মহিউদ্দিন আহমদ
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান- সশস্ত্রবাহিনী বিশেষ করে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা, একটি জাতির মর্যাদা ও স্থিতিশীলতার প্রতীক। কিন্তু বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, শেখ হাসিনার বিগত সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও স্বার্থসিদ্ধির অভিযোগ উঠছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনীর ক্ষমতা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন, নজরদারি ও ভয় দেখানোর কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে গোয়েন্দা সংস্থার কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অপহরণ, গুম ও হত্যা মামলায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া চলছে। এ নজির শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ উদাহরণ নয়; বরং জাতীয় নিরাপত্তা কাঠামোর ওপর রাজনৈতিক প্রভাব এবং আইনের শাসনের অনুপস্থিতির প্রতিফলন।
অতএব, এসব অনিয়ম থেকে মুক্তি ও ভবিষ্যতে কোনো সরকার যেন একই পথ অনুসরণ করতে না পারে, সে জন্য এখন কাঠামোগত সংস্কার অপরিহার্য। এখন সময় এসেছে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী ও গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কলুষমুক্ত করে প্রকৃত অবস্থানে ফিরিয়ে আনার; এমন একটি কাঠামোতে, যেখানে বাহিনী থাকবে কেবল রাষ্ট্র ও সংবিধানের প্রতি অনুগত, কোনো ব্যক্তি বা দলের নয়।
১. কেন এ সংস্কার এখন জরুরি? বাংলাদেশে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের সঙ্কট দুই দিক থেকে দেখা দিচ্ছে। এক দিকে বাহিনীগুলোর ভেতরে পেশাদারি আস্থা ও নৈতিকতার ক্ষয়, অন্য দিকে বাহিনীর বাইরে জনগণের আস্থাহীনতা। এ দুই ক্ষেত্রে সমাধান একটাই, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামো রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত করে তাকে সংবিধান ও জাতীয় স্বার্থের প্রতি একনিষ্ঠ করা। এটি শুধু বাহিনীর পেশাদারত্ব উন্নয়নের প্রশ্ন নয়; বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র ও নিরাপত্তার জন্য একটি জাতীয় নিরাপত্তা সংস্কৃতি গঠনের অপরিহার্য পদক্ষেপ।
২. রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সেনাবাহিনী গঠনের দিকনির্দেশনা- ক. সিভিল-মিলিটারি কোড অব কনডাক্ট প্রণয়ন। খ. অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জন্য তিন থেকে পাঁচ বছরের কুলিং অব পিরিয়ড বাধ্যতামূলক। গ. সংসদীয় প্রতিরক্ষা কমিটি গঠন। ঘ. যোগ্যতাভিত্তিক পদোন্নতি ও নৈতিক মানদণ্ড নিশ্চিত করা।
৩. গোয়েন্দা সংস্থার অপব্যবহার ও ব্ল্যাকমেল বন্ধে ব্যবস্থা : গোয়েন্দা সংস্থার কাজ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা, রাজনীতিকদের নজরদারি নয়। এ জন্য দরকার সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও প্রযুক্তিনির্ভর জবাবদিহি। যেমন, বিচারিক অনুমোদন (জুডিশিয়াল ওয়ারেন্ট), ইমুটাবল অডিট লগ সিস্টেম, স্বাধীন ইন্টেলিজেন্স অম্বুডসম্যান অফিস, নিয়মিত রোটেশন ও আর্থিক স্বচ্ছতা যাচাই, এথিক্স অ্যান্ড কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স ট্রেনিং ইত্যাদি।
৪. জাতীয় নিরাপত্তা সংস্কার কমিশন (এনএসআরসি) গঠন : একটি স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ কমিশন, যার চেয়ারম্যান হবেন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বা জাতীয় ব্যক্তিত্ব। সদস্যদের মধ্যে থাকবেন সাবেক সেনাপ্রধান, আইন বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার ও প্রশাসনিক সংস্কার বিশেষজ্ঞ, পুলিশ কর্মকর্তা, অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ, সংসদীয় প্রতিনিধি ও আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা। এ কমিশন রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা কাঠামোকে জবাবদিহিমূলক, আধুনিক ও পেশাদাররূপে পুনর্গঠন করবে।
৫. অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে রাজনৈতিক সংলাপ : সংস্কার প্রক্রিয়া সফল করতে হলে সব রাজনৈতিক দলকে যুক্ত করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত দ্রুত সব দলকে নিয়ে ক্লোজ-ডোর ন্যাশনাল ডায়ালগ বা রুদ্ধদ্বার জাতীয় সংলাপের আয়োজন করা, যাতে চার্টার অব ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিটমেন্ট নামে একটি লিখিত অঙ্গীকারপত্রে সবাই স্বাক্ষর করেন।
৬. নিরাপত্তা ও গণতন্ত্রের ভারসাম্য : এ সংস্কারের লক্ষ্য বাহিনীর গোপনীয়তা নষ্ট করা নয়; বরং সিকিউরিটি উইথ অ্যাকাউন্টেবিলিটি -অর্থাৎ অপারেশনাল গোপনীয়তা বজায় রেখে স্বচ্ছতা ও নাগরিক আস্থা রক্ষা করা।
পরিশেষে আমরা এ কথা বলতে চাই যে, দেশের সশস্ত্রবাহিনী বিশেষ করে কোনো সেনাবাহিনী কখনো সত্যিকারের পেশাদার ও দেশের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত হতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তার ভেতরের অনৈতিকতা, অপব্যবহার ও রাজনৈতিক প্রভাব বন্ধের কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়া হয়। যেখানে জবাবদিহি নেই, সেখানে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে; আর শৃঙ্খলা ভেঙে পড়লে জাতীয় নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রের স্বাধীনতা বিপন্ন হয়। অতএব, এই সংস্কারের উদ্দেশ্য কোনো বাহিনীকে দুর্বল করা নয়; বরং নৈতিক ভিত্তি ও পেশাদারি মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। একটি দায়িত্বশীল, জবাবদিহিমূলক ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সশস্ত্রবাহিনী বিশেষ করে সেনাবাহিনী পারে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষার লৌহ-কবজ হয়ে দাঁড়াতে- এমন বাহিনী কেবল অস্ত্র ধারণ করে না; বরং দেশের মর্যাদা, ন্যায্যতা ও জনগণের আস্থার প্রতীক হয়ে থাকে।
লেখক : কানাডাপ্রবাসী মানবাধিকার কর্মী
 


