গত ৯ সেপ্টেম্বর দোহায় ইসরাইলি হামলার লক্ষ্য ছিল কাতারে থাকা হামাস নেতাদের হত্যা করা। হামাসের পাঁচ সদস্য ও কাতারের একজন নিরাপত্তাকর্মী এ হামলায় শহীদ হন। এ হামলা কাতারের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে, দেশটির নিরাপত্তা ও কূটনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে। ঘটনাটি স্বাভাবিক কূটনৈতিক ভাষা ও আন্তর্জাতিক আইনের বাইরে নতুন উত্তেজনা ছড়িয়েছে।
এ ঘটনায় আরব জনমানসে ও শাসক মঞ্চে তীব্রভাবে হাজির হয়েছে কিছু প্রশ্ন। প্রশ্নগুলো কেবল কাতার নিয়ে নয়, বরং প্রত্যেক শাসকের সাথে যুক্ত, যারা প্রতিরোধের বদলে আপসকে সমাধান মনে করছেন।
১. মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি রাষ্ট্র অনেক বছর ধরে মনে করেছে, আপস, নীরব সমর্থন বা নিরপেক্ষ ভঙ্গি তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। কিন্তু ইসরাইলের দোহা হামলার পর বোঝা গেল ধারণাটি একদম ভুল।
কাতার অনেক দিন ধরেই হামাস, তালেবান কিংবা পশ্চিমা শক্তির মধ্যে মধ্যস্থতার ভ‚মিকায় থেকেছে। তাদের ধারণা ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক এবং ইসরাইলের সাথে সরাসরি সঙ্ঘাতে না যাওয়াই নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। কিন্তু ইসরাইলি হামলা দেখাল, নিরপেক্ষতাই বরং কাতারকে অরক্ষিত করে তুলেছে। কারণ দেশটির প্রতিরক্ষা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল, আর যুক্তরাষ্ট্রই ইসরাইলকে হামলার সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে।
আব্রাহাম চুক্তি কিংবা সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে হাঁটতে গিয়ে আরব আমিরাত, বাহরাইন, সৌদি আরবের মতো দেশগুলো ভেবেছিল, ইসরাইলের সাথে আপস অর্থনৈতিক সুযোগ এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা আনবে। কিন্তু ইসরাইল আঞ্চলিক নিরাপত্তা-চিন্তাকে পাত্তাই দেয় না।
মিসর ও জর্দান বহু আগেই ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি করেছে। তারা ভেবেছিল, সীমান্তে স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি তাদের নিরাপত্তা বাড়াবে। বাস্তবতা হলো ইসরাইল গাজা বা পশ্চিমতীরে নতুন নতুন সামরিক পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং মিসর ও জর্দানে জনরোষ তৈরি হচ্ছে; অর্থাৎ তাদের আপসও নিরাপত্তার বদলে ঝুঁকি তৈরি করছে।
তুরস্ক এক দিকে ন্যাটো সদস্য, অন্য দিকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে সরব। কিন্তু সম্প্রতি তুরস্কও ইসরাইলি হামলার লক্ষ্য হয়েছে। ফলে স্পষ্ট, ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক আংশিক স্বাভাবিক হলেও তা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়নি।
ইরান আপসের বদলে প্রতিরোধ বেছে নিয়েছে। তাদের যুক্তি, আপস নয়, সামরিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধই প্রকৃত নিরাপত্তা দেয়। তাই ইরান আঞ্চলিক প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করে এবং সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ইসরাইলকে বার্তা দেয় যে, তারা অক্ষম নয়। এ অবস্থান আপাতত ঢাল হিসেবে কার্যকর হয়েছে, অন্তত প্রতিরোধের বিচারে। বস্তুত আপসের নীতি আক্রমণকারীর বিপরীতে ঢাল নয়, বরং তার জন্য সুযোগ।
দীর্ঘ চলমান সঙ্ঘাত ও অস্থিতিশীলতার কারণে সিরিয়াও আপস বা কূটনৈতিক নিষ্ক্রিয়তার ওপর নির্ভর করতে পারে না। ইসরাইলি হামলা সেখানে চলমান; যা প্রমাণ করছে যে, প্রতিরক্ষাবিহীন আপস দেশকে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে। সেখানে তুরস্কও জড়িয়ে পড়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলো দেখছে যে, তত্ত¡গত আপস আর বাস্তব অনুশীলনের মধ্যে গভীর বিভ্রম বিদ্যমান। আপস কেবল বাণিজ্যিক বা কূটনৈতিক সুবিধা দিতে পারে, নিরাপত্তা নয়। প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত স্থিতিশীলতা ছাড়া কেবল কূটনীতি বা চুক্তি আক্রমণ ঠেকাতে পারে না।
২. ইসরাইলের রাষ্ট্রতন্ত্রের জন্ম ১৯৪৮ সালে। শুরু থেকেই রাষ্ট্রটির নিরাপত্তার ন্যারেটিভ হলো আমরা অরক্ষিত। শত্রুরা আমাদের শেষ করে দিতে চায়। তাই প্রতিরোধ ছাড়া বাঁচা সম্ভব নয়। সে আগাম হামলার নীতি গ্রহণ করে। ১৯৪৮-এর আরব-ইসরাইল যুদ্ধ, ১৯৬৭-এর ছয় দিনের যুদ্ধ, ১৯৭৩-এর ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধ- প্রতিটি ঘটনাই ইসরাইলের কৌশলগত মানসিকতা তুলে ধরে যে, প্রথমে আক্রমণ, তার পর কূটনীতি।
ইসরাইল সবসময় আগ্রাসী সামরিক নীতি গ্রহণ করেছে, যা রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক আধিপত্য ও সম্প্রসারণ কৌশল হিসেবে বিকশিত হয়েছে। এখানে জায়নবাদী দর্শন মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। ইহুদি জাতীয় চেতনার ভিত্তিকে সে ব্যাখ্যা করেছে চুজেন পিপলস ও প্রমিজড ল্যান্ড তত্ত্বের হাত ধরে। কাতারে লক্ষ্যভিত্তিক সামরিক হামলা, গাজা ও পশ্চিমতীরে অভিযান, সবই এ ধরনের নিরাপত্তার যুক্তিতে সিদ্ধ।
কাতার বা সিরিয়ার মতো দূরবর্তী এলাকায় হামলা ইসরাইলের কাছে আগ্রাসন নয়, বরং তা প্রতিরক্ষামূলক কৌশল। তার ভাষায়, এরকম পদক্ষেপ হামাস বা অন্য শত্রুদের হুমকি কমাতে সাহায্য করে।
পশ্চিমারা এই দৃষ্টিকোণকে কখনো চ্যালেঞ্জ করেনি, বরং কৌশল হিসেবেই স্বীকার করেছে। তবে এই কৌশল আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা, মানবিক ঝুঁকি এবং আন্তর্জাতিক নৈতিকতার সাথে সঙ্ঘাত তৈরি করছে বলে মাঝে মধ্যে লোকদেখানো মৃদু নিন্দা করে।
৩. আরব ও ইসলামিক জনমনে এখন একটি তুলনা চালু হয়েছে : ইরানের ‘প্রতিরোধ’ বনাম কাতারের ‘আপস’ কোনটি বেশি কার্যকর? ইরান সম্প্রতি আঘাত করে বলেছে, সে স্থিতিশীলভাবে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু কাতারকে এখন প্রশ্ন করা হচ্ছে- নিন্দা ও কূটনৈতিক রোদনের অতিরিক্ত কী তারা করতে পারবে? প্রশ্নটি শুধুই কাতারের জন্য নয়; সব আরব শাসকের জন্য।
কাতারকে এবং একই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য আরব ও মুসলিম শাসকদের দ্রুতই একটি হাইব্রিড রোডম্যাপ গ্রহণ করতে হবে। যেখানে কূটনীতি, বহুপক্ষীয় আইনি-রাজনৈতিক আন্দোলন এবং বাস্তব প্রতিরক্ষা সক্ষমতার সমন্বয় থাকবে। এর কংক্রিট ধাপগুলো হতে পারে :
ক. অংশীদারত্বমুখী নিরাপত্তা সংস্থা (multinational security platform) গঠন- যেখানে পাকিস্তান, তুরস্ক, সৌদি আরব, কাতার প্রভৃতি দেশ অংশগ্রহণ করে সুনির্দিষ্ট প্রতিরক্ষা ভূমিকা পালন করবে।
দ্রুত প্রতিক্রিয়া ও পাল্টা ব্যবস্থার জন্য আঞ্চলিক ‘রিঅ্যাকশন-ফোর্স’ ও লজিস্টিক হাব দরকার। একক রাষ্ট্রের বাস্তব সীমাবদ্ধতার কারণে বহুপাক্ষিক প্ল্যাটফর্ম কার্যকর। সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা-চুক্তি এ অঞ্চলে দ্রুত কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাগত সংমিশ্রণ ঘটাচ্ছে। ন্যাটোর আদলে বহু রাষ্ট্রীয় যৌথতার দিকে যেতে হবে।
প্রথমত, ইমার্জেন্সি কমিটি গঠন (EAC) করা যেতে পারে। এতে কাতার, সৌদি, তুরস্ক, পাকিস্তান, মিসর প্রমুখের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। তাদের কাজ হলো, সিটুয়েশন রুম, রিয়েল-টাইম ইন্টেল শেয়ারিং এবং আংশিক মিলিটারি রেসপন্স কন্ট্রোল।
দ্বিতীয়ত, নির্দিষ্ট রোলে বিভাজন- প্রতিটি অংশীদারকে সক্ষমতা অনুযায়ী ভ‚মিকা বরাদ্দ করা হবে। যেমন লজিস্টিক-হাব, আকাশ-নিগ্রহ, বিশেষ অভিযানে কোর-টিম, মাইক্রো-মিসাইল ডিফেন্স প্রভৃতি। তুরস্কের কৌশলগত উপস্থিতি ও প্রশিক্ষণ; পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার-রূপায়িত প্রতিরক্ষা-প্রতিশ্রæতি, সৌদি আরবের অর্থনৈতিক সমর্থন, কাতারের কূটনৈতিক ভ‚মিকা ইত্যাদির সমন্বয়।
তৃতীয়ত, সুরক্ষা-বিধি ও আইনি ফ্রেমওয়ার্ক- অংশীদারত্বের জন্য মিউচুয়াল ডিফেন্স ক্লজ, অপারেশনাল রুলস অব এনগেজমেন্ট এবং ভবিষ্যৎ কনসেনসাস-মেকিং প্রক্রিয়া নির্ধারণ।
চতুর্থত, ফেজিং ও পাইলট- প্রথম ছয় মাসে একটি ‘পাইলট রিজিয়নাল রেসপন্স ব্যাটালিয়ন’ তৈরি; ৬-১৮ মাসে নেটওয়ার্ক ও অপারেশনাল ইন্টারঅপারেবিলিটি পরীক্ষিত হবে। এই প্রক্রিয়ায় ঝুঁকি ও সীমাবদ্ধতা মনে রাখতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা ও অংশীদারদের পারস্পরিক টেনশন একটি বাস্তব সমস্যা। সৌদি-কাতার-তুরস্ক-পাকিস্তানের আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক পজিশন। কৌশলগত ঘটনাপ্রবাহ এ আস্থাকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। নতুন সৌদি-পাকিস্তান চুক্তির সাম্প্রতিক উদাহরণ দেখাচ্ছে যে, রাজনীতিই হচ্ছে প্রাথমিক সীমা।
খ. ব্যয়ের কৌশলগত দায় (লিজ, ক্রয়-শেয়ারিং) ও অ্যাসিমেট্রিক প্রতিরক্ষা (ড্রোন-ডিফেন্স, সাইবার, স্পেশাল ফোর্স) এ বিনিয়োগ।
ছোট রাষ্ট্রের জন্য পুরোপুরি ব্যয়ভার নেয়া দুরূহ; তাই লিজিং, কনসোর্টিয়াম-ক্রয় ও অপারেশনাল-শেয়ারিং প্রক্রিয়া কার্যকর হওয়া উচিত। পাশাপাশি বর্তমান ও ভবিষ্যতের হুমকির জন্য অ্যাসিমেট্রিক সিস্টেম (ড্রোন-ডিফেন্স, কনট্র-ড্রোন, সাইবার, স্পেশাল-ফোর্স ট্রেইনিং) সবচেয়ে ব্যয়-সাশ্রয়ী (coste-effective) এবং উচ্চ-প্রভাবশালী ভূমিকা রাখবে।
এ ক্ষেত্রে কার্যক্রর পদক্ষেপ হিসেবে প্রথমত, মালিকানা ভাগাভাগির মতো প্ল্যাটফর্ম দরকার, যেখানে অংশীদাররা নির্দিষ্ট সমঝোতায় (লিজ/ভাড়ায়/রেন্টাল) রেডার, ড্রোন সিস্টেম ও পোর্টেবল এয়ার ডিফেন্স লিনিয়ার ভাড়া নেবে।
দ্বিতীয়ত, সময়ভিত্তিক অ্যাসিমেট্রিক প্রায়োরিটি-লিস্ট। এ হচ্ছে ছোট বা মাঝারি আকারের রাষ্ট্রকে বড় শক্তির মতো ট্যাংক-জেট-মিসাইলের বিশাল আর্মি না গড়েই কৌশলগত নিরাপত্তা জোরদার করার উপায়।
তৃতীয়ত, ড্রোন-ডিটেকশন ও ড্রোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা তথা শত্রু ড্রোন কোথা থেকে আসছে, কেমন ধরনের, সেটা শনাক্ত করার রেডার ও সেন্সর প্রযুক্তি, আর সাথে সাথে তা ধ্বংস বা নিষ্ক্রিয় করার ব্যবস্থা। শহরে বা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হঠাৎ আক্রমণ হলে, স্থায়ী বড় এয়ার-ডিফেন্স সিস্টেম যথেষ্ট হয় না; সেখানে মোবাইল বা হালকা মিসাইল তাৎক্ষণিক প্রতিরক্ষা দিতে পারে। ফলে প্রয়োজন হাতে বহনযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, যা ছোট জেট/হেলিকপ্টার/ড্রোন নামাতে পারে। Layered defence বা বড় আকাশ প্রতিরক্ষা (রেডারভিত্তিক) থেকে শুরু করে মাঝারি ও ছোট (পোর্টেবল মিসাইল) পর্যন্ত একাধিক স্তরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সাজানো।
চতুর্থত, আধুনিক হামলার বড় অংশ সাইবার আক্রমণ : ব্যাংক, এয়ারপোর্ট, বিদ্যুৎকেন্দ্র- সব কিছু অচল করে দেয়া যায়। ভৌত প্রতিরক্ষা শক্তিশালী হলেও সাইবার দুর্বলতা থাকলে রাষ্ট্র অচল হয়ে যায়। তাই প্রয়োজন সাইবার ডিফেন্স অপারেশন সেন্টার (regional-linked SOC)। এ হচ্ছে একটি কেন্দ্র, যেখানে ২৪/৭ সাইবার নিরাপত্তা নজরদারি হয়। কেবল এক দেশের নয়, বরং কয়েকটি দেশ মিলে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করবে, যাতে আক্রমণ শনাক্ত, ডেটা শেয়ার এবং তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ করা যায়।
মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ব্যাপকমাত্রায় হাইব্রিড যুদ্ধের শিকার হবে। এ যুদ্ধ এখন শুধু সীমান্তে আটকে নেই। ভেতরে স্লিপার সেল কাজ করে, ড্রোন কারখানা তৈরি হয়, হঠাৎ আক্রমণ ঘটে বা সাইবার-সন্ত্রাসও পরিচালিত হয়। শক্তিশালী কমান্ডো বাহিনী ও সঠিক গোয়েন্দা তথ্য ছাড়া তা সামলানো যায় না। ফলে প্রয়োজন স্পেশাল অপারেশনস ট্রেনিং। বিশেষ বাহিনীকে (কমান্ডো ইউনিট) আধুনিক প্রশিক্ষণ দেয়া, যাতে তারা দ্রুত আক্রমণ ঠেকাতে, উদ্ধার অভিযান চালাতে এবং শত্রুর ভেতরে গোপনে অভিযান চালাতে পারে।
পঞ্চমত, ফাইন্যান্সিং মেকানিজম। এ হচ্ছে ছোট ও মাঝারি রাষ্ট্রগুলোর জন্য বড়সড় সামরিক ক্রয়কে (যেমন- এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, স্যাটেলাইট নজরদারি, সাবমেরিন ড্রোন ইত্যাদি) অর্থনৈতিকভাবে সম্ভব করার একটি কৌশলগত ফান্ডিং মডেল। এর কয়েকটি ধাপ আছে। যেমন- কনসার্টিয়াম ফান্ড বানানো, যেখানে কয়েকটি রাষ্ট্র বা আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোট (যেমন- কাতার, ওমান, কুয়েত, এমনকি পাকিস্তান বা তুরস্ক) যৌথ ফান্ড তৈরি করবে। এর ফলে ক্রয়-বিল বা লিজ চুক্তি কিস্তিতে ভাগ হয়ে যাবে, আর ব্যয় শেয়ারড রিস্ক-ফান্ডিং এ পরিণত হবে। মাল্টি-ইয়ার কনট্র্যাক্ট করলে এক দিকে খরচ দীর্ঘমেয়াদে ছড়িয়ে যাবে, অন্য দিকে প্রযুক্তি আপডেট, রক্ষণাবেক্ষণ ও যৌথ প্রশিক্ষণ ধাপে ধাপে সম্পন্ন হবে। এর ফলে প্রতিরক্ষা বিনিয়োগ একবারের বড় বোঝা না হয়ে ক্যাশ-ফ্লো ম্যানেজেবল প্রজেক্ট হয়ে উঠবে।
Partial Ownership বা অংশ শেয়ারিং প্রক্রিয়াও কাজ দেবে। ছোট রাষ্ট্রগুলো পুরো সিস্টেমের মালিক হবে না; বরং তারা একটি অংশের শেয়ার রাখবে। যেমন সৌদি ও কাতার যৌথভাবে লং-রেঞ্জ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম কিনবে। কাতারের শেয়ার থাকায় সিস্টেম তার আকাশও কভার করবে। কিন্তু অপারেশনাল খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ, প্রশিক্ষণ, আপগ্রেড সবকিছুই শেয়ারড মডেলে চলবে। এই প্রক্রিয়ায় ঝুঁকি আছে। কৌশলগত বিবেচনা তাই জরুরি।
যেমন, ক. অস্ত্রকরণে বিদেশী নির্ভরতা বাড়লে স্বায়ত্তশাসন-সংশয় বাড়ে; তাই প্রযুক্তি-রূপান্তর (transfer of technology) ও লোক্যালাইজেশন-প্রচেষ্টা জরুরি। খ. নিয়ন্ত্রণ ও অপারেশনাল কোরেলেশন না থাকলে ডিভাইস বা সিস্টেমের কার্যকারিতা কমে যায়; সেহেতু ইন্টারঅপারেবিলিটি ট্রেনিং বাধ্যতামূলক।
গ. কূটনৈতিক ও আইনি অপশন কার্যকর করা- আন্তর্জাতিক আদালত, জাতিসঙ্ঘে কূটনৈতিক অভিযোজ্যতা এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ার ব্যবহার। কাতারে হামলার পরে আন্তর্জাতিকভাবে নৈতিক ও আইনি কেস গঠন করা জরুরি। সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের শাস্তি বিধানে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা-আচরণ, আন্তর্জাতিক আদালত ও রেজুলিউশনকে অ্যাকটিভ করতে হবে। একই সাথে মিডিয়ার ও ডিপ্লোম্যাটিক প্রোপাগান্ডা চালিয়ে ন্যারেটিভ নির্মাণ করতে হবে।
এই ধারায় প্রথমত, আইনি-টিম ও ডকুমেন্টেশন ইউনিট জরুরি। যার কাজ প্রমাণ-সংরক্ষণ (ইন্টেল ফিড, স্যাটেলাইট ইমেজ, ধ্বংসের চিত্র, সাক্ষ্য) করে আন্তর্জাতিক কোর্ট ও জাতিসঙ্ঘে উপস্থাপনযোগ্য ফাইল প্রস্তুত করা।
দ্বিতীয়ত, দূরদর্শী কূটনৈতিক প্রচারাভিযান। আন্তর্জাতিক মিডিয়া, মানবাধিকার কমিউনিটি, নিউট্রাল-এজেন্সিগুলোতে কেস অর্গানাইজ করা; পাশাপাশি বন্ধু রাষ্ট্র-অলাভজনক মিডিয়া চ্যানেল সক্রিয় করা।
তৃতীয়ত, আইনি রুট ম্যাপ- (ক) UNSC অ্যাকশন, (খ) আইসিজে/আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত অভিযোজন, (গ) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থায় অভিযোগ। এই প্রক্রিয়ায় ঝুঁকির দিক হলো বড় শক্তিগুলো কূটনৈতিক প্রভাব প্রয়োগ করে আইনি প্রক্রিয়ায় বাধা দিতে পারে। তাই দ্রুত এবং ব্যাপক কূটনৈতিক সমর্থন জরুরি। (ঘ) নাগরিকদের সহিষ্ণুতা বাড়ানো- তাদের যথেষ্ট নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং জরুরি সরবরাহের সক্ষমতা তৈরি।
সরকারি ও সামরিক প্রতিরক্ষা সবসময় শতভাগ কার্যকর হবে না। নাগরিক জীবন অব্যাহত রাখার নিশ্চয়তা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- আর্থিক সিস্টেম, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি। প্রতিপক্ষের যেকোনো আঘাতের পর জনমতের স্থিতিশীলতা রক্ষায় এটি অপরিহার্য।
দ্বিতীয়ত, সিভিল-ডিফেন্স প্রশিক্ষণ ও দ্রুত-রেসপন্স টিম, তথা শহর ও বন্দর এলাকায় গণনাগরিক রেসপন্স ড্রিল।
তৃতীয়ত, কমিউনিকেশন প্ল্যান-ক্রাইসিস-কমিউনিকেশন, মিথ্যাচার-প্রতিরোধ ও জনমত-ম্যানেজমেন্ট, যার কাজ হলো স্বচ্ছতা বাড়িয়ে গুজব মোকাবেলা ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ জয়।
চতুর্থত, নাগরিক আত্মরক্ষার প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী গঠন। নাগরিকদের সামরিক প্রশিক্ষণ।
কাতারকে অবশ্যই নিরাপত্তা সুরক্ষার দিকে যেতে হবে। সৌদি-পাকিস্তান নিরাপত্তা চুক্তি একটি বার্তা। এই আদলে বহুরাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ সংগঠিত করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে সম্মিলিত এমন নিরাপত্তা প্ল্যাটফর্ম যদি আরব ও তুর্কিদের পাশাপাশি ইরানকেও অঙ্গীভূত করতে পারে, তাহলে নিরাপত্তার ভারসাম্য মুসলিমদের অনুকূলে আসবে। বস্তুত কার্যকর নিরাপত্তা নীতি, সামরিক প্রস্তুতি ও কূটনৈতিক দক্ষতার সমন্বয়ই জরুরি। প্রমাণ করতে হবে কাতার যেভাবে বিরোধ নিরসনে দক্ষ, তেমনি বাস্তবিক অর্থে প্রতিরক্ষায় সক্ষম এক সার্বভৌম রাষ্ট্র।
লেখক : কবি, গবেষক