রোহিঙ্গা সঙ্কটের কাহিনীকে বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ থেকে আলাদা করে দেখা যায় না। ভারতের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে সুরক্ষিত করা এবং নাজুক শিলিগুড়ি করিডোরকে বাইপাস করা। এই লক্ষ্যেই তারা নেয় কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প, যা মিজোরামকে মিয়ানমারের সিত্তওয়ে বন্দরের সাথে যুক্ত করে। এই রুটটি রোহিঙ্গাদের জন্মভূমি রাখাইন রাজ্যের ভেতর দিয়ে গেছে। প্রকল্পটি নির্বিঘ্নে চালানোর জন্য রাখাইন থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করাকে মিয়ানমারের জান্তা ও তাদের ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকরা প্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবে দেখেছিল। দীর্ঘ দিন ধরে প্রান্তিক ও নির্যাতিত রোহিঙ্গারা এভাবে বৃহত্তর কূটনৈতিক খেলায় কেবল একেকটি ঘুঁটি হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ হয়ে ওঠে এদের অনিবার্য আশ্রয়স্থল। ২০১৭ সালের মহাপ্রবাহে সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা কয়েক মাসের মধ্যে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ দরজা খুলেছিল মানবিক কারণে, মুসলিম উম্মাহর অংশ হিসেবে এটি একটি দায়িত্ব বলেই। কিন্তু এই মানবিক মুখোশের আড়ালে ছিল হিসেবি রাজনৈতিক ও পররাষ্ট্রনীতি। শেখ হাসিনার সরকার, যা ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর থেকেই দিল্লির কাছে ঋণী ছিল, এই সঙ্কটকে ভারতের মনোরঞ্জন এবং আন্তর্জাতিক মহলে নিজের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করার সুযোগ হিসেবে দেখেছিল। শাহিদুল হক ও গওহর রিজভির মতো উপদেষ্টারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন- যদি তিনি নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেন, তবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের দরজা খুলে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক লবিং, গণমাধ্যমে প্রচারণা ও বিদেশ সফরের আয়োজন হয় জনগণের টাকায় এই ইমেজ তৈরির জন্য।
কিন্তু বাস্তবতা ছিল কঠোর। একসময়ের বলিষ্ঠ সীমান্তরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশ রাইফেলস-বিডিআর, যারা বিএসএফের চোখে চোখ রেখে দাঁড়াত, ২০০৯ সালের বিডিআর হত্যায় ভেঙে পড়ে। অফিসার কর্পস নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, নাম পাল্টে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি, আর অস্ত্রাগারও সীমিত করা হয়। এই পুনর্গঠন এমনভাবে করা হয় যাতে সীমান্ত আর কখনো পরিকল্পিত গণপ্রবাহ ঠেকাতে না পারে। ২০১৭ সালে যখন রোহিঙ্গার ঢল নেমে আসে, তখন দুর্বল বিজিবির না রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছিল, না সামরিক শক্তি। সীমান্ত দুর্বল করার এ নীতি বাংলাদেশকে ভারতের ও মিয়ানমারের বোঝা বইবার পথে ঠেলে দেয়।
আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো ঢাকার উদারতাকে প্রশংসা করলেও প্রকৃত সমর্থন দেয়নি। ভারত চোখ ফিরিয়ে নিলো, চাইল রোহিঙ্গারা বাংলাদেশেই থেকে যাক। চীন কূটনৈতিক হাসি দিয়ে আশ্বাস দিলেও মিয়ানমারকে চাপ দিতে কখনোই অঙ্গীকারবদ্ধ হয়নি। আসিয়ান দেশগুলো, যারা নিজেরাও সংখ্যালঘু সমস্যায় জর্জরিত, নীরব ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ কেবল বক্তব্য দিলো; কিন্তু প্রত্যাবাসনের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিলো না। বাংলাদেশ একা পড়ে গেল, এক বিশাল মানবিক বোঝা কাঁধে নিয়ে, বিনিময়ে কোনো ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা ছাড়াই। এর ফলাফল ভয়াবহ। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলো হয়ে উঠেছে মাদকপাচার, অস্ত্রব্যবসায় ও উগ্র কার্যকলাপের কেন্দ্রস্থল। স্থানীয় জনগোষ্ঠী বিপর্যস্ত, তাদের জমি ও সম্পদ হুমকির মুখে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক, আর সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে সঙ্কট সামলাতে। যে বিষয়টি আন্তর্জাতিক মর্যাদার সোপান হবে ভেবেছিল, সেটিই পরিণত হয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার স্থায়ী ক্ষতে।
এখন পথ খুঁজতে হবে সৎভাবে ও সাহসের সাথে; কিন্তু সেখানে ‘শক্তি’ বোঝাতে গেলে তা কেবল বন্দুক কিংবা আত্মরক্ষার সরঞ্জামেই সীমাবদ্ধ রাখলে সমস্যা বাড়বে। প্রথমত, রোহিঙ্গাদের সংগঠিত করা মানে হচ্ছে তাদেরকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইনি ক্ষমতা দেয়া : গ্রামীণ-স্তরের নেতৃবৃন্দ, কমিউনিটি লিগ্যাল ক্লিনিক, ভোট-নির্ভর নয় এমন প্রতিনিধিত্বমূলক কাউন্সিল গঠন করতে হবে, যাতে তারা নিজস্ব দাবি স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে উপস্থাপন করতে পারে। এ নেতৃত্বকে ক্রেডিবল রাখতে দরকার নাগরিক শিক্ষা, মানবাধিকার প্রশিক্ষণ, সঙ্ঘাত-সমাধান ও নেতৃত্ব গঠন- এগুলো দিয়ে তারা শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক দাবিতে সচেতন ভূমিকা রাখতে পারবে।
দ্বিতীয়ত, ‘প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা’ বলতে অধিক গুরুত্ব পাবে জীবন-যাত্রার দক্ষতা (vocationa), পুনর্গঠন দক্ষতা (construction, infrastructure, water-sanitation), আইনি সক্ষমতা (আধার-নথি তৈরি, নাগরিকত্ব সংরক্ষণের কৌশল)-এসব তাদের ফেরত হওয়ার পর দ্রুত পুনর্বাসনে কাজে আসবে।
তৃতীয়ত, নিরাপত্তীকরণে ‘সীমিত সামরিক সহায়তা’ বললে আমরা যা করতে পারি তা হলো- আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে অঘাতক বা সীমাবদ্ধ সুরক্ষাব্যবস্থা গঠন যেমন- ট্রান্সপারেন্ট মনিটরিং, আঞ্চলিক পর্যবেক্ষক ফোর্স (UN/অন্তর্বর্তী মিশন) বা প্রশিক্ষিত কমিউনিটি-ভিত্তিক প্রটেকশন ইউনিট যারা কেবল আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখে এবং মানবাধিকার রক্ষার ওপর জোর দেয়। সরাসরি সশস্ত্র বা গেরিলা কৌশল শেখানো নয়; তার বদলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও non-lethal সুরক্ষা সরঞ্জাম, কমিউনিকেশন সিস্টেম ও সেফ হাউজ নেটওয়ার্কের মতো অঘাতক সহায়তা গ্রহণযোগ্য ও আইনসম্মত পথ।
চতুর্থত, কূটনৈতিক কৌশল সমান্তরালভাবে চলবে। বাংলাদেশকে চীন ও ভারতের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগাতে হবে, পারস্পরিক অর্থনৈতিক বা কৌশলগত সুবিধা বিনিময়ে মিয়ানমারকে পুনর্বাসন ও নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়ে কার্যকর চাপ তৈরি করতে হবে। একই সাথে UN, OIC ও আন্তর্জাতিক আদালত/কমিশনগুলো ধারাবাহিক, প্রমাণভিত্তিক কেস উপস্থাপন করে আন্তর্জাতিক আইন ও তত্ত্বাবধানে ফেরত এবং নিরাপত্তা-গ্যারান্টি দাবি করতে হবে। পেশাগতভাবে সংগৃহীত গণমাধ্যম, আইনগত ও মানবাধিকার রিপোর্ট এসব কাঠামোকে শক্ত করবে।
পঞ্চমত, প্রত্যাবাসনকে শর্তসাপেক্ষ, পর্যায়ভিত্তিক ও যাচাইযোগ্য করা হবে- নির্দিষ্ট অঞ্চল, নিরাপত্তা বেসলাইন, নাগরিকত্ব বা স্থায়ী বসতি-সংক্রান্ত চুক্তি দরকার। প্রত্যেক ধাপের জন্য তৃতীয় পক্ষ (UNHCR/IOM, আন্তর্জাতিক অডিটর) দ্বারা পর্যবেক্ষণ ও শর্তসাপেক্ষ তহবিল বরাদ্দ করা উচিত, যাতে রিটার্নিং কমিউনিটিগুলো পর্যায়ক্রমে বাসযোগ্য অবকাঠামো পায়।
ষষ্ঠত, অভ্যন্তরীণভাবে বাংলাদেশকে তার সীমান্তশক্তি পুনর্গঠন ও আধুনিকায়ন করতে হবে; কিন্তু এটি রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক তত্ত্বাবধানে। বিজিবির নেতৃত্ব পুনর্গঠন, গোয়েন্দা-তথ্য সঙ্কর (fusion) সেল গঠন, আধুনিক নজরদারি (satcom/radar/remote sensing বিস্তারিত প্রযুক্তিগত নির্দেশ এখানে দেবো না) এবং আইনের মানানসই প্রশিক্ষণে জোর দেয়া হবে, যাতে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ কেবল সামরিক নয়; বরং আইনি ও মানবাধিকারসম্মত হয়। এই পরিমার্জন জাতীয় সার্বভৌমত্ব ফিরে পেতে শক্তি জোগাবে।
সপ্তমত, হোস্ট-কমিউনিটিকে রক্ষা ও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে- স্থানীয় মানুষের জন্য পুনর্নির্মাণ তহবিল, স্কুল-স্বাস্থ্য বার্ধক্য, ছোট ব্যবসায় সহায়তা- ইত্যাদি যেন মূলনীতি হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়; এটি সামাজিক উত্তেজনা কমাবে এবং নিরাপত্তার এক উপাদান হিসেবেও কাজ করবে। অবশেষে, নৈতিক ও আইনি রূপকল্প বজায় রাখা জরুরি- রোহিঙ্গাদের এমনভাবে শক্তিশালী করা যাতে তারা আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় নিজ ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে। সামরিক কৌশল বা অস্ত্রায়ন নয়; বরং ক্লিয়ার স্ট্যান্ডার্ড, আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধান, দক্ষতা-বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব- এই চারটি স্তম্ভকে একসাথে চালিয়ে গেলে বাস্তবিকভাবে তারা তাদের ভূমি ফিরিয়ে পাওয়ার দাবি কার্যকর ও টেকসই হবে।
ইতিহাস প্রমাণ করে দিয়েছে- যে জাতি তার নিরাপত্তা বাইরের অনুমোদনের বিনিময়ে ত্যাগ করে, সে টিকে থাকতে পারে না। ১৯৭১ সালে লাখো বাংলাদেশী শরণার্থী হয়েছিল; কিন্তু শেষমেশ ফিরে এসেছিল স্বাধীন মাতৃভূমিতে। আজ রোহিঙ্গারাও সেই সুযোগ পাওয়ার যোগ্য- ফিরে যাওয়া, মর্যাদার সাথে বাঁচা এবং নিজেদের অধিকার পুনরুদ্ধার করা। বাংলাদেশের জন্য এটিই একমাত্র টেকসই সমাধান।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক