নির্বাচনের তোড়জোড়

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। যে কারণে ছাত্রদের ক্ষমতা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি। ছাত্ররা প্রভাবিত করতে পারেন রাজনীতিকে। এর প্রভাব আগে যেভাবে রাজনীতিতে পড়ত, তার চেয়ে এখন অনেক বেশি পড়বে।

রিন্টু আনোয়ার
রিন্টু আনোয়ার |নয়া দিগন্ত গ্রাফিক্স

কেবল তারিখ ঘোষণা ছাড়া নির্বাচনের যাবতীয় আয়োজন শেষ প্রায়। ভোট হবে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে। এ রকম একটি অবস্থায়ও মাঠেঘাটে প্রশ্নের তীর, নির্বাচন আসলে হবে তো? তবু এমন প্রশ্ন আসছে কেন? নিশ্চয় খামাখা নয়। কিছু প্রেক্ষিত ও নমুনা আছে বৈকি। তা হলো সংশয়, অবিশ্বাস ও অনাস্থা।

মাঠের চিত্রেও কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে, যা মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলছে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির উচ্ছ্বাসের সাথে অন্য দলগুলোর ব্যতিক্রম লক্ষণীয়। জামায়াত-এনসিপিসহ কয়েকটি দল প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ‘যদি-কিন্তু-তবে’ দিয়ে কিছু বাড়তি কথা যোগ করছে। সংস্কার, বিচার, পিআর, জুলাই সনদ ইত্যাদি নিয়ে কিছু বাড়তি কথা রয়েছে। তবে নির্বাচনে যাবে না, এ ধরনের কথা বলেনি। বাড়তি ও আকস্মিক একটি কথা প্রকাশ ঘটিয়েছেন স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূস। তিনি করেছেন সতর্ক। বলেছেন, কেউ যদি নির্বাচনের বিকল্প ভাবে তবে, দেশ ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। মেসেজ ও সতর্কতা হিসেবে এটি তাৎপর্যপূর্ণ। প্রশ্ন হিসেবে সামনে এসেছে- নির্বাচনের বিকল্প ভাবনা এলো কোত্থেকে? কারা ভাবছে বিকল্প? প্রধান উপদেষ্টা এমনি এমনি সতর্কতার কথা বলবেন না, এটি নিশ্চিত।

তাকে কেন জানাতে হলো নির্বাচনের বিকল্প নিয়ে ভাবলে তা হবে জাতির জন্য গভীর বিপজ্জনক। তাও বলেছেন, সময় ও জায়গামতো। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠকে এ কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। বৈঠক শেষে তার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের ব্রিফিংয়ে জানানো হয় তার এ মন্তব্য ও উপলব্ধির কথা। প্রেস সচিব বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যে সময় ঘোষণা করেন, নির্বাচন যথাসময়ে হবে। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হবে। সব রাজনৈতিক দলকে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন নিয়ে আবারো তার প্রতিশ্রুতি জানিয়েছেন। নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তবে, নির্বাচনের বিকল্প গেল আমলেও খোঁজা হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার বারবার দরকার, গণতন্ত্র বা নির্বাচনের চেয়ে উন্নয়ন জরুরি- এমন বার্তার মাধ্যমে টোকা দেয়া হয়েছে। এত টাকা খরচ করে নির্বাচনের কী দরকার? ক্ষমতায় তো শেখ হাসিনা থাকবেন- এমন হাইপ তোলার চেষ্টাও চলে।

অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম দায়িত্বের মধ্যে নির্বাচন ছাড়াও রয়েছে সংস্কার, বিচার, জুলাই সনদ। এর মধ্যে প্রধান দায়িত্বের মধ্যে চলে এসেছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া। দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে-কিন্তু-যদি যোগ করলেও জামায়াতে ইসলামী; বরং প্রস্তুতিতে বেশি এগিয়ে। ৩০০ আসনে সবার আগে প্রার্থী ঠিক করেছে দলটি। দিয়েছে কিছু ঘোষণাও। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব-পিআর, ‘জুলাই সনদ’-এর সাংবিধানিকীকরণ এবং গণপরিষদ নিয়ে শর্তও আছে।

দেশের রাজনৈতিক দলগুলোয় দু’টি প্রধান ধারা স্পষ্ট। এক দিকে বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি দল। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত সময়সীমা অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন-প্রত্যাশী। জামায়াত-এনসিপির বন্ধনও খোলাসা। এ পরিস্থতিতে দেশকে একটি সুন্দর নির্বাচন দেয়ার প্রত্যয় প্রধান উপদেষ্টার। বারবার বলছেন, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে ওয়ান অব দ্য বেস্ট ইলেকশন হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাসির উদ্দীনের আশা, একটি চমৎকার নির্বাচন দিয়ে জীবনের শেষ কাজটি করার। টানা তিন মেয়াদে শেখ হাসিনার নির্বাচনী তামাশায় মানুষ ত্যক্তবিরক্ত। এখন একটি সম্ভাব্য সুন্দর নির্বাচনের প্রাক্কালে এসে বেশি কচলানি প্রত্যাশিত নয়।

সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ইসির কর্মযজ্ঞের খবর মানুষ নিয়মিত দেখছে। প্রশাসনকেও সাজানো হচ্ছে। সাথে যোগ হয়েছে আরপিও সংশোধনের কিছু প্রস্তাবনা। কোনো আসামিকে আদালত পলাতক ঘোষণা করলে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না, এমন বিধান আইনে যুক্ত করার প্রস্তাব করেছে ইসি।

সংসদ নির্বাচনে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার বিধানও বাদ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ দু’টিসহ সংসদ নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) আরো বেশ কিছু সংশোধনী আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। ইসির প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবে সশস্ত্রবাহিনীকে সংজ্ঞাভুক্ত করা হয়েছে। এতে সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর সদস্যরা ভোটকেন্দ্রে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের ক্ষমতা পাবেন। কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে ‘না’ ভোটের ব্যবস্থা রাখা, ভোট বন্ধে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানো, জামানতের পরিমাণ বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা, প্রার্থীর হলফনামায় দেশ ও বিদেশে থাকা সম্পদের হিসাব দেয়া বাধ্যতামূলক করাসহ বেশ কিছু প্রস্তাব আছে। সবমিলিয়ে প্রস্তুতি ও আয়োজন যথেষ্ট।

নির্বাচনের আগে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) তুলে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মাঠ প্রশাসনের ভোটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করলে তাকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্তও রয়েছে। বেসামরিক প্রশাসনের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে সাজানোর কাজও চলছে। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে মাঠের সর্বশেষ পরিস্থিতির আপডেট নেয়া হয়েছে। নির্বাচনের আগে, বিতাড়িত-পতিত শক্তির আয়োজনে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে বিশৃঙ্খলা বাধানোর কানাঘুষা বেশ জোরদার।

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। যে কারণে ছাত্রদের ক্ষমতা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি। ছাত্ররা প্রভাবিত করতে পারেন রাজনীতিকে। এর প্রভাব আগে যেভাবে রাজনীতিতে পড়ত, তার চেয়ে এখন অনেক বেশি পড়বে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]