গানম্যান মানে গানের মানুষ নয়, অস্ত্রধারী। সাম্প্রতিক উচ্চারিত ও ব্যাপক আলোচিত গানম্যান বলতে সরকারি বৈধ অস্ত্রধারী বোঝানো হয়। নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকলে রাষ্ট্রের কাছে গানম্যান চাওয়ার ব্যবস্থা আছে। পাওয়ার বিধান আছে, না পাওয়ার গ্রাউন্ডও রয়েছে। দুর্বৃত্তের গুলিতে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর পর নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক নেতা এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে ‘গানম্যান’ প্রসঙ্গ। নিরাপত্তা ঝুঁকি আমলে নিয়ে রাজনৈতিক নেতা, নির্বাচনের প্রার্থী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একটি তালিকা তৈরি করেছে সরকার। এ ছাড়া নিজের নিরাপত্তা চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদনও করেছেন অনেকে। সংখ্যাটি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কেউ চেয়েছেন গানম্যান, আবার কারো চাহিদা ব্যক্তিগত অস্ত্রের লাইসেন্স। এসব আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে ২০-২২ জনকে গানম্যান দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাদের মধ্যে দৈনিক প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদকসহ নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা জুলাই আন্দোলনের সম্মুখসারির নেতারা অন্যতম।
রাষ্ট্রের সব নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের, এ বিষয়টি সংবিধানেই উল্লেখ আছে। কিন্তু কোনো ব্যক্তিকে নিরাপত্তা দিতে হবে সেটি সংবিধানের আলোকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেয়। এ ছাড়া নিজস্ব বেতনভুক্ত লোক দিয়েও গানম্যানের কাজ করান অনেকে। এ ক্ষেত্রে ওই গানম্যানের নিজের নামে অস্ত্রের লাইসেন্স থাকতে হবে অথবা নিয়োগকর্তার অস্ত্রের লাইসেন্সে তাকে ‘রিটেইনার’ বা ব্যবহারকারী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া সরকার অনুমোদিত বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানিগুলো থেকেও নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে গানম্যান নেয়া যায়। তবে এ ক্ষেত্রেও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বিশেষ অনুমতি লাগে। একজন ব্যক্তি পুলিশের কাছে নানাভাবে নিরাপত্তা চাইতে পারেন। তবে ব্যক্তি নিরাপত্তার জন্য গানম্যান বা বডিগার্ড নিয়োগের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশে গানম্যান ও বডিগার্ড পাওয়ার বিষয়টি মূলত ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং রাষ্ট্রীয় প্রটোকল- এ দু’টি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এটি কোনো ঢালাও অধিকার নয়; বরং সরকারের বিশেষ বিবেচনায় অনুমোদিত একটি ব্যবস্থা। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চাইলে যে কাউকে তার বিশেষ ঝুঁকি বিবেচনা করে গানম্যান বরাদ্দ দিতে পারে। অনেক সময় রাজনৈতিক ঝুঁকি বা গুরুত্বপূর্ণ মামলার সাক্ষী হওয়ার কারণেও সরকার নিজ উদ্যোগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গানম্যান দিয়ে থাকে। বরাবরই নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রাসঙ্গিক বিষয়। এবার আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। নির্বাচনের আগে সচরাচর এমন সময়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। বৈধ অস্ত্রও সরকারের হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। এ বাস্তবতায় রাজনৈতিক নেতা বা বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য গানম্যান নিয়োগের বিষয়টি হট কেক আলোচনায়। গানম্যান নিয়োগ কিংবা ব্যক্তিগত অস্ত্রের লাইসেন্স, নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করবে কি না- এমন প্রশ্ন ঘুরছে। মোটকথা তা হিতে বিপরীত ডেকে আনে কি না, প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
নির্বাচনী এ উত্তেজনাকর সময় সরকারিভাবে কত জনকে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হবে- এ প্রশ্ন তো আছেই। তাই সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। রাজনীতিবিদ, মানবাধিকারকর্মী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক না হলে একজন গানম্যান দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সেই উপলব্ধিতে নিজের ওপর হামলার বিচার না হওয়া পর্যন্ত সরকারের গানম্যান নেয়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি না হলে গানম্যানকেও থাকতে হবে নিরাপত্তাহীনতায়। কারো ওপর আঘাত আসবে না বা আঘাত করলে অপরাধীর বিচার হবে, তা নিশ্চিত হলে আলাদা বা বিশেষ গানম্যানই দরকার হয় না। নির্বাচনের আগে নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যক্তির জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা অযৌক্তিক নয়, তবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় কতজনকে এর আওতায় আনা হবে এটি বিবেচ্য। এর নিষ্পত্তি না হলে জনে জনে গানম্যান চাওয়ার তালিকা দীর্ঘ হতে থাকবে। তখন বাস্তব নানা কারণে তথাকথিত হিরো আলমও চাইতে পারেন। চেয়েছেনও। আসন্ন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেয়ার ঘোষণার পর থেকে তিনি হত্যার হুমকি পাচ্ছেন বলে দাবি করেছেন। এতে তিনি ও তার পরিবার চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এমন নিরাপত্তাহীনতায় আরো অনেকে। নির্বাচন ও গণভোট সুষ্ঠু করার পথে অবৈধ অস্ত্র, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার, গুজব ছড়ানো, চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ঢালাও জামিন, সীমান্তে নিরাপত্তার দুর্বলতাসহ নানা চ্যালেঞ্জ ও আশঙ্কার কথা তুলে ধরেছেন প্রশাসন ও পুলিশের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারাও। রিটার্নিং কর্মকর্তা ও মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাথে নির্বাচন কমিশনের মতবিনিময় ও ব্রিফিংয়ে এসব চ্যালেঞ্জের কথা উঠে আসে।
গত বছরের আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের সময় পাঁচ হাজার ৭৫৩টি অস্ত্র লুট হয়। প্রায় সাড়ে চার হাজার অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। এখনো এক হাজারের বেশি অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। এর বাইরেও সন্ত্রাসীদের হাতে আছে অবৈধ অস্ত্র। এবারের নির্বাচনে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা বড় আকারে সামনে এসেছে।
পুলিশের খোয়া যাওয়া অস্ত্র উদ্ধারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হলেও ফলাফল কাক্সিক্ষত মাত্রায় নয়। সূত্র মতে, ৪৫৫টি পিস্তল এখনো বাইরে। ভারী অস্ত্রও আছে। এসব উদ্ধারে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তার ওপর অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টায় যথাযথ সহায়তা মিলছে না। অপরাধীদের ধরতে গেলে নানা তদবির আসে। দিনের বেলায় যারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেন, রাতের বেলা তারা তদবির করেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এসব সমস্যার তথ্য জানানো হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। তিনি তাদের বলেছেন, সাহস নিয়ে কাজ করতে। পরিস্থিতিতে যারপরনাই সাহস দেখিয়ে ফলাফল কতটা আসবে বা আসতে পারে, তা পুলিশ ভালোমতোই জানে। যারা গানম্যান কখনো নেননি বা জীবনে কখনো নেবেনও না, তারাও ভালো করে জানেন, গানম্যান কি সত্যিই নিরাপত্তা নিশ্চিত করে? তা নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দেবে কি না এ প্রশ্ন তো আছেই। কে না বুঝে বা জানে, নির্বাচনের সময় সবাইকে আলাদা করে গানম্যান দেয়া সম্ভব নয়। তাহলে সরকার আর পুলিশের বাকি কাজ পড়ে থাকবে। গানম্যান দিয়ে জনাকতেককে একটু ভাবে রাখা যাবে, তা বাকি সবার নিরাপত্তা ও সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শক্তিশালী করবে না। আর গানম্যান থাকলেই যে হামলা ঠেকানো যাবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়?
গানম্যান নিয়ে ভাবসাবে ঘোরার হাস্যকর ঘটনাও এ দেশে আছে। একবার নিরাপত্তার জন্য জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদকে গানম্যান দিয়েছিল ততকালীন সরকার। হুমায়ূন আহমেদ সেই গানম্যানকে বসিয়ে রাখতেন। বাইরে কোথাও তাকে সাথে নিয়ে যেতেন না। গানম্যান তখন অস্ত্রটি পাশে রেখে গুণগুণ করে গান গাইতেন। ওই অবস্থা দেখে হুমায়ূন আহমেদ তখন তাকে দিয়ে বাজার করাতেন। গৃহস্থালির কাজ করাতেন। কচুর লতিও কাটাতেন। একবার সেই গানম্যান না কি হুমায়ূন আহমেদকে বলেছিলেন, স্যার আজ আমার একটা পরীক্ষা ছিল, নিশানা টেস্ট। গত কিছু দিনে আমার হাতের টিপ ঠিক থাকে না। টেস্টে তো আমি ডাহা ফেল।
রাজনীতিকদের মধ্যে গানম্যান সাথে নিয়ে ঘোরাফেরায় আভিজাত্য দেখানোর অনেক ঘটনা রয়েছে। ওই গানম্যানরা যত না নিরাপত্তার, তার চেয়ে বেশি ভাবভঙ্গি ও শোভা বর্ধনের কাজে ব্যবহৃত হন। এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করা রাজনীতিবিদদের মধ্যে সত্যি সত্যি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছেন অনেকে। তাদের কেউ চেয়েছেন পুলিশের একটি দল তাকে নিরাপত্তা দিক। কেউ চেয়েছেন অস্ত্রধারী দেহরক্ষী বা গানম্যান। কেউ চেয়েছেন আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স। কেউ কেউ নিরাপত্তা ও অস্ত্রের লাইসেন্স একই সাথে চেয়েছেন।
১৪ ডিসেম্বর ‘রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও জাতীয় সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীদের অনুকূলে আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স ও রিটেইনার নিয়োগ নীতিমালা-২০২৫’ জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের জন্য আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ও সশস্ত্র রক্ষী নিয়োগে এই নীতিমালা করা হয়। এর পর থেকেই আবেদনের হিড়িক পড়তে থাকে।
ঢালাওভাবে অস্ত্রের লাইসেন্স দিলে অপব্যবহার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের ঘটনার সাথেও এ দেশের মানুষ পরিচিত। নিরাপত্তা কখনোই কেবল অস্ত্রের মাধ্যমে অর্জিত হয় না। নিরাপত্তা আসে বিশ্বাসযোগ্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, পেশাদার পুলিশি ব্যবস্থা, রাজনৈতিক সহনশীলতা ও আইনের শাসন থেকে। নেতাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া রাষ্ট্রের সক্ষমতার প্রমাণ নয়; বরং এটি এক ধরনের স্বীকারোক্তি যে, রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে না পেরে নাগকিদের হাতেই অস্ত্র তুলে দিচ্ছে। অস্ত্র তো অস্ত্রই। আর অস্ত্র মানেই ভয়ঙ্কর। যা মানুষের ভয়কে আরো বাড়াচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট



