শিক্ষাগতভাবে আমরা, অর্থাৎ- বাংলাদেশীরা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় প্রায় ৬৩ বছর পিছিয়ে আছি। ১৮৫৭ সালে কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বেতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; ১৮৮২ সালে লাহোরে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়; আর ঢাকায় তা আসে অনেক পরে, ১৯২১ সালে। এই প্রায় ছয় দশকের বিলম্ব আমাদের জাতীয় চরিত্র, চিন্তাধারা ও সামাজিক আচরণে গভীর ছাপ ফেলেছে। এই শিক্ষা পিছিয়ে পড়া কেবল ডিগ্রির নয়, এটি যুক্তিবোধ, সহনশীলতা এবং আত্মসমালোচনার ক্ষেত্রেও স্পষ্ট। ভারত যেখানে সংগঠিত চিন্তা ও শৃঙ্খলার জাতিতে পরিণত হয়েছে, আমরা এখনো খুঁজে ফিরি আমাদের দিকনির্দেশনা। যদি আজো আমরা আত্মপরিবর্তনের সাহস না পাই, তবে আগামী ৬৩ বছর পরও আমরা একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকব, দুর্বল, বিভক্ত ও আত্মমগ্ন এক জাতি হিসেবে।
একসময় অগ্রদূত ছিল যে বাঙালি
বিশ্বখ্যাত নেতা গোপাল কৃষ্ণ গোখলে একসময় বলেছিলেন, What Bengal thinks today, India thinks tomorrow. এই উক্তি একসময় সত্য ছিল, কারণ ১৭৭২ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত কলকাতাই ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী, চিন্তা, রাজনীতি ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু আজ সেই বাঙালি কোথায়? গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ সম্প্রতি এক কলামে লিখেছেন, ‘বাংলা ও বাঙালি আন্দোলনপ্রিয় জাতি। আন্দোলনের ঠেলায় ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে ১৯১২ সালে দিল্লিতে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল... তখন থেকেই বাংলার পতনের শুরু।’ ১৯৪৭ সালে বাংলা বিভক্ত হলেও আমরা পূর্ববঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তান অতিক্রম করে আজকের বাংলাদেশে পৌঁছেছি। তবে আন্দোলন প্রিয়তার ঐতিহ্য আমাদের সমাজে এখনো অটুট রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমরা ন্যায়সঙ্গত শিক্ষাব্যবস্থা বা প্রকৃত জ্ঞানচর্চার জন্য কখনো আন্দোলন করি না, আমাদের আন্দোলন সীমাবদ্ধ থাকে রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া, বেতন বা সুযোগ সুবিধা বাড়ানো বা ক্ষমতার লড়াইয়ে।
এই ঐতিহাসিক বাস্তবতা প্রমাণ করে, রাজনৈতিক প্রভাব, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং স্বার্থপর শাসনব্যবস্থা ধীরে ধীরে প্রশাসনকে জনগণের প্রকৃত শিক্ষা ও আস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার এই বাস্তবতাকে একবাক্যে প্রকাশ করেছেন, ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল বলে কিছু নেই। এখানে যেটি আছে, সেটি লুটেরা শ্রেণী, দুর্নীতিবাজ।’ এই মন্তব্য কঠোর হলেও এর কিছু বাস্তবতা রয়েছে। তবে তার এই মন্তব্য স্পষ্ট করে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের শিক্ষাগত ঘাটতি, কাঠামোগত দুর্বলতা এবং নৈতিকতার অভাবই আজকের সমাজে দুর্নীতির মূল উৎস ও জন্মদাতা।
বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিং : এক নির্মম আয়না
২০২৫ সালের বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিং আমাদের সামনে আয়নার মতো সত্য উন্মোচন করে দিয়েছে- বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই বিশ্বের শীর্ষ ৮০০-এর মধ্যে নেই, অথচ ভারতের ২২টি এবং পাকিস্তানের ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় সেখানে স্থান পেয়েছে। এটি শুধু শিক্ষার নয়, জাতীয় মননের দারিদ্র্যের প্রতিফলন। আমাদের শিক্ষানীতিতে জ্ঞান নয়; মুখস্থবিদ্যা মুখ্য, গবেষণা নয়; পদমর্যাদা বড়। যে জাতি জ্ঞানের পরিবর্তে পদ ও প্রভাবকে বেশি মূল্য দেয়, ইতিহাস তাকে কখনোই ক্ষমা করে না।
শিক্ষার গুণগতমানের সঙ্কট : দুর্নীতি ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা আজ এক গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত, এটি কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়; বরং তরুণ প্রজন্মের প্রতি এক বিশাল বিশ্বাসঘাতকতা।
ট্রাস্টি বোর্ডের বাণিজ্যিকীকরণ : অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য কার্যত ক্ষমতাহীন; সিদ্ধান্ত নেন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা, যারা মূলত বিনিয়োগকারী। ৩০ বছর আগে অলাভজনক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে শুরু হলেও এখন তা পরিণত হয়েছে ব্যবসায়িক করপোরেশনে। স্বনামধন্য এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিদের বিরুদ্ধে ৩০৪ কোটি টাকার অর্থ আত্মসাৎ ও বিলাসবহুল গাড়ি ক্রয়ের অভিযোগে মামলা বিচারাধীন। আরেক প্রতিষ্ঠানে ৪৪৫ কোটি টাকার অনিয়মে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে সনদ বাণিজ্যই মূল লক্ষ্য, শিক্ষার মান নয়।
দুর্নীতির দৃশ্যপট : বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে এখন ঘুষ, দলীয় আনুগত্য ও আত্মীয়তাবাদের রাজত্ব। সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর সময়ে উপাচার্য নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে দেশজুড়ে আলোড়ন ওঠে। সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হয়, ‘দুই কোটি টাকায় উপাচার্য পদ বিক্রি হয়েছে।’ শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবনের প্রতিটি স্তরে, শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রশাসন পর্যন্ত, সর্বত্র দুর্নীতির ব্যাপকতা দেখছে। ফলাফল : বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞানের কেন্দ্র নয়; বরং দলীয় আনুগত্যের প্রশিক্ষণকেন্দ্র। শিক্ষক নিয়োগে মেধা নয়, পার্টিলাইনই যোগ্যতার মানদণ্ড। এই বাস্তবতা আমাদের উচ্চশিক্ষাকে পরিণত করেছে ‘ডিগ্রির বাজারে’, যেখানে জ্ঞানের কোনো মূল্য নেই।
আমার অভিজ্ঞতা : IQAC সেলের গুরুত্ব ও চ্যালেঞ্জ
শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে ইন্টারনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল (IQAC) অত্যাবশ্যক। প্রতিষ্ঠাতা ডিন এবং প্রোভিসি হিসেবে সরকারি বিইউপির (বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস) সূচনালগ্ন থেকে যুক্ত থাকায় এবং পরবর্তীতে IQAC সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের সুযোগ পাওয়ায়, আমি গুণগত মান নিশ্চিতকরণের বিষয়ে জ্ঞান লাভ করি। পরে বেসরকারি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের IQAC বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি, আমি বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল (BAC) থেকেও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। ইউজিসির সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও যে IQAC পরিচালক হিসেবে একজন সিনিয়র অধ্যাপক থাকা বাধ্যতামূলক, কিন্তু দেখি, প্রয়োজনীয় সুবিধা, অর্থ বরাদ্দ ও অবকাঠামো পেতে বারবার বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কারণ মানোন্নয়নের উদ্যোগে ব্যয় জড়িত থাকায় ট্রাস্টি বোর্ড বিনিয়োগে অনাগ্রহী। তাদের অধিকাংশেরই উদ্দেশ্য কেবল নামমাত্র সনদ বিতরণ করা, মান বজায় রাখা নয়। একজন শিক্ষাবিদও হিসেবে এই বাস্তবতা দেখা আমার জন্য চরম হতাশার ছিল।
জাতীয় ক্ষতি ও মেধাশক্তির অপচয়
প্রতি বছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী চার পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে এমন সনদ অর্জন করছে, যা চাকরির বাজারে কার্যত মূল্যহীন। এই ‘মেধা অপচয়’ জাতির অর্থনীতি, সমাজ ও ভবিষ্যতের প্রতি এক নীরব আত্মঘাতী আঘাত। ২০২২ সালের ইউজিসি রিপোর্ট অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগেই রয়েছে ১৭টি সরকারি ও ৬৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের ১১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩.৪১ লাখ শিক্ষার্থী, আর ৫৩টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭.২৫ লাখ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। এই বিপুল মানবসম্পদের মধ্যে কতজন সত্যিকারের মেধাবিকাশের সুযোগ পাচ্ছে, সে প্রশ্ন আজ জাতীয় সঙ্কটে পরিণত হয়েছে।
নেতৃত্বের শূন্যতা ও নৈতিক বিদ্রোহের ডাক
আজ দেশের ১ নম্বর সমস্যা দুর্নীতি, আর সবচেয়ে বড় ঘাটতি নৈতিক নেতৃত্বের। রাজনীতিবিদদের অনেকেই ক্ষমতার মোহে অন্ধ, জনগণের নয়, ব্যক্তিস্বার্থের রাজনীতি করছেন। তারা জাতির আশা নয়; বরং আজ ‘জনগণের রক্তচোষা’ নামে পরিচিত। তাই পরিবর্তনের নেতৃত্ব নিতে হবে শিক্ষকদের হাতে, কারণ পচনশীল রাজনীতিবিদরা কখনোই তা করবেন না। শিক্ষকরাই জাতির নৈতিক কম্পাস, আর ছাত্ররাই তার জীবন্ত শক্তি। যেমন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল নেতৃত্বের কেন্দ্রে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ই দিয়েছিল অগণিত শহীদ ও বুদ্ধিজীবী, আর সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ছাত্র অভ্যুত্থান আবারো প্রমাণ করেছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ই পারে জাতিকে পুনর্জাগরণের পথে ফিরিয়ে আনতে। বাংলাদেশে জোহরান মামদানি আছেন কি না জানি না; কিন্তু এমন নৈতিক, চিন্তাশীল ও সাহসী নেতৃত্ব জন্ম নিতে পারে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই, যদি শিক্ষক ছাত্রসমাজ একসাথে দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়।
আত্মপরিবর্তনের ডাক
বাংলাদেশ আজ দাঁড়িয়ে আছে এক গভীর ক্রান্তিকালে, যেখানে জ্ঞান ও মূল্যবোধের সাথে লড়ছে অন্ধ আনুগত্য, দুর্নীতি ও নৈতিক অবক্ষয়। যদি আমরা এখনই নিজেদের দুর্বলতা স্বীকার না করি, তবে এই ৬৩ বছরের ব্যবধান একদিন শতাব্দীর পশ্চাৎপদতায় পরিণত হবে।
পরিবর্তনের সূচনা হতে হবে শিক্ষিত সমাজ থেকে। কারণ রাজনীতিকরা সমাজ থেকেই উঠে আসেন, যদি সমাজ অসৎ হয়, রাজনীতিও তারই প্রতিফলন হবে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক ও শিক্ষিত শ্রেণীকেই হতে হবে জাতির নৈতিক দিশারী, নতুন আলোর বাহক।
আজ শিক্ষক ও ছাত্রদের একসাথে এগিয়ে আসতে হবে, কারণ দুর্নীতি বাংলাদেশের এক নম্বর শত্রæ। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যতদিন ব্যক্তিস্বার্থে নিমগ্ন থাকবে, ততদিন সত্যিকারের পরিবর্তনের দায়িত্ব নিতে হবে শিক্ষকসমাজকে। যদি আমরা শিক্ষাকে জাতীয় অগ্রাধিকারে পরিণত করি, নৈতিকতা ও জবাবদিহিতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রে স্থাপন করি, তবে একদিন আবারো আমরা গর্বের সাথে বলতে পারব What Bengal thinks today, the world thinks tomorrow.।
লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও উপ-উপাচার্য, বিইউপি



