নির্বাচনী ট্রেন : যাত্রাপথে যত ভোগান্তি

নির্বাচন অনুষ্ঠানের অন্যতম ফ্যাক্টর আইনশৃঙ্খলা, যা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।

গণভোট, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান নিয়ে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনকল্পে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে ‘শ্যাম-কুল রক্ষা’ করার চেষ্টা করছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

তিনি গত ১৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত করার ঘোষণা দিয়েছেন। একই সাথে চারটি বিষয়ের উপর ‘হ্যাঁ/না’ গণভোট এবং সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে (পিআর পদ্ধতি) ১০০ সদস্য নিয়ে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ গঠনের কথা উল্লেøখ করেছেন। এর মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টির মধ্যে যে বিরোধ চলছিল, তার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান দেয়ার চেষ্টা করছেন। একই সাথে আদেশ জারি করে গেজেট প্রকাশ করে তার আইনি ভিত্তিও দিয়ে দিয়েছেন। ওই ভাষণে তিনি অত্যন্ত আস্থার সাথে আরো উল্লেখ করেছেন, আমাদের একটি গুরুদায়িত্ব হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান। আমি ঘোষণা করেছি, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচন উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য আমরা সব প্রস্তুতি গ্রহণ করছি।

প্রধান উপদেষ্টার এই ভাষণের পর দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সঙ্কট সমাধানের প্রত্যাশা ফুটে উঠলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছুটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর বিএনপি আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং গণভোট একই দিনে আয়োজনের ঘোষণা দেয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গণভোট হলেই আইন প্রণয়ন ও সংবিধান সংশোধন হয়ে যাবে না বলে মন্তব্য করে বলেছেন- মনে রাখতে হবে, এর জন্য আগে অবশ্যই জাতীয় সংসদ গঠিত হতে হবে। তিনি আরো বলেন, আমরা মনে করি, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব যাতে খর্ব না হয় সে জন্য আমরা কোনো আরোপিত আইন দিয়ে, আদেশ দিয়ে, যেকোনো রকমের জবরদস্তিমূলক প্রস্তাব দিয়ে জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্বকে আমরা হস্তক্ষেপ করাতে দিতে চাই না। কারণ এটিই বাংলাদেশের একমাত্র সার্বভৌম হাউজ, যেই সার্বভৌম হাউজ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে, তাদের সার্বভৌম প্রতিনিধিত্ব করে জাতীয় সংসদে যারা নির্বাচিত হবে তাদের মধ্য দিয়ে।

অপরদিকে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ আট দল আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোটের দাবি পুনর্ব্যক্ত করে এবং এর সাথে নতুন করে যুক্ত করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টাকে পদত্যাগসহ অপরাপর দাবি। আর এই দাবি আদায়ে দলগুলো বিক্ষোভ মিছিলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে। বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকে জাতির সাথে প্রতারণা বলে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এই ভাষণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ বাড়িয়ে দেশকে দীর্ঘস্থায়ী সঙ্কটে ঠেলে দেবে। ভাষণে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করার যে কথা বলা হয়েছে; এটিও সংবিধান পরিপন্থী। এ বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনে কোনো আলোচনা হয়নি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও কোনো ঐকমত্য হয়নি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষিত সময়সীমায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তিন মাসেরও কম সময় বাকি আছে। প্রত্যাশিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে ডিসেম্বরে শিডিউল ঘোষণা করতে হবে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যেই তাদের প্রার্থিতা ঘোষণা করে ধানের শীষ এবং দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছে। এনসিপি বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকার প্রার্থীদের মধ্যে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি করে আসনভিত্তিক প্রার্থী ঘোষণা করেছে। গণফোরাম ১৩৩টি আসনে দলীয় প্রাথমিক প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে।

আরো বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। দলীয় মনোনয়ন পেয়ে দলগুলোর প্রার্থীরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় শোভাযাত্রা, মোটরসাইকেল ও গাড়িবহর নিয়ে শোডাউন করে প্রচারণা চালাচ্ছেন। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মিছিল-সমাবেশ অব্যাহত রয়েছে। এই কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় সুবিধাকেও।

গত ৩ নভেম্বর বিএনপি প্রার্থিতা ঘোষণার মধ্যে দিয়ে গোটা জাতির মানসিকতা নির্বাচনমুখী হয়ে পড়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের দেশের মানুষ নির্বাচনকে উৎসবের আমেজে অংশগ্রহণ করে থাকে। কিন্তু বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে বিনাভোট, রাতের ভোট ও ডামি নির্বাচনে দেশবাসী এই ভোট উৎসব থেকে বঞ্চিত। জাতীয় নির্বাচন ঘিরে কোথায় যেন একটি দ্বিধাদ্ব›দ্ব, অনিশ্চয়তা উঁকি দিচ্ছে। কয়েক মাস আগে গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে নির্বাচনকে বানচাল করতে দেশে ভয়াবহ নাশকতা ঘটতে পারে- এমন আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, স্থাপনা, কেপিআই এলাকা, গার্মেন্ট শিল্প- এমনকি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে টার্গেট করে নাশকতার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল। চট্টগ্রামের ইপিজেড ও রাজধানীর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে নাশকতা হিসেবে দেখছেন অনেকে।

গত ২৯ অক্টোবর ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনুষ্ঠিত এক সমন্বয়সভায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ছোটখাটো নয়, বড় শক্তি নিয়ে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা হবে। নির্বাচন বানচালের জন্য ভেতর থেকে, বাইরে থেকে অনেক শক্তি কাজ করবে। হঠাৎ করে আক্রমণ চলে আসতে পারে। এর মধ্য দিয়ে সরকার দেশবাসীকে এক ধরনের মানসিক প্রস্তুতি নিতেই ইশারা করেছে।

বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি অনেকটা বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে- রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য, রাজপথ দখল ও শক্তি প্রদর্শনমূলক বক্তব্যে-বিবৃতি রাজনৈতিক অঙ্গনে যে অস্থিরতার সৃষ্টি করছে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে মরিয়া হয়ে উঠছে পলাতক ফ্যাসিবাদী শক্তি। পলাতক হাসিনা ও তার দোসরদের রক্ষা করার জন্য ১৩ নভেম্বর ঢাকা লকডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করে। এর উদ্দেশ্য, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দলীয় নেত্রীর বিচারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা এবং বিচার প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্টদের প্রতি ভীতি ছড়ানো। এক সময় আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা কথায় কথায় তৎকালীন বিরোধী দলগুলোকে আগুন সন্ত্রাসী হিসেবে ট্যাগ লাগাত, সময়ের ব্যবধানে সেই পলাতক ফ্যাসিবাদী শক্তি অগ্নিসন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে।

নির্বাচনী প্রচারণা এবং স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগে পেশিশক্তিমুক্ত পরিবেশ অপরিহার্য। নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রাঙাচোখে তাকাচ্ছে। চট্টগ্রামে নির্বাচনী জনসংযোগকালে নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এবং এই ঘটনায় বাবলা নামে একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। গত ১০ নভেম্বর পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্যে দিবালোকে তারেক সাইফ মামুন নামে একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এর পরপরই জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কর্মী সৌরভকে গুলশান লেকের পাড়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত ১৫ নভেম্বর ল²ীপুর সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের আবুল কালাম জহির নামে এক বিএনপি নেতাকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এদিকে চট্টগ্রামে মো: একরাম নামে এক ব্যবসায়ীকে ব্লেড দিয়ে পোঁচ দিয়ে মারার হুমকি দিয়েছে এক সন্ত্রাসী। প্রায় প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে যা আমাদেরকে ভয়ঙ্কর বার্তা দেয়। অভ্যুত্থানকালে দেশের বিভিন্ন থানা-পুলিশ ফাঁড়ি থেকে পাঁচ হাজার ৭৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ছয় লাখ ৫২ হাজার আটটি গোলাবারুদ লুট হয়। এর মধ্যে এক হাজার ৩৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং দুই লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৪টি গোলাবারুদ এখনো উদ্ধার হয়নি। তাছাড়া আওয়ামী লীগের টানা ১৬ বছরের শাসনামলে দলীয় ক্যাডার বিবেচনায় আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী নেতাদের নামে দেয়া লাইসেন্স করা অস্ত্র-গুলি যদি উদ্ধার করা সম্ভব না হয় এবং এসব যদি সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যায় তবে তা অপরাধমূলক কাজে ব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, দেশের সীমান্তপথেও আসছে অবৈধ অস্ত্র।

ইতোমধ্যে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে গোয়েন্দা সংস্থা ও রেলওয়ে পুলিশের সহায়তায় রাজধানীর বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে অভিযান চালিয়ে আটটি বিদেশী পিস্তল ও বিস্ফোরক জব্দ করেছে। সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের হাতে থাকা এসব অস্ত্র-গোলাবারুদ আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরাপত্তার জন্য হুমকি। নির্বাচন অনুষ্ঠানের অন্যতম ফ্যাক্টর আইনশৃঙ্খলা, যা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। কাজেই একদিকে রাজনৈতিক বিরোধ এবং অপরদিকে পলাতক ফ্যাসিবাদী শক্তির সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার করে বিদেশ থেকে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যানবাহন ও গ্রামীণ ব্যাংকসহ বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করে দেশে আতঙ্ক সৃষ্টির অপচেষ্টা, পেশাজীবীদের ব্যানারে আন্দোলন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথকে বাধাগ্রস্ত করা বা নির্বাচনী ট্রেনকে ভোগান্তিতে ফেলার প্রক্রিয়া। ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করতে হলে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের লাগাম টেনে ধরতে হবে।

লেখক : আইনজীবী