সবাইকে সীমার মধ্যে থাকতে হয়

যে সুযোগ এখন এসেছে, তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কেবল নিজের মাঝে কাদা ছোড়াছুড়ি করে নিজেদের ব্যস্ত রেখে দেহটা কর্দমাক্ত করছেন। ইতিহাসের কোন্ স্তরে আজকের রাজনীতিকদের স্থান হবে। সেটি উপলব্ধি করা খুব কি কঠিন কাজ?

সম্প্রতি আমাদের একজন সহকর্মীর কাছে সাবেক একজন রাষ্ট্রদূত এসেছিলেন। তার সাথে সাক্ষাতে, ‘অন্তরঙ্গ’ আলাপে তার পরিচয় জেনেছি। তিনি যখন রাষ্ট্রের দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সে অভিজ্ঞতাও শুনেছি। দেশের বাইরে থেকে দায়িত্ব পালনের সময় ঢাকায় তাদের সদর দফতরের (মন্ত্রণালয়ে) নানা ব্যত্যয় ও সমন্বয়ের অভাব লক্ষ করেছেন তিনি। যেমন কালক্ষেপণ, সিদ্ধান্ত দিতে দোদুল্যমানতা, দূতের নিজ আওতাধীন কাজের ব্যাপারে অযাচিত, অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ, সংশ্লিষ্ট দেশের বাস্তবতা বুঝতে হেডকোয়ার্টারের অক্ষমতা ও অপারগতা, যা অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের সাথে ঘনিষ্ঠতার পথে বাধা হয়ে থাকে। ওই রাষ্ট্রদূতের সাথে আলাপকালে আমরা বুঝতে পারি দেশের পররাষ্ট্রনীতির বিভিন্ন বিষয়ের নানামুখী ব্যত্যয়ের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীর অধিককাল অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও শুধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নয়, প্রশাসনের সর্বত্র এমন হাজারো কারণে এবং নানা বিষয়ে দেশ এখন বড় এক ব্যত্যয়ের মাঝে ডুবে আছে। আরো কতকাল এমন সব ব্যত্যয়ের জলাভূমিতে দেশ ও দশ হাবুডুবু খাবে। কে জানে কত যুগ এমন ধারা অব্যাহত থাকবে এবং ক্রমাগত বাড়বে। এমন ব্যত্যয় থেকে পরিত্রাণের কোনো পথনকশা রাজনৈতিক বলয়ের কোনো দল বা দলগুলো তৈরি করতে পেরেছে কি না? তা দৃশ্যমান নয়। সোনার হরিণ হয়ে আছে। এ ধারণা অমূলক নয় বা বাড়িয়ে বলা নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের তালিকাশক্তি প্রকৃতপক্ষে প্রায় সবসময় রাজনীতিকদের পক্ষপুটে থাকে। সবাই জানেন, দলগুলোও কখনো এ ধারণা অস্বীকার করে না। সে জন্য সব বিকৃতি বা ‘ব্যত্যয়’ দূর করতে অতীতে কোন্ দল কী করেছে, সে ইতিবৃত্ত সবার জানা ও দেখা আছে। সত্যি যদি কর্মপ্রিয়তার শৈলী ধারাবাহিকভাবে অনুসৃত হবে; তাহলে দেশটা এখন যে সমস্যা সঙ্কটের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে; তা হয়তো হতো না। জনগণ দেখে আসছে যখন কোনো নির্বাচনের হুইসেল বাজে, তখন একই সাথে রাজনৈতিক দলগুলো যেন ঘুম থেকে জেগে ওঠে। ভোটের পূর্বাহ্ণে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশের যে প্রচলিত রেওয়াজ, তা অনুসরণ করে। দলগুলো ক্ষমতায় গেলেও ইশতেহারের নামে বিপুল বপুর এক বিষাদসিন্ধু রচনা করে। অথচ তার এক বিন্দুও কখনো আলোর মুখ দেখে না।

সে কারণে বলতে হয়, সেই ইশতেহার আসলে নতুন কোনো মুদ্রণ এবং নতুন কিছু সংযোজন। আগেরটার পুনঃমুদ্রণ মাত্র। কারণ আগে যে প্রতিশ্রুতি প্রতিজ্ঞা ছিল তার কোনোটার ‘সুরক্ষা’ রাজনীতিকরা দেননি, নিছক কথামালায় তার ইতি ঘটেছে। সে কারণে কখনো নতুন করে কিছু রচনা করতে হয় না। একই ইশতেহারে বারবার পুনঃমুদ্রণ হয়ে থাকে। ৫০-৫৫ বছর এমন ধারাবাহিকভাবে চলছে। তবে সে পুরনো কাহিনী শুনতে উৎসব করা হয়, ঢাকঢোল পিটিয়ে লোকসমাজকে কাছে হাজির করে পুনরায় একই আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করা হয়। বলা হয় ক্ষমতায় গেলে (দায়িত্ব পেলে নয়) এসব ‘অঙ্গীকার’ বিদ্যুৎ গতিতে বাস্তবায়িত এবং দেশ শনৈঃ শনৈঃ উন্নতির চরম শিখরে উঠবে, জনগণের ভাগ্যের বদল হবে। অথচ রূঢ় বাস্তব হচ্ছে, ক্ষণিক পরে প্রদত্ত সেই অঙ্গীকারনামা পর মুহূর্তে, ভুলে যেতে সবাই বড্ড বেশি ভালোবাসে। এমনভাবে ‘ক্ষমতা’ পেয়েও কোনো দল গত ৫৪ বছরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে অন্ধকারের তিমিরে ছিল আজো তারা সেখানে পড়ে আছে; বরং অন্ধকার আরো গভীর হয়েছে। তবে ক্ষমতাপ্রাপ্তির পর কর্তাসমাজ নিজ নিজ সম্পদের ভারে নুয়ে পড়ে। এটা কোনো দলবিশেষের শৈলী সৌন্দর্য নয়। প্রায় সবাই এমন শৈলীর চর্চা করে। তবে সমাজে কিছু ব্যতিক্রম থাকে। যেমন জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত সেই অ্যানিমেল ফার্মের মতো। ‘সাম আর ইকোয়েল’, ‘সাম আর মোর ইকোয়েল’। গত ১৫-১৬ বছরে লীগ সরকার ছিল ‘মোর ইকোয়েল’। ওই জামানায় কী ব্যত্যয় ও বৈষম্য ব্যবধান ঘটেছে সে আলোচনা এখন কোনো মুখ্য বিষয় নয়; বরং কোন ব্যত্যয়, ব্যবধান বৈষম্য, অবিচার, জুলুম-নির্যাতন কী হয়নি তা-ই এখন গবেষণার বিষয়। নির্বাচনের পূর্বাহ্ণে প্রদত্ত আশ্বাস বিশ্বাস নিয়ে একটা ‘মেছাল’ দিতে চাই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ভারতে সেনাবাহিনীতে এ দেশীয় তরুণদের উদ্বুদ্ধ করা হতো। এভাবে আহ্বান জানানো হতো, ‘আয় আয়রে রং রুট/ ঘরমে’, ‘তেরা টুটা কাপড়া’, ‘হিয়া মিলেগা স্যুট’। এ দেশের ভোটারদের আস্থা পেতে বরাবর এমন নিরর্থক আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এটা কোনো বিজ্ঞজনের অভিমত পরামর্শ নয়। ভোট পাওয়ার প্রত্যাশা পূর্ণতা পেতে দলগুলোর এখন প্রথমে নিজেদের আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতে হবে। এমন কথা কোনো ব্যক্তি বা দল বলতে পারে না; তাদের মাঝে কোনো অপূর্ণাঙ্গতা নেই। পৃথিবীর কোনো প্রাণীকে পূর্ণাঙ্গতা দিয়ে তৈরি করা হয়নি। বগলের নিচে ইট রেখে মুখে সবাই শেখ ফরিদ হতে চায়। একসময় ফাঁক-ফোকর দিয়ে বগলের নিচের ইটটা বেরিয়ে পড়ে, তখন তারা বড় অস্বস্তি বোধ করেন। যেসব দল কোনো না কোনো সময় ক্ষমতায় ছিল তাদের মেয়াদকালের কাজকর্মের ফর্দটা নিয়ে একবার ভাবুন। নিক্তিতে তুলে পরিমাপ করুন কোন পাল্লা ভারী, ভালো না মন্দ। ভোলা ঠিক হবে না, জনতার হাতেও ভালোমন্দ নির্ণয়ের একটি নিক্তি বা মাপকাঠি আছে। রাজনীতিকদেরও কারো কারো মাঝে মারাত্মক স্মৃতিভ্রষ্টতা থাকে। পক্ষান্তরে জনতার মেমোরিকে কখনো খাটো করে দেখা ঠিক হবে না।

বিশ্ব এখন প্রতিদিন প্রতিক্ষণ পাল্টে যাচ্ছে। এমন পাল্টে যাওয়া গদ্যময় পৃথিবীকে রাজনৈতিক নেতা বা দল কিভাবে মূল্যায়ন করবে (সত্যিকার অর্থে)। তেমন কোনো বাক্যবিন্যাস কখনো শোনা যায়নি। গড্ডলিকায় এমন গা ভাসানো, নিছক স্রোতের শেওলার মতো ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যাবে। এতকালের সব ব্যত্যয়ের কথা উল্লেখ করা হলে নিঃসন্দেহে তা এক মহাকাব্য হয়ে দাঁড়াবে। মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এ ছোট দেশটির এত ‘জঞ্জাল’ দেখে যদি ‘আলী বাবার’ কাহিনীতে বর্ণিত ‘মর্জিনার’ মতো সুর করে বলা যায়, ‘ছিঃ ছিঃ এত্তা বড়া বাড়িমে এত্তা জঞ্জাল’। তবে দোষ দেবেন কাকে? এ বর্ষায় দেশের সব রাস্তার চরম দুদর্শা। ঘরে আশ্রয় নেবে যেখানে দুর্দান্ত ডেঙ্গু মশা। এ দৃশ্য শুধু আজকে নয়, কালান্তরে। রাস্তা বানাতে যে বিটুমিন ব্যবহৃত হয় সেটি এক নয়, দুই নয়, তিন নম্বর। আর এডিস-মশা নিধনে যে তরল রসায়ন ব্যবহৃত হয়, অভিযোগ আছে, সেখানে কোনো তরল রসায়ন থাকে না, শুধু থাকে কেরোসিন। ফলে রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটবে, মানুষ মরবে, ডেঙ্গুতে শত শত জীবনের ইতি ঘটবে। তাতে কার কী যায় আসে। এ তো মাত্র একটি ব্যত্যয়ের কথা, এমন হাজারো আছে।

অথচ আইনের ‘কেতাবে’ আছে জীবন-জীবিকা, শরীর-স্বাস্থ্য, শিক্ষা-দীক্ষা, নিরাপদ থাকার সব ব্যবস্থার সুরক্ষা দেবে রাষ্ট্রের পক্ষে সরকার। এতসব প্রতিশ্রুতির উপস্থিতি তো অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও দেখা যায় না।

এ ভূখণ্ডের পোড় খাওয়া সাধারণের এমন একটি ভাবনা- জীবন খুব ছোট, তাদের মনছবি হচ্ছে, ধন নয়, মান নয়, ছোট্ট একখানি বাসা, ছায়া সুনিবীড়, শান্তির নীড়। শুধু এতটুকু তাদের আশা। তারা জানে যার যত বেশি চাহিদা, তার সুখটা ঠিক তত কম। যার প্রাপ্তির আশা কম তার সুখশান্তি অনেক বেশি। এটা কোনো মনীষীর ধ্যানলব্ধ দর্শন নয়, সাধারণের ছোট একটি ভাবনা। দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের যারা ম্যান বিহাইন্ড দ্য মেশিন, তাদের ধ্যান জ্ঞান সাধারণের ঠিক বিপরীত। তাদের মনছবি হচ্ছে, জীবনটা অনেক দীর্ঘ। সঞ্চয় যার যত বেশি সুখ আনন্দ ঠিক ততটা দীর্ঘ সময় উপভোগ করা যাবে। অভিযোগ আছে, আমাদের রাজনীতি অঙ্গনের নায়ক-নায়িকা সম্পর্কে অনেকের মাঝে বদ্ধমূল হয়ে আছে। তাদের দেয়ার চেয়ে পাওয়াটা জীবনের প্রকৃত অর্থ। অথচ বিজ্ঞজনরা মনে করেন, এ মনছবি রাজনীতির সঠিক দর্শনের বিপরীত। যেমন, শহীদ জিয়া রাষ্ট্রকে দান করে মহৎ হয়েছেন। স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছেন। কিন্তু তার কি কোনো ঘরদুয়ার ছিল? আমাদের বিশেষায়িত নেত্রীর দেশে-বিদেশের ধনের কোনো হিসাব-নিকাশ ছিল না। তাকে তো কোনো কাক-পক্ষীও এখন স্মরণ করে না। তাকে নায়িকা নয় খলনায়িকা হিসেবে স্মরণ করে।

আবারো ফিরে যেতে চাই জীবনের অর্থ খুঁজতে। জীবনটা সত্যি অনেক দীর্ঘ। নিজেদের বংশলতিকার দিকে তাকাই, উত্তরসূরিদের কে সীমা অতিক্রম করতে পেরেছেন। সীমার মাঝে থেকে কে কিভাবে অনন্তকাল মানুষের হৃদয়ে ভাস্বর থাকে। তাদের এমন করে যুগে যুগে বেঁচে থাকার রহস্যটা কী? সহজ উত্তর- কেবল পরার্থে জীবন উৎসর্গ করা। এ দেশে শত শত রাজনীতিক আছেন এবং ছিলেন। তাদের ক’জনকে আজও স্মরণ করা হয় এবং দূর-অদূরভবিষ্যতে স্মরণ করা হবে। তবে শেরেবাংলাকে স্মরণ করে শত বছরেও লাখ লাখ নির্যাতিত-নিপীড়িত বর্গাচাষি। তিনি কৃষকদের স্বার্থে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভেস্তে দিয়েছিলেন। আজ আমাদের মাঝে এমন কোনো রাজনীতিক কি আছেন, যারা কাজ করে কালের কষ্টিপাথরে নিজের নামটি অক্ষয় করে রাখতে পারবেন। যে সুযোগ এখন এসেছে, তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কেবল নিজের মাঝে কাদা ছোড়াছুড়ি করে নিজেদের ব্যস্ত রেখে দেহটা কর্দমাক্ত করছেন। ইতিহাসের কোন্ স্তরে আজকের রাজনীতিকদের স্থান হবে। সেটি উপলব্ধি করা খুব কি কঠিন কাজ?