ইরান দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত একটি দেশ। দেশটি বিশ্বের অন্যতম খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসসমৃদ্ধ। দেশটির অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তেল।
ইরান পৃথিবীর বৃহৎ সভ্যতাগুলোর অন্যতম। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে পারস্য ছিল তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য। আর বর্তমানের ইরান ছিল সেই সাম্রাজ্যের মূল প্রাণকেন্দ্র। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত এটি টিকে আছে। প্রতœতাত্তি¡ক গবেষণার ভিত্তিতে পারস্যের ইতিহাসের সূচনা ধরা হয়েছে আজ থেকে প্রায় এক লাখ বছর আগে। সপ্তম শতাব্দীতে আরবরা ইরান জয় করে। এর পর প্রায় দুই শতাব্দী ধরে ইরান আরব ইসলামিক সাম্রাজ্যের অধীন একটি সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। এ সময় বর্তমান পশ্চিম আফগানিস্তানের হেরাতেও এই সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটেছিল। ইসলামের খলিফারা প্রথমে মদিনা থেকে ও পরবর্তীকালে সিরিয়ার দামেস্ক ও শেষ পর্যন্ত ইরাকের বাগদাদ থেকে ইরান শাসন করতেন। নবম শতাব্দীর শেষে এসে পূর্ব ইরানে স্বাধীন রাজ্যের আবির্ভাব ঘটে। ১১০০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইরান বাগদাদের শাসন থেকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়। অর্থাৎ আরব খলিফারা ইরানের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। দীর্ঘ এ কয়েক শ’ বছরের মধ্যে ইরানিরা ধীরে ধীরে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। দশম শতকের মধ্যেই ইরানের অধিকাংশ জনগণ মুসলিম হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৫০১ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ইরান ছিল রাজতান্ত্রিক দেশ। এ সময় ইরান শাসিত হতো শাহ কিংবা অন্য রাজাদের দ্বারা। ১৯৭৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়। এ সময় ইরানের আধিকাংশই ছিল সুন্নি মুসলিম, তবে কেউ কেউ শিয়া হিসেবে ইসলামের ভিন্ন ভিন্ন ধারা অনুসরণ করত। ইরানের ইতিহাসজুড়ে যুদ্ধ এবং সামরিক সঙ্ঘাতের একটি দীর্ঘ ধারা দেখা যায়। প্রাচীন পারস্য সাম্র্রাজ্য থেকে শুরু করে আধুনিক ইরান পর্যন্ত, দেশটি বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধ ও বিজয়ের সাক্ষী হয়ে আছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো- আশির দশকে ইরাকের সাথে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের সময় ইরান বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সত্তে¡ও আত্মসমর্পণ করেনি, যা তাদের মধ্যে একটি দৃঢ় প্রতিরোধক মনোভাব দেখা যায়। ইরানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির সহাবস্থান রয়েছে। বর্তমান ইরানের জনসংখ্যার বড় অংশ শিয়া এবং তাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবনে একটি শক্তিশালী ভূমিকা রয়েছে।
সুতরাং ইরানিরা ঐতিহাসিকভাবে যোদ্ধা জাতি হিসেবে পরিচিত। তাদের মধ্যে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির মিশ্রণ রয়েছে। তথাপি জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। অবশ্য ইরান শুধু যোদ্ধাদের জন্য বিখ্যাত নয়; বরং এটি একটি সমৃদ্ধ সভ্যতার ধারক, সাহিত্যের পীঠস্থান এবং আত্মমর্যাদায় বলীয়ান জাতির প্রতিচ্ছবি। এখানে একই সাথে গজলের সুর, কবিতার ছন্দ আর যুদ্ধের দামামা যুগপৎভাবে ধ্বনিত হয়ে আসছে সেই আদিকাল থেকে। ইরানিদের আত্মপরিচয়ের ভিত্তি গড়ে উঠেছে তাদের সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতার ওপর। ফেরদৌসি, আল্লামা হাফিজ, ওমর খৈয়াম ও জালালুদ্দিন রুমির মতো কবিদের জন্ম এই ইরানে। আজও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠ করা হয় তাদের সৃষ্ট গজল, সুর, ছন্দ, কবিতা, প্রেম, ধর্ম, দর্শন, মরমিবাদ, ঈশ্বর, রাজনীতি এমনকি যুদ্ধবিষয়ক রচনাও।
ইরানিদের নিত্যদিনের সঙ্গী গজল বা কবিতা। কেউ প্রেমের অনুভূতি প্রকাশে হাফিজের কবিতা পড়েন, বিষাদগ্রস্ত হলে পড়েন ওমর খৈয়ামকে। আবার সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান আয়োজনেও কবিতা বা গজলের উদ্ধৃতি উচ্চারিত হয়। একজন ইরানি সন্তান শৈশব থেকেই রুমির সুর-ছন্দে গড়ে ওঠে এবং কৈশোরে ইতিহাস পাঠের পাশাপাশি কাব্যের গূঢ় রস আস্বাদন করে। তবে বর্তমান ইরানের পরিচিতি ও আলোচনা ভিন্ন কারণে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র হলেও বহু মুসলিম দেশের কাছে রাজনৈতিকভাবে ইরান একঘরে। শিয়া-সুন্নি বিভাজন, পারস্য-আরব বৈরিতা ও ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের কৌশল তাকে এক ঘোরতর একাকিত্বে ঠেলে দিয়েছে। গত ১৩ জুন থেকে ইসরাইল ইরানের বিভিন্ন সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় ধারাবাহিক বিমান হামলা চালিয়েছে। এ হামলায় ইরানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ছয় শতাধিক ইরানি নিহত হয়েছেন। সিনিয়র পরমাণুবিজ্ঞানীরা শহীদ হয়েছেন। ইসরাইলের দাবি মতে, ইরান নাকি পারমাণবিক বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। অথচ আমেরিকা ও ইউরোপের বহু দেশ পারমাণবিক বোমার মালিক। তারা এ নিষিদ্ধ কাজ করতে পারলেও অন্য কোনো দেশ পারবে না। মুসলিম দেশ হলে তো নয়ই।
যাই হোক, ইসরাইলের হামলার জবাবে ইরানও ইসরাইলে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। ৭৭ বছরের দম্ভ চুরমার করে দিয়ে ইরান ইসরাইলকে সমুচিত জবাব দিয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে নেতানিয়াহুসহ তার দেশের জনগণ বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ইসরাইলের জন্য এটি ছিল রীতিমতো জাহান্নামের পরিবেশ। নিজে সামাল দিতে না পেরে নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রকে এই যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্ররোচিত করেন ইরানে হামলা করতে। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং গত ২২ জুন ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালায়। জবাবে ইরান উপসাগরীয় বিভিন্ন দেশে স্থাপিত মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে পাল্টা হামলা চালায়। ফলে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উপর্যুপরি ইরানি মিসাইল হামলায় দিশেহারা হয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। হামলা-পাল্টাহামলা চলমান থাকে দীর্ঘ ১২ দিন। দিশেহারা হয়ে নেতানিয়াহু ও ডোনাল্ড ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান।
যখন ইসরাইল ইরানের ভূখণ্ডে আক্রমণ করল, তখন ইরানের প্রতিরোধচেতনা একটি বৈশ্বিক প্রতিবাদী প্রতীকে পরিণত হলো। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এটি ছিল ইরানের একক প্রতিক্রিয়া। মধ্যপ্রাচ্য একটি বিশাল শক্তি হলেও শুধু নিন্দা জানানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল।
ইরান যদি পাশ্চাত্যের মিত্র হতো, তাহলে ইসরাইলের এই হামলাকে জাতিসঙ্ঘ ‘যুদ্ধাপরাধ’ বলে ঘোষণা করত। কিন্তু বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসঙ্ঘের নীতিমালা শুধু শক্তিশালী রাষ্ট্রকে আরো শক্তিশালী করার জন্য। আর দুর্বলকে আরো দুর্বল করার জন্য, মুসলিমদেরকে নিঃশেষ করার জন্য। এখানেই মুসলিম বিশ্বের দুর্ভাগ্য যে, তারা নিজেদের জনসংখ্যা, অর্থনীতি ও ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী এক বড় শক্তি হওয়া সত্তে¡ও রাজনৈতিকভাবে অবহেলিত।
যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, যদিও ইউক্রেন যুদ্ধের সময় তারা রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক আইন ভাঙার জন্য দায়ী করেছিল। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর উচিত ছিল এই দ্বিচারিতা তুলে ধরা এবং সম্মিলিতভাবে বিশ্ব-ফোরামে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া- কিন্তু তারা তা পারেনি।
এমতাবস্থায় প্রশ্ন হলো, মুসলিম উম্মাহ কি আদৌ কোনো জীবন্ত সত্তার নাম? ওআইসি কি সত্যিকার অর্থে কোনো কার্যকর সংগঠন? যদি ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, আফগানিস্তান ও ইরান- সবখানে মুসলিমের রক্ত ঝরে, আর মুসলিম রাষ্ট্রনেতারা চুপ থাকেন, তবে এই উম্মাহ কি কেবল ধর্মীয় রোমান্টিকতাবাদে আবদ্ধ? সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে হয়তো একধরনের সহমর্মিতা রয়েছে; তারা বিক্ষোভ করেন, দোয়া করেন, তহবিল পাঠান; কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতিতে তার প্রতিফলন নেই।
মনে রাখা দরকার, আমেরিকা একটি যুদ্ধবাজ দেশ। যুদ্ধ ওদের জাতীয় ব্যবসায়। তার জাতীয় আয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে যুদ্ধ ব্যবসায় থেকে! ২৩৫ বছর ধরেই তারা যুদ্ধে লিপ্ত। গোটা বিশ্ব তাদের নিয়ন্ত্রণে। গোটা মধ্যপ্রাচ্য আমেরিকার গোলাম হয়ে আছে। ইরান গত চার দশক ধরে একঘরে। ইউরোপ ও আমেরিকা ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। এই নিষেধাজ্ঞাই ইরানকে সর্বদিক থেকে স্বাবলম্বী করে তুলেছে। বিশেষ করে পারমাণবিক গবেষণার ক্ষেত্রে ইরান অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে আমেরিকা ও ইসরাইলকে ইরান যথেষ্ট শিক্ষা দিতে পেরেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান শাহাব-১৬ নামে একটি ক্ষেপণাস্ত্র আবিষ্কার করতে যাচ্ছে, যার আওতা হবে পাঁচ হাজার কিলোমিটার! এ খবরে আতঙ্কিত ইউরোপ, আমেরিকা ও ইসরাইল। এসব কারণে আমেরিকা ও ইসরাইলের সুর নরম হয়েছে।
ইরান একাই লড়াই করল ইউরোপ, আমেরিকা ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে। মুসলিমবিশ্ব তার পাশে এগিয়ে এলো না; বরং ইরানবিরোধী ফতোয়া বেশ জোরালোভাবে প্রকাশ পেল। অদূর ভবিষ্যতে ইরান যদি সত্যিই বিশ্বের অন্যতম শক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ায় তখন ইরানবিরোধী ফতোয়ার কোনো পরিবর্তন হবে কি? এমন প্রশ্ন চিন্তাশীল মানুষের মনে।
পরিশেষে বলতে চাই, যুদ্ধ আর প্রতিরোধের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে চলেছে ইরান। তাদের সেই পথচলা শেষ হয়নি এখনো। বোধ করি এ পথ শেষ হওয়ার নয়। উল্লেখ্য, সপ্তম শতাব্দীতে আরবদের ইরান বিজয়ের পরও তাদের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বৈশিষ্ট্য অটুট ছিল, সেটি এখনো আছে। ইরানিরা তাদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে বদ্ধপরিকর। ইরানের জনগণ, বিশেষ করে তরুণরা তাদের স্বাধীনতা, ভাষা ও জাতীয় ঐতিহ্য রক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে উদগ্রীব। তারা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত। এ জন্যই তারা অজেয়।
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া