূ-ভাগের কার কোথায় অবস্থান! মাত্র এক বছরে ঘটেছে, উত্তর আর দক্ষিণ মেরুর মতো ঘটেছে বিরাট ব্যবধান। ‘এই বাংলাদেশকে’ এখন নতুন করে আবিষ্কার করতে হবে। শুধু দিল্লিতে বসে খোয়াব দেখলে কেল্লা ফতেহ হবে না। যে দিন যায়, তা আর কি কোনোদিন ফিরে আসে। বাংলাদেশের আপামর জনগণকে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে যেভাবে শোষণ-নির্যাতন পতিতজনরা করে গেছে। দিল্লিতে পালিয়ে যাওয়ার আগে মুহূর্তকাল আগে এসব নিয়ে কখনো কি তারা উত্তরণের কোনো পথনকশা তৈরি করেছেন। গতকাল বিশ্ব যেখানে ছিল, আজ ঠিক সেখানে নেই।

সতত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে চলতে পেরেছে কি দেশ? আপনারা যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে ফিরতে চান। আপনাদের ফেরানোর কোনো আয়োজন বা এজেন্ডা তাদের কি তাদের আছে? কেবল তাদের স্বার্থে আপনাদের সামনে রেখে নিজেরা ফিরতে চান। আপনাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেতে চায় আপনাদের আশ্রয়দাতারা। আপনারা ১৫ বছর কেবল দেশের মানুষকে ঠকিয়ে নিজেদের ‘অকৃত্রিম’ সুহৃদদের যে সেবা দিয়ে হৃষ্টপুষ্ট করেছেন; কখনো দিল্লি সেটি ভুলবে না, সে বাক্যালাপ পতিত নেত্রী গর্ব করে বলেছেন। প্রশ্ন হলো কার জিনিস তিনি কাকে দিয়েছেন, অনুমতি কার কাছ থেকে নিয়েছেন। দেশটা কখনো কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় যে, যাকে ইচ্ছামতো তাকে ইজারা দিতে পারেন। ফিরে আসার কল্পনা করার আগে চোরতন্ত্র, পাচারতন্ত্রসহ আরো সব তন্ত্র-মন্ত্রের হিসাব নথিপত্র সাথে নিয়ে আসার কথা ভুলবেন না। জনগণ সবকিছু পরখ করে দেখবে। সত্য-মিথ্যার নিক্তিতে তুলবে। তরুণরা এখনো ঘুমিয়ে যায়নি। এমন কথা স্মরণে রাখবেন।

যে কথা বলে এখন নিবন্ধের পরিসমাপ্তি করতে চাই- সেটি সবার জন্য সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কোনো ব্যক্তি বা দল কিংবা দলগোষ্ঠী কোনো দেশ-জাতি ও জনতার কাছে অত্যাবশ্যকীয়, অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে। যখন দেশ-জাতি-জনতার কাছে সে আস্থাশীল হয়ে ওঠে। সেটিই সবার জন্য কাক্সিক্ষত সার্থকতা। সেখানে পৌঁছার পথ হচ্ছে- ধৈর্য সহনশীলতা সহমর্মিতা, নয় কোনো দোদুল্যমানতা বাকসর্বস্বতার চাষাবাদ করা। দেশ-জনতার পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দেয়া। নিজেদের পছন্দকে জাতি-জনতার ঘাড়ে চাপানোর যেকোনো মানসিকতা দূরে ঠেলে দিতে হবে। জনতার পছন্দকে আপন করে নিতে হবে। অতীত বারবার এ কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চায়, রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সর্বত্র কারো কোনো একান্ত বলয় গড়ে তোলা কখনোই সমীচীন নয়। বলয় তৈরি এক অর্থে বৃহত্তর লোকসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া। তখন কারো ডাক শুনে কেউ পাশে আসবে না। দেশের রাজনীতিতে এমন এক গণবিচ্ছিন্নতার প্রচ্ছন্ন আলামত যেন স্পষ্ট ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হয়ে উঠছে।