মুজিবকে উদ্ধারে ভারত কি হেলিকপ্টার পাঠিয়েছিল

এখন কথা হলো- বাড়ির একদম সামনে থেকে ছোড়া গোলা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার কথা নয়। হয় ভয় দেখানোর জন্য গোলাটি ছোড়া হয়েছিল, অথবা উড়ন্ত কোনো কিছুকে ভূপাতিত করার জন্য গোলা ছোড়া হয়েছিল। আসলে তখন কী ঘটেছিল তা অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সেনা কর্মকর্তা অথবা তখন যারা সেনাবাহিনীর উচ্চ পদে কর্মরত ছিলেন তারাই ভালো বলতে পারবেন।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সংঘটিত প্রথম সেনা-অভ্যুত্থানে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের অবিসংবাদিত নেতা ও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবার নিহত হন। তার ওই মর্মান্তিক মৃত্যু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। সে অভ্যুত্থানের কারণে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটে এবং বাংলাদেশ ভারতের প্রভাববলয় থেকে বেরিয়ে এসে নতুন পথে যাত্রা শুরু করে। ওই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপরই চীন ও সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।

ওই ঘটনার পাঁচ দশক পর ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুথানে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটে এবং প্রবল প্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রী হাসিনা হেলিকপ্টারে চড়ে ভারতে পালিয়ে যান। হাসিনা যদি সে সময় বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় দেশ ছেড়ে না পালাতেন তাহলে তাকেও হয়তো মুজিবের মতো করুণ পরিণতি বরণ করতে হতো।

হাসিনার পলায়নের পর ভারতের সেনাপ্রধান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, হাসিনার পলায়ন নিরাপদ ও নিশ্চিত করার জন্য তিনি বাংলাদেশ সেনাপ্রধানের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ বজায় রেখেছিলেন। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে- হাসিনাকে বাঁচানোর জন্য ভারত যে ধরনের তৎপরতা চালিয়েছে; শেখ মুজিবকে বাঁচানোর জন্য তারা সে ধরনের কোনো তৎপরতা চালিয়েছিল কি না? বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (জঅড) মুজিবকে সম্ভাব্য সেনা-অভ্যুত্থানের ব্যাপারে সতর্ক করেছিল; কিন্তু মুজিব তা বিশ্বাস করেননি। বছর দশেক আগে ভারতের একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা তার একটি লেখায় দাবি করেছেন, মুজিব ও তার পরিবারকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার জন্য ভারত একটি হেলিকপ্টার পাঠিয়েছিল; কিন্তু হেলিকপ্টারটিকে গুলি করা হলে পাইলটসহ সব যাত্রী নিহত হয়। ভারতীয় ওই সেনা কর্মকর্তার নাম লে. কর্নেল কেশব এস পুনটামবেকার।

আর যে বইয়ে তার লেখাটি ছাপা হয়েছে তা হচ্ছে- ‘খরনবৎধঃরড়হ ইধহমষধফবংয-১৯৭১’। ২০১৫ সালে ইষড়ড়সংনঁৎু ওহফরধ থেকে প্রকাশিত ওই বইটি সম্পাদনা করেছেন ভারতের মেজর জেনারেল ধ্রুব সি কাটোচ ও বাংলাদেশের লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির। ধ্রুব সি কাটোচ অবসর গ্রহণের পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর থিংক ট্যাংকের সাথে জড়িত ছিলেন এবং বর্তমানে নিরাপত্তা-বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করেন। কাজী সাজ্জাদ আলী জহির মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক অনেকগুলো গ্রন্থের প্রণেতা। তিনি নিজেও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সাহসিকতার জন্য তাকে ‘বীর প্রতীক’ উপাধি দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি হাসিনার আমলে ‘স্বাধীনতা পদক’ পান এবং ভারত সরকারের কাছ থেকে ‘পদ্ম শ্রী’ পুরস্কার লাভ করেন।

পুনটামবেকার ৪৩ ুবধৎং খধঃবৎ : জবারংরঃরহম ঃযব ধিৎ-শীর্ষক তার ওই স্মৃতিকাহিনীর শেষাংশে লিখেন- ঘড়ঃ সধহু ঢ়বড়ঢ়ষব ৎবসবসনবৎ ঃযধঃ ড়হ ঃযধঃ ভধঃবভঁষ ফধু, ধহ ওহফরধহ অরৎ ঋড়ৎপব যবষরপড়ঢ়ঃবৎ, ংবহঃ ঃড় বাধপঁধঃব ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ ধহফ সবসনবৎং ড়ভ যরং ভধসরষু, ধিং ধষংড় ংযড়ঃ ফড়হি ধং রঃ ষধহফবফ হবধৎ ঃযব যড়ঁংব ধহফ ঃযব বহঃরৎব পৎবি ধিং শরষষ রহ ঃযব ভধরষবফ ৎবংপঁব নরফ. (চধম : ২৭৩-২৭৪).

এখন কথা হলো- বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাস-বিষয়ক প্রকল্পের পরিচালক লে. কর্নেল সাজ্জাদ আলী জহির যেহেতু বইটির সম্পাদনার সাথে জড়িত ছিলেন সে কারণে এটি ধরে নেয়া যায়, তিনি বিষয়টি অবগত আছেন। বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকার এ ধরনের কোনো ঘটনার কথা জানা না গেলেও ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রামগতিতে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে কয়েকজন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায় মরহুম মাহবুব তালুকদারের লেখা ‘বঙ্গভবনে পাঁচ বছর’ গ্রন্থে। মাহবুব তালুকদার ১৯৭৫ সালে প্রেসিডেন্টের সহকারী প্রেস সচিব ছিলেন এবং জীবনের শেষভাগে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি লিখেন- ‘ইতোমধ্যে এলো দুঃসংবাদ। রামগতিতে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার ভেঙে পড়েছে। নিহত হয়েছেন কয়েকজন ভারতীয় সেনা। বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় দূতাবাসের সাথে আমাদের কিছুটা মতদ্বৈধতা দেখা দিয়েছে। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জে এন দীক্ষিত বলেছেন, সংবাদটি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া ঠিক হবে না। আব্দুল তোয়াব খান বললেন, এ বিষয়টি আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্ত জানানো হবে। বিষয়টি নিয়ে প্রেস সচিব অত্যন্ত পেরেশানিতে পড়ে গেলেন।

...পরে তার মনে হলো- এই সিদ্ধান্তটি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আসা প্রয়োজন। তিনি ফোন করলেন বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুমি আমার অফিসে গিয়া রেড টেলিফোনে আমারে ফোন করো’। তোয়াব খান বঙ্গবন্ধুর অফিসকক্ষে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এলেন তিনি। কী কথা হয়েছে আমি জানি না। এর মধ্যে আবার ভারতীয় দূতাবাস থেকে ফোন এলো। তোয়াব খান জানালেন, দুর্ঘটনার খবরটি পত্রিকায় জানাতে হবে। নইলে দেশবাসীর মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। ভারতীয় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানালেন, তিনি বিষয়টি সম্পর্কে দিল্লির সাথে কথা বলেছেন। প্রেস সচিব বললেন, আমরা উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এমতাবস্থায় আমাদের সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে। এ দিকে ২০২১ সালে ১৫ আগস্ট ডেইলি স্টারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ ভারতীয় হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার বিষয়ে বলেন, একটি ভারতীয় হেলিকপ্টার ফেনীতে শকুনের সাথে সংঘর্ষে বিধ্বস্ত হয় এবং কপ্টারটিতে অবস্থানরত সব ক’জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়। হেলিকপ্টারটি চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় সদ্য মাথাচাড়া দেয়া শান্তিবাহিনীর কার্যক্রমের ওপর নজর রাখার জন্য বাংলাদেশকে দেয়া হয়েছিল এবং নিহত সেনারা তখন ভারতের স্বাধীনতা দিবসে যোগদানের জন্য দেশে যাচ্ছিল। জেনারেল সফিউল্লাহর সাক্ষাৎকারে যে নতুন তথ্যটি পাওয়া যায় তা হচ্ছে- পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর তৎপরতার ওপর নজরদারি করার জন্য ভারত বাংলাদেশকে হেলিকপ্টারটি দিয়েছিল।

হেলিকপ্টারটি যদি বাংলাদেশকে দেয়াই হয়ে থাকে তাহলে পাইলট ও অন্যরা ভারতীয় কেন হবে? বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে কি পাইলটের এতই অভাব ছিল? আবার ভারত সরকারই বা খবরটি চেপে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিচ্ছিল কেন? হতে পারে- শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে ভারত বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করছে, এ খবরটি প্রকাশিত হলে ভারতকে বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে। কারণ ভারতই ছিল শান্তিবাহিনীর নেপথ্য পরিচালক। ভারতীয় বিমানবাহিনীর দুর্ঘটনা-সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রে ১৪ আগস্ট রামগতির হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার কথা থাকলেও ১৫ আগস্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার কোনো তথ্য নেই। এ থেকে বোঝা যায়, ১৫ আগস্ট ধানমন্ডিতে কোনো হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা ঘটেনি। অবশ্য কারো কারো ধারণা, শেখ মুজিবকে উদ্ধার করার জন্য হেলিকপ্টার পাঠানো ছিল একটি গোপন সেনা-অভিযানের অংশ। সে কারণে সেই তথ্য যে গোপন রাখা হবে, সেটিই স্বাভাবিক। আর ব্যর্থ সেনা-অভিযানের বিষয় কেউই কখনো প্রকাশ্যে আনতে চায় না। সাফল্যের অনেক অংশীদার থাকে, ব্যর্থতার নয়।

এ ছাড়া ১৫ আগস্ট সংঘটিত আরেকটি ঘটনাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সেদিন মর্টার অথবা কামানের গোলার আঘাতে মোহাম্মদপুরে ১৩ জন নিহত হয়। বলা হয়, শেখ মুজিবের বাড়িকে লক্ষ্য করে ছোড়া একটি গোলা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে মোহাম্মদপুরে আঘাত হানে। এখন কথা হলো- বাড়ির একদম সামনে থেকে ছোড়া গোলা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার কথা নয়। হয় ভয় দেখানোর জন্য গোলাটি ছোড়া হয়েছিল, অথবা উড়ন্ত কোনো কিছুকে ভূপাতিত করার জন্য গোলা ছোড়া হয়েছিল। আসলে তখন কী ঘটেছিল তা অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সেনা কর্মকর্তা অথবা তখন যারা সেনাবাহিনীর উচ্চ পদে কর্মরত ছিলেন তারাই ভালো বলতে পারবেন।