হাদি দেশের রাজনীতিতে কি বদলালেন

হাদির মৃত্যুর পর আধিপত্যবাদ আর আগের মতো হিংস্র নয়, বরং আরো চালাক, আইনি ও মনস্তাত্তি¡ক হবে। কিন্তু একটি ঝুঁকি তার জন্য থেকেই যায়, যত বেশি কৌশল, তত বেশি ভয়ের প্রমাণ।

ওসমান হাদি বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো একক দল বা সরকারের ক্ষমতার সমীকরণ বদলাননি, কিন্তু তিনি রাজনীতির ভাষা, ভয় ও ভবিষ্যৎ পথচলার বোধ- এই তিনটি জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনে দিয়েছেন। কয়েকটি স্তরে বিষয়টি বোঝা দরকার।

কী বদলালেন-

১. রাজনীতির ভাষা বদলেছেন : ওসমান হাদি কোনো প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতা কাঠামোর মুখ ছিলেন না। তিনি ছিলেন- রাষ্ট্রীয় সহিংসতার বিরুদ্ধে নৈতিক প্রতিবাদের প্রতীক, মতপ্রকাশের অধিকারের প্রশ্নে নিঃশর্ত অবস্থানকারী। তার মৃত্যু রাজনীতিকে আবার মনে করিয়ে দিয়েছে- ‘রাজনীতি শুধু নির্বাচন বা ক্ষমতার খেলা নয়, এটি জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন।’

এর ফলে নাগরিক সমাজ, তরুণ রাজনীতি ও বিকল্প কণ্ঠে নৈতিকতা ও অধিকারভিত্তিক রাজনীতির ভাষা আবার দৃশ্যমান হয়েছে।

২. ভয়ের রাজনীতিকে উন্মোচন করেছেন : ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড দেখিয়ে দিয়েছে ভিন্নমত এখনো কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, ‘নীরব থাকাই নিরাপদ’- এই বোধ রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় উভয় শক্তিই লালন করছে।

কিন্তু ঢ়ধৎধফড়ী হলো- এই ভয় প্রকাশ্যে আসায় ভয়ের রাজনীতির বৈধতা কমেছে। মানুষ বুঝেছে, সমস্যাটা বিচ্ছিন্ন নয়; এটি কাঠামোগত।

৩. নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে চাপ তৈরি করেছেন : তিনি সরাসরি কোনো নির্বাচন থামাননি বা ত্বরান্বিত করেননি। কিন্তু বিরোধী রাজনীতি বলছে : ‘এই রাষ্ট্র কি মতভিন্নতার নিরাপত্তা দিতে পারে?’ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলছে : ‘রাজনৈতিক সহিংসতা একটি কাঠামোগত সঙ্কেত।’

অর্থাৎ, তার মৃত্যু নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা প্রশ্নকে জোরালো করেছে।

৪. প্রতীকে রূপান্তর : ব্যক্তি থেকে রাজনৈতিক স্মৃতি : ওসমান হাদি এখন আর শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি স্মৃতি, একটি প্রশ্ন : ‘এই দেশে সত্য বলার দাম কত?’

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন প্রতীক অতীতে খুব কম এসেছে- যেখানে ব্যক্তি ক্ষমতায় না থেকেও রাজনীতির নৈতিক দিককে নাড়িয়ে দেয়।

কিন্তু তিনি যা বদলাতে পারেননি

বাস্তবতা কঠিন- ক্ষমতার কাঠামো ভাঙেনি : নিরাপত্তা রাষ্ট্রের চরিত্র বদলায়নি, বিচার বা জবাবদিহির নিশ্চয়তা তৈরি হয়নি। অর্থাৎ, তিনি দরজা দেখিয়েছেন, ভেতরে ঢোকা এখনো বাকি।

ওসমান হাদি ক্ষমতার রাজনীতি বদলাননি, কিন্তু রাজনীতির অর্থ বদলেছেন। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন- বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এমন জায়গায়, যেখানে একজন মানুষের মৃত্যু রাষ্ট্রের চরিত্রের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রশ্নের উত্তর যদি রাজনীতি না দেয়, ইতিহাস দেবে।

ঘাতকরা কী চেয়েছিল, কী পেয়েছে

হাদিকে হত্যা করে ঘাতকরা কী চেয়েছিল আর বাস্তবে কী পেয়েছে- এই দুইয়ের মধ্যে ব্যবধানটাই আজ বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ।

তারা কী চেয়েছিল- প্রথমত, ভয় সৃষ্টি ও নীরবতা চাপানো যে তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তা স্পষ্ট। তারা একটি উদাহরণ তৈরি করতে চেয়েছিল। বার্তাটি ছিল, ‘সীমা ছাড়ালে পরিণতি আছে’।

হাদি ছিলেন প্রকাশ্য, যুক্তিনির্ভর ও আপসহীন কণ্ঠ। তাকে হত্যা মানে ছিল সমমনা কণ্ঠগুলোকে চুপ করানো এবং ভবিষ্যৎ প্রতিবাদীদের আগেই দমিয়ে দেয়া।

দ্বিতীয়ত, রাজনীতিকে ‘ব্যক্তিগত ঝুঁকি’র পর্যায়ে নামিয়ে আনা। তারা চেয়েছিল রাজনীতি হোক দলীয় অভ্যন্তরীণ হিসাব, ক্ষমতার নীরব দরকষাকষি, সাধারণ মানুষের জন্য বিপজ্জনক এলাকা। অর্থাৎ রাজনীতিকে নাগরিক অধিকার থেকে ভয়-নিয়ন্ত্রিত কর্মকাণ্ডে নামিয়ে আনা।

তৃতীয়ত, কাঠামোগত দায় এড়িয়ে যাওয়া। একজনকে হত্যা করলে বিষয়টি ‘ব্যক্তিগত শত্রুতা’ বা ‘বিচ্ছিন্ন সহিংসতা’ হিসেবে দেখানো সহজ- রাষ্ট্র দায় এড়াতে পারে, কাঠামো প্রশ্নের বাইরে থাকে- এটাই ছিল কৌশল।

তারা কী পেয়েছে

এক. নীরবতা নয়- প্রতীক : হাদির মৃত্যু তাকে মুছে দেয়নি; বরং তাকে প্রতীকে রূপান্তর করেছে। এখন তিনি একটি প্রশ্ন, একটি নৈতিক মানদণ্ড, একটি রাজনৈতিক স্মৃতি। ব্যক্তিকে হত্যা করা যায়, প্রশ্নকে নয়।

দুই. ভয়ের রাজনীতির উল্টো ফল : হত্যাকাণ্ড দেখিয়ে দিয়েছে- সমস্যাটা বিচ্ছিন্ন নয়

এটি কাঠামোগত। এর ফলে ভয়ের রাজনীতি আর অদৃশ্য থাকেনি; এটি এখন উন্মোচিত এবং উন্মোচিত ভয় দীর্ঘমেয়াদে টেকে না।

তিন. নির্বাচন ও রাষ্ট্রের ওপর অতিরিক্ত চাপ : হাদির মৃত্যু রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যর্থতা সামনে এনেছে, নির্বাচন, মতপ্রকাশ ও জবাবদিহি প্রশ্নে নতুন চাপ তৈরি করেছে। যা তারা চায়নি সেটাই ঘটেছে : আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষণ বেড়েছে।

চার. ইতিহাসে ঘাতকদের নাম মুছে যাওয়া : বাংলাদেশের ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে, ঘাতকদের নাম হারিয়ে যায়। নিহত ব্যক্তি ইতিহাসে থেকে যায়। হাদির ক্ষেত্রেও সেটাই হচ্ছে।

চূড়ান্ত মূল্যায়ন হতে পারে- ঘাতকরা চেয়েছিল ভয়; পেয়েছে প্রশ্ন। চেয়েছিল নীরবতা; পেয়েছে স্মৃতি।

চেয়েছিল নিয়ন্ত্রণ; পেয়েছে অনিশ্চয়তা। তারা হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে সফল হয়েছে, কিন্তু রাজনীতিতে সবচেয়ে বিপজ্জনক পরাজয় হলো- নৈতিক পরাজয়। সেই পরাজয় ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।

নতুন কৌশল কী হতে পারে

হাদির মৃত্যুর পর আধিপত্যবাদ আর আগের মতো খোলামেলা দমনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং এটি আরো সূ², বহুস্তরীয় ও ‘আইনি-স্বাভাবিক’রূপে হাজির হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সংক্ষেপে বললে- হিংসা থেকে হেজেমনি, ভয় থেকে নিয়ন্ত্রিত সম্মতি- এই রূপান্তরটাই হতে পারে নতুন কৌশল।

সম্ভাব্য প্রধান কৌশল হতে পারে- দৃশ্যমান দমন কমিয়ে অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ : হাদির মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে দিয়েছে খোলামেলা হত্যা বা সহিংসতা এখন উল্টো ফল দিতে পারে।

নতুন কৌশল হতে পারে- সরাসরি হত্যা নয়, চরিত্র হনন; গ্রেফতার নয়, আইনিভাবে ঝুলিয়ে রাখা,

নিষেধাজ্ঞা নয়, লাইসেন্স-চাকরি- চুক্তির নীরব চাপ। অর্থাৎ, মানুষ থাকবে ‘মুক্ত’ কিন্তু কার্যত অকার্যকর।

দ্বিতীয় কৌশল হতে পারে আইনের ভাষায় দমন : নতুন আধিপত্যবাদ সবচেয়ে বেশি ভর করবে- ডিজিটাল আইন, সাইবার অপরাধ, জাতীয় নিরাপত্তা, ‘ভুল তথ্য’ বা ‘রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য’ সংজ্ঞার ওপর এখানে দমন হবে- ‘আইন অনুযায়ী’ কিন্তু আইনটাই হবে ভয়ের হাতিয়ার।

ফলাফল : প্রতিবাদীকে অপরাধী বানানো সহজ,

রাষ্ট্র নিজেকে দেখাতে পারবে ‘আইনসম্মত’।

তৃতীয় কৌশল হতে পারে প্রতিরোধকে খণ্ডিত করা। হাদি একটি নৈতিক কেন্দ্র হয়ে উঠছিলেন।

তারপর নতুন কৌশল হবে- কোনো একক প্রতীক উঠতে না দেয়া। আন্দোলনগুলো আলাদা আলাদা ইস্যুতে ভেঙে ফেলা। ছাত্র, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী- সবাইকে ভিন্ন ভিন্ন ফ্রেমে আটকে রাখা

এই কৌশলের নাম-ঋৎধমসবহঃধঃরড়হ এক সাথে কিছু না থাকলে, কিছুই বিপজ্জনক থাকে না।

চতুর্থ কৌশল হতে পারে নিয়ন্ত্রিত বিরোধী রাজনীতি। আধিপত্যবাদ এখন জানে সম্পূর্ণ বিরোধীশূন্যতা আন্তর্জাতিকভাবে সন্দেহজনক।

তাই দেখা যেতে পারে- ‘অনুমোদিত’ বিরোধী দল

নিরাপদ সমালোচক, সীমিত প্রতিবাদের জায়গা

যেখানে বিরোধিতা থাকবে, কিন্তু সিস্টেম প্রশ্নে নয়, শুধু ব্যবস্থাপনায়।

আবেগ ক্লান্তি তৈরি করা। হাদির মৃত্যুতে আবেগ তৈরি হয়েছে। নতুন কৌশল হবে- ইস্যু বন্যা তৈরি করা- একের পর এক সঙ্কট ছুড়ে দেয়া, মানুষকে ক্লান্ত করে তোলা। এর ফল হিসাবে মানুষ বলবে- ‘সবই তো একই, কিছুই বদলায় না।’

এই নির্লিপ্ততাই আধিপত্যবাদের সবচেয়ে বড় জয়।

জাতীয়তাবাদী ঢাল ও বাইরের শত্রু। ভেতরের প্রশ্ন ঢাকতে ‘বিদেশী ষড়যন্ত্র’, ‘রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি’, ‘অস্থিতিশীলতা’ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী, এই ভাষা আবার জোরদার হতে পারে।

হাদির মতো মৃত্যুকে তখন দেখানো হবে ‘অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সঙ্কট’, নৈতিক সঙ্কট নয়।

ইতিহাস পুনর্লিখন : সবশেষ ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হলো- হাদির স্মৃতি ধীরে ধীরে মুছে ফেলা; তাকে ‘বিতর্কিত’, ‘প্রান্তিক’ বা ‘ভুলপথে পরিচালিত’ হিসেবে উপস্থাপন করতে পাঠ্য, মিডিয়া ও আর্কাইভে নীরব সংশোধন।

আধিপত্যবাদ জানে- বর্তমান নিয়ন্ত্রণ করা যায় শক্তি দিয়ে, কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ হয় ইতিহাস দিয়ে।

শেষ কথা হলো, হাদির মৃত্যুর পর আধিপত্যবাদ আর আগের মতো হিংস্র নয়, বরং আরো চালাক, আইনি ও মনস্তাত্তি¡ক হবে। কিন্তু একটি ঝুঁকি তার জন্য থেকেই যায়, যত বেশি কৌশল, তত বেশি ভয়ের প্রমাণ।

আর যে শাসন নিজের নাগরিককে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়, সে শাসন ইতিহাসে বিদায় নিয়ে আর ফিরে আসে না।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক নয়া দিগন্ত