বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে সন্ত্রাস ও হত্যার ইতিহাস দীর্ঘ এবং বেদনাদায়ক। খাগড়াছড়িতে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী ঘটনা তারই অংশ। ব্রিটিশ শাসনের সময় এই অঞ্চল সরাসরি ব্রিটিশ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। তখন স্থানীয় পাহাড়ি রাজা ও সম্প্রদায়কে আঞ্চলিক শাসনের অধিকার দেয়া হয় এবং জমির মালিকানা ও প্রশাসনিক ক্ষমতা মূলত উপজাতীয় সমাজের হাতে রাখা হয়, ফলে তাদের সামাজিক কাঠামো ও স্বায়ত্তশাসন মজবুত ছিল। পাকিস্তান আমলেও পার্বত্যাঞ্চল অবহেলার শিকার হয়। সে সময় কেন্দ্রীয় শাসন স্থানীয় অধিবাসী ও বাঙালিদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে ‘বিভক্ত করো ও শাসন করো’ নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। এর ফলে জমি দখল, প্রশাসনিক নিপীড়ন ইত্যাদি কারণে সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয়। এক পর্যায়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে; তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষা অথবা বাইরের রাজনৈতিক প্রভাবে হত্যা, অপহরণ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
ষাটের দশকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে হাজার হাজার চাকমা ও অন্যান্য পাহাড়ি জনগণ বাস্তুচ্যুত হয়; অনেকে ভারতে ও মিয়ানমারে চলে যায়। এই বাস্তুচ্যুতি পার্বত্যাঞ্চলে সামাজিক-অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করে। অসন্তোষের বীজ বোনা হয়।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর প্রথম আওয়ামী সরকারের অধীনে পার্বত্যাঞ্চলে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে সেনা মোতায়েন করে স্থানীয় সশস্ত্র বিরোধী ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করা হয়। এতে বসতি স্থাপন প্রক্রিয়ায় কিছু নিরীহ বাঙালি পরিবারও লক্ষ্যবস্তু হয়। তখনকার সরকারের রাজনৈতিক সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা এই পরিস্থিতিকে রাজনৈতিকভাবে সমর্থন দিতেন এবং অনেক ঘটনাই স্থানীয় প্রশাসন ও মিডিয়ায় বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হতো; এতে পাহাড়ি জনগণের মধ্যে বিভাজন আরো গভীর হয়।
১৯৭২ সালে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসন, জমির অধিকার ও সরকারি উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিশ্চিতের দাবি তুলে ধরলেও সঙ্ঘাত থামেনি। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড ও পরবর্তী সামরিক শাসনের সময় পাহাড়ে সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যায়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সেনা অভিযান এবং স্থানীয় আওয়ামী নেতাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণে বহু বাঙালি ক্ষতিগ্রস্ত হন। এর পরও বিষয়টি বহুবার প্রান্তিকীকরণ, অস্বচ্ছতা ও বিভাজনমূলক প্রচারণার মধ্যে থেকে যায়, যেখানে দোষারোপের ধারাবাহিকতা শুধু স্থানীয় বাহিনী বা সেনাবাহিনীর ওপর সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং শাসক দলের নীতিরও ভ‚মিকা ছিল বলে অভিযোগ ওঠে।
পরের কয়েক দশকেও শান্তি অর্জিত হয়নি। ১৯৮০ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে পার্বত্যাঞ্চলে সন্ত্রাসীদের সাথে সংঘর্ষে প্রায় ৪০০ সেনা এবং তাদের হামলায় অন্তত ৩০ হাজার বাঙালি নিহত হয়। শত শত পরিবার বাস্তুচ্যুত ও সম্পদ ধ্বংসের শিকার হয়। ওই সময়ে তথাকথিত মানবাধিকারকর্মী, বামপন্থী ও ভারতপন্থী বুদ্ধিজীবীদের নীরবতা এবং কখনো উসকানিমূলক ভ‚মিকার অভিযোগ ওঠে। ফলে সঙ্ঘাত আরো জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি রূপ নেয়। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবে স্থায়ী সমাধান আনতে ব্যর্থ হয়েছে। এ চুক্তি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব বজায় রাখতে সাহায্য করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। চুক্তির প্রক্রিয়ায় ইউপিডিএফ ও জেএসএসকে আত্মনিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেয়া হয়েছে। কিছু বিশ্লেষক এটিকে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখেন।
চুক্তির পর অনেক জায়গায় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো স্থানীয় রাজনীতি ও প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করে; চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক দখলদারির ঘটনা নিত্যসংবাদে পরিণত হয়। একদিকে প্রশাসনিক উপস্থিতি দুর্বল হয়ে পড়ায় জনগণের নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অন্যদিকে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ বা বাইরের প্রভাব চুক্তিকে ব্যবহার করে স্বার্থসিদ্ধিতে লিপ্ত হয়। যদিও সরকারি নীতিতে প্রায়ই ‘পাহাড়িদের উন্নয়ন’কে গুরুত্ব দেয়া হয়, স্থানীয় বাঙালিদের দুরবস্থার বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যায়।
এই অঞ্চলের জনসংখ্যাগত ছবিও বিবেচ্য, যেমন, পার্বত্য তিন জেলায় প্রায় ১৪ লাখ মানুষের মধ্যে আনুমানিক ৫৯ শতাংশ বাঙালি ও ৪১ শতাংশ পাহাড়ি বলে বলা হয়। তবে এটা পরিষ্কার, বাঙালি ও পাহাড়ি উভয়ের উপস্থিতি গঠনগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। হাজার হাজার নিরীহ মানুষের হত্যার বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা আরো সাহসী হয়ে ওঠে এবং কিছু ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো রাষ্ট্রীয় আশ্রয়ও পেয়েছে, যা দেশের জন্য লজ্জাজনক। একই সাথে শিক্ষাগত দিক থেকেও কিছু পার্থক্য রয়েছে; বলা হয়, চাকমা জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষিতের হার তুলনামূলকভাবে বেশি এবং চাকমা নারীদের মধ্যে শিক্ষকতা পেশায় অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে, কয়েকটি এলাকার বাঙালি জনগোষ্ঠীর শিক্ষাগত হার কমে আসছে। এসব পার্থক্য প্রশাসনিক নীতিতে এবং উন্নয়ন উদ্যোগের বাস্তবায়নে প্রভাব ফেলে যেখানে কখনো বাঙালির দুরবস্থা উপেক্ষিত থেকে যায়। পাশাপাশি কিছু পাহাড়ি এলাকায় জমি লিজ দেয়া ও পরিচালনার প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, যা রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার ও নাগরিক অধিকারের দিক থেকে বিতর্কিত।
ইতিহাস ও নিরাপত্তা বিশ্লেষণের আলোকে দেখা যায়, ইউপিডিএফসহ কিছু সংগঠনের কার্যক্রমে বাইরের প্রভাব রয়েছে। বলা হয়েছে, প্রশিক্ষণ ও লজিস্টিক সাপোর্ট সীমান্ত পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ঘটে থাকতে পারে। সাম্প্রতিক খাগড়াছড়ি সঙ্ঘাতের প্রেক্ষাপটে অভিযোগ উঠেছে যে, ধর্ষণের একটি নাটক সাজিয়ে সঙ্ঘাত উসকে দেয়া হয়; যদিও মেয়েদের মেডিক্যাল প্রতিবেদন ও প্রাথমিক তথ্যগুলোতে ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি। এ ধরনের কৌশলগত বিভ্রান্তি ও ভ‚-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সামগ্রিকভাবে সমস্যাকে জটিল করে তোলে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা ইউপিডিএফের সন্ত্রাস বন্ধে তৎক্ষণিক ও সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন। গোয়েন্দা ও মাঠপর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী সূত্রবিহীনভাবে ছড়ানো মিথ্যা অভিযোগ, সীমান্তের বাইরের প্রশিক্ষণ ও সাহায্য ইত্যাদি প্রতিহত করতে হবে। তবে পুরোটাই কেবল শক্তি প্রদর্শন করে সমাধান না করে আইনশৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রমাণভিত্তিক তদন্ত, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, ক্ষতিগ্রস্তদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক ঐক্য রক্ষার কার্যকর ব্যবস্থাও প্রয়োজন। একই সাথে সামরিক ও সিভিল প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় জরুরি, যাতে নিরাপত্তা বজায় রেখে জনসাধারণের আস্থা পুনঃস্থাপন করা যায়।
বর্তমানে খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিতিশীলতা কমাতে সেনা ক্যাম্প ও ক্যান্টনমেন্ট বৃদ্ধির প্রস্তাব উঠেছে; বিশেষত কিছু সম্ভাব্য সুপারিশে খাগড়াছড়িতে ক্যাম্প সংখ্যা ২৫০-এ উন্নীত করার কথা বলা হচ্ছে। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির পরে সেনা ক্যাম্প কমানো হয়েছিল। সেনা উপস্থিতি বাড়ানোর বিষয়ে স্থানীয় মতামত, নিরাপত্তা পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও মানবাধিকার বিবেচনায় নেয়া উচিত।
সমস্যার মূলে আছে বহুমুখী ও জটিল ভূ-রাজনৈতিক অনুষঙ্গ। এই সঙ্কটকে কেবল জাতিগত বা ধর্মীয় দ্ব›দ্ব হিসেবে ব্যাখ্যা করা হলে বাস্তব সমাধান মিলবে না; এটি মূলত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও অংশগ্রহণমূলক নীতি-নির্ধারণের প্রশ্ন। বাংলাদেশের সংবিধানে পার্বত্যাঞ্চলকে ভিন্ন আইনি পরিচয়ে ভাগ করা হয়নি, সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। তাই সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত পুরো দেশের মানুষের সার্বিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
কর্তৃপক্ষ ও সমাজের ওপর এখন দায়িত্ব যে, পার্বত্যাঞ্চলে সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি সামাজিক বাতাবরণ পুনর্গঠন করা। এর মধ্যে রয়েছে তথ্যভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক ও ন্যায্য নীতি প্রণয়ন; কৃষি, বনজসম্পদ, ক্ষুদ্রশিল্প, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ; নারী ও তরুণদের শিক্ষার মাধ্যমে ক্ষমতায়ন; সীমান্ত তত্ত্বাবধান উন্নতকরণ ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সমন্বিত কৌশল গ্রহণ। এ ছাড়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে সন্ত্রাসবাদ ও চাঁদাবাজির সাথে জড়িত গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। রাজনৈতিক সংলাপ ও স্থানীয় অংশগ্রহণশীল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শান্তি প্রক্রিয়াকে স্থায়ীভাবে রিপেয়ার করা সম্ভব।
এই প্রেক্ষাপটে আমাদের পরামর্শ, পার্বত্য শান্তিচুক্তি নামক দেশের সার্বভৌমত্ববিরোধী কালো চুক্তি বাতিল করা অথবা পার্বত্য সমস্যার পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করে চুক্তি বা নীতি-নবায়ন করা। জনগণের আস্থাভিত্তিক নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রকে শক্ত মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে; কিন্তু সেই শক্তি প্রয়োগ মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাস্তবায়ন করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ; এখানে বসবাসকারী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও বাঙালি- সবাই বাংলাদেশের নাগরিক এবং সবার অধিকার সমান। যেকোনো বিভাজনমূলক শব্দ বা ধারণা জাতীয় ঐক্য ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী; তাই রাষ্ট্র ও সমাজকে মিলেই কাজ করতে হবে যাতে পাহাড়ে নিরাপত্তা, ন্যায্যতা ও উন্নয়ন একসাথে প্রতিষ্ঠিত হয়।
সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বারবার সতর্ক করেছে, সীমান্তের উভয় পাশে সংঘর্ষ-প্রবণতা ও স্বাধীনতাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রয়েছে; তাই সীমান্ত তত্ত্বাবধান আরো জোরদার, গোপনীয় গোয়েন্দা তথ্য কার্যকরভাবে ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমস্যার উৎস নির্ণয় ও সমাধান করা দরকার। একই সাথে গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী সমাজ ও মানবাধিকার কর্মীদেরও দায়িত্ব হলো সব পক্ষের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিতে কাজ করার।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট



