জাতীয় ঐক্য কি সোনার হরিণ

ঐক্য জন্মানোর পরিবেশ যদি না থাকে; কস্মিনকালে ঐক্যের চারা জন্মাবে না। অনৈক্যের যে বয়ান, তা ওপারে তৈরির পর রফতানি করা হয় বাংলাদেশে। কেবল তাদের স্বার্থে, এখন সে স্বার্থ রক্ষা করতে চায়। পতিত সরকার ওই বয়ান ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মানুষের কর্ণকুহরে বিঘ্ন ঘটিয়েছে। এখনো প্রায় তেমনি করে মানুষের কর্ণকুহরে চলছে অবিচার। আজও এমন সব কল্পনাসমৃদ্ধ বয়ান উচ্চারণের হেতু কী? এ নিয়ে স্বাভাবিকভাবে জনমনে প্রশ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। অসময়োচিত অপ্রয়োজনীয় অযাচিত তর্ক যখন তোলা হয়, তখন তাকে কূটতর্ক উদ্দেশ্যপূর্ণ কুকর্ম বলে অভিহিত করা থেকে কাউকে বিরত রাখা কি সম্ভব।

নয়া দিগন্ত গ্রাফিক্স

বহু বৈপরীত্য নিয়ে ৫৪ বছর ধরে জাতি তীব্র এক যন্ত্রণা ভোগ করে চলেছে। যেমন- কথা দেয়া, অঙ্গীকার করা, নীতিনৈতিকতা নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হওয়া। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে দিন শেষে সব প্রতিশ্রুতি ভুলে যেতে মুহূর্তকাল কারো বিলম্ব হচ্ছে না। এমন দ্বিচারিতার অর্থ- শুধু বলার জন্য বলা, লোকদেখানো ও আমজনতাকে প্রবোধ দেয়া। এই ইচ্ছাকৃত ভুলে যাওয়া নিয়ে কারো কোনো অনুতাপ, অনুশোচনা নেই। সবাই নীরব-নির্বিকার। প্রধানত রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে এমন সমস্যাগুলো নিয়ত সর্বত্র সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে।

এটিই স্বাভাবিক। কেননা দূষিত বায়ুপ্রবাহ থেকে কেউ কখনো মুক্ত থাকতে পারে না। তেমনি যখন রাষ্ট্রাচারে ন্যায়পরায়ণতার চর্চা থাকে না, তখন তার প্রভাব বলয় থেকে কেউ নিজেকে রক্ষা করতে পারে না।

একটি গণতান্ত্রিক সমাজে দ্বিমত বা মতপার্থক্য অবশ্যই থাকবে। এটি সুস্থ রাজনীতির লক্ষণ। তাকে স্বাগত জানাতে হবে। একে পরিশুদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়ার অংশ বলতে হবে। বহুমত যখন সমাজে বিরাজ করবে; তখন ব্যক্তি বা দলে যেখানে যার যতটুকু ঘাটতি-কমতি আছে, অন্যান্য মতের পাশে থেকে ভালোটা চয়ন করে নিতে পারে। নিজেদের মত-পথ পরিশীলিত করার অপার সুযোগ পাওয়া যায়; কিন্তু দ্বিচারিতা ও দ্বিমতের মধ্যে ব্যবধান দূরত্ব আকাশ-পাতাল। দ্বিমত অবশ্যই ইতিবাচক; কিন্তু দ্বিচারিতা নেতিবাচক। দ্বিচারিতা হচ্ছে তা-ই, কথার হেরফের করা। সকালে এক কথা বলা, বিকেলে আরেক কথা। অপরিশীলিত ভাষায় যাকে বলা যায় ডিগবাজি দেয়া। এমন সাযুজ্যহীন কথা অবশ্যই সমাজকে বিভ্রান্তির চূড়ায় তুলে নিয়ে যায়। সেটি ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দল কারো জন্য কল্যাণজনক হবে না। এমন নেতিবাচক আচরণ ব্যক্তি বা দলে ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করে।

দ্বিচারিতা নিয়ে কথা বলার কারণ এই যে, এখন এটি সমাজে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এর অবসান হওয়া জরুরি। বর্তমানে ক্লান্তিতে বিপর্যস্ত জাতি এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এখন সবার শুধু দেশকে সামনে রেখে ভেবেচিন্তে কথা বলা। তা না হলে দেশ আবার কোন অরাজতায় পৌঁছে যায়; সেটি কে জানে। এমন একটি অন্ধকার অতীত নিয়ে কিভাবে দেশ আগামীতে পৌঁছাবে। দুর্ভোগে নিমজ্জিত জনসমাজ এখন যে তিমিরে, তার কী কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা দিগন্তরেখায় দেখা যাবে! এটি বর্তমান সময়ের এক বহু মূল্যের প্রশ্ন। তাই সব পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় নিলে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার কোনো স্বপ্ন দেখা এই মুহূর্তে নিছক কল্পলোকের ফানুস উড়ানোর মতো মনে হলে, তাকে কি দোষ দেয়া যায়?

সে যাই হোক, যারা এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে পদচারণা করছেন, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের কি সেই সক্ষমতা আছে। একদার কথা বলে লাভ কি! ওমর খৈয়াম বলেছেন, ‘দূরের বাদ্য লাভ কী শুনে, মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।’ সুড়ঙ্গের শেষপ্রান্তে, প্রদীপ জ্বালিয়ে লোকসমাজকে উদীপ্ত উদ্বুদ্ধ করে একত্রে এগিয়ে নেয়ার ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ আজ কোথায়। রাজনীতিতে এখন হরদম চলছে ভানুমতির খেল, কে কার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাবে, চলছে সেই প্রতিযোগিতা। এখন কাদের দখলবাণিজ্য করায়ত্তে! ইতোমধ্যে অতীতের সেই নোংরা শৈলী আবার ফিরে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে, এ খল রাজনীতিতে প্রবেশ করতে কি পারবেন যোগ্যতাসম্পন্ন পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ। যারা দেশে আছেন তাদের সংখ্যা হাতেগোনা গুটিকতেক মনে করার কোনো কারণ নেই। তারা শুধু দেশে নন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিজেদের যোগ্যতা সক্ষমতার প্রমাণ দিচ্ছেন। তাদের যোগ্যতার ভিত দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের দলবিশেষের অনেক নেতা।

যোগ্যতা-সততা তাদের বর্ম- তাই এখন অনন্য সাধারণ, এসব মানুষের দেশের রাজনীতিতে জায়গা হচ্ছে না। কেননা তারা সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে দেয়ার গান কখনো গাইতে পারবেন না। দেশের ভেতরে-বাইরে কারো কাছে নিজেদের বা দেশের স্বার্থ কোনোভাবে বিকিয়ে দিতে পারবেন না। ঘুষ-দুর্নীতিকে কখনো তারা নীতি হিসেবে গ্রহণ করবেন না।

রাজনীতি থেকে সর্বত্র যে দুষ্টচক্র, দেশের স্বার্থে তাকে ভেঙে ফেলতে জীবন উৎসর্গ করতে এসব মানুষ কখনো দ্বিধা করবেন না। দেশের স্বার্থে কেবল বন্ধুত্ব এবং প্রতিপক্ষদের চিহ্নিত করতে এসব মানুষ কখনো পিছপা হবেন না। তাই প্রচলিত অপরাজনীতিতে কখনো তাদের জায়গা দেয়া হবে না, তারাও এমন খল রাজনীতিতে কখনো নাক গলাবেন না। এমন দুঃসহ যন্ত্রণার ভারে মানুষ কাতর। এসব থেকে মুক্তি পেতে ১৮ কোটি মানুষ অপেক্ষায় অধীর। অথচ এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছে না আমজনতা, যাদের স্বপ্ন দেখানোর কথা তারা সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।

এরপরও একটি সুখের বিষয় ছিল, স্বল্পকালের জন্য হলেও জাতি একসময় ব্যতিক্রমী এক রাজনীতি দেখে উজ্জীবিত হয়েছিল। পরমানন্দে তা গ্রহণ করেছিল, নতুন দিগন্তের সূচনাকারী সেই রাজনীতি দেশে-বিদেশে অনেকের চোখের বালি হয়ে উঠেছিল। তারা ওই নতুন রাজনীতিকে সইতে পারছিলেন না- এটি দুর্ভাগ্যের। এরপর দেশে যা স্বাভাবিক সেটি শুরু করা হয়, আর্থাৎ ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত্র। সেই নতুন রাজনীতির সাথে তার দিশারিকেও ধ্বংস করা হয়। এ ভূ-ভাগে বহুকাল থেকে এমন বিপর্যয় চক্রাকারে ঘুরছে। গত দেড় দশকের বেশি সময়ে, এদের দেশের ধসিয়ে দেয়ার মতো আর কিছু অবশিষ্ট এখন আর নেই, যা ধ্বংস করা যায়। পতিত নিকট অতীত নীতির পরিবর্তনে দুর্নীতি, শুদ্ধারের অনুশীলন রেখে দুরাচারের পথ বেছে নেয়া হয়েছিল। সুবিচার বাদ দিয়ে অবিচারকে গ্রহণ করা হয়, সুশাসন দূরে ঠেলে দুঃশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। অধিকার কাটছাঁট করায় বহু ক্ষেত্রে অনধিকারের অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়। এ ভূ-ভাগে খল রাজনীতিকরা বিরাজনীতিকীকরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। যে বিষবৃক্ষ এখনো সতেজ। রাজনীতির সব আচার-আচরণ ও আদর্শ বিসর্জন দেয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল একটিই, সুষ্ঠু রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হলে কেউ আর অনন্ত অনাদিকাল ক্ষমতা চর্চা করতে পারেন না। সুস্থ রাজনীতিতে জনগণের ভোটাধিকারের মূল্য দিতে হয়; কিন্তু পতিত সরকার মানুষের সব অধিকার করায়ত্ত করেছিল। তাদের আস্থার জায়গাটা জননির্ভর ছিল না। নিজেদের স্থায়িত্বে দেশের সব স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে পড়শির ওপর নির্ভর করে থাকত। তারাও বিগত সরকারকে সাহায্য করার শর্তে অনেক কিছু লুটেপুটে নিয়েছে। কিন্তু তার পরও পতিত সরকারকে রক্ষা করা যায়নি। এটি কালের ধারা, বিশ্বে হাজারো ফেরাউনের সলিলসমাধি হয়েছে, কতশত হিটলার-মুসোলিনি-নমরুদের পতন ঘটেছে। এ অমোঘ সত্য শুধু আজ নয়, আগামীর জন্য আগাম এক বার্তা। অতএব, কারো এ কথা ভুলে যাওয়া বা ভুলে থাকার সহজ অর্থ হচ্ছে অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের করুণ পরিণতি অনিবার্য করে তোলা। অথচ সময়ের চাহিদা অনুযায়ী গুছিয়ে নিতে পারলে ব্যক্তি বা দল তখন টেকসই উন্নয়ন ঘটাতে পারে।

দেশে এখন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের, ‘ম্যান বিহাইন্ড দ্য মেশিন’ হওয়ার। সে জন্য অনেকে দিগ্বিদিক হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছেন। যন্ত্রচালনার জ্ঞান জানা, প্রশিক্ষণ নেয়ার ওপর গুরুত্ব দেয়া সেটি তো হচ্ছে না। আনকোরা এবং জ্ঞানশূন্য হলে পরিণতি কেমন হতে পারে তা সবার জানা। সে জন্য সততা, দক্ষতা, নীতি নৈপুণ্যের, ‘জরুরতটা’ কত জরুরি, এমন বোধবিবেচনার কোনো বিকল্প নেই। বিশ্ব এখন বিদ্যুৎ গতিতে অগ্রসর হচ্ছে কেবল তা-ই নয়, যুদ্ধ চলছে দক্ষতা আর যোগ্যতার। এমন এক যাত্রায় এ দেশের কে কোথায়, তার মূল্যায়ন কী হচ্ছে? সেটি কারো জানা নেই। অনেকে কেবল কূটতর্কে লিপ্ত, আর নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। পদ-পদবি যেন তাদের একমাত্র লক্ষ্য, দেশ ও জনগণ তাদের চেতনায় ধূসর-ঊষর মরুভূমিসম। এমন অনুর্বর জমিতে কখনো কোনো ফসল ফলে না। তারপরও এখন ফসল ফলানোর মৌসুম।

ইদানীং কথা উঠেছে জাতীয় ঐক্য নিয়ে। জাতীয় ঐক্য সবার কাম্য। জাতীয় ঐক্য দেশে নিরাপত্তার ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার অবিচ্ছেদ্য শর্ত; যাকে উপেক্ষা করা বা পাশ কাটানোর সুযোগ নেই। সবার স্মরণ থাকার কথা, স্বৈরাচারের আমলে জাতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছিল। ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে বটে, কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রতিবন্ধকতা কোথায় এবং কেন- তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা বা খোঁজার কোনো উদ্যোগের কথা শোনা যায় না। ঐক্যের অন্তরায় খুঁজে বের করা না হলে, এর বীজ রোপণ কখনো সম্ভব হবে না। পতিত সরকার যেসব বয়ান দিয়ে দেশে বিভেদের অলঙ্ঘনীয় দেয়াল তুলেছিল সেই একই বয়ান এখনো উচ্চারিত হচ্ছে। প্রশ্ন সেটিই, কেন এখন কিছু কি হচ্ছে?

ঐক্য জন্মানোর পরিবেশ যদি না থাকে; কস্মিনকালেও ঐক্যের চারা জন্মাবে না। অনৈক্যের যে বয়ান, তা ওপারে তৈরির পর রফতানি করা হয় বাংলাদেশে। কেবল তাদের স্বার্থে, এখন সে স্বার্থ রক্ষা করতে চায়। পতিত সরকার ওই বয়ান ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মানুষের কর্ণকুহরে বিঘ্ন ঘটিয়েছে। এখনো প্রায় তেমনি করে মানুষের কর্ণকুহরে চলছে অবিচার। আজও এমন সব কল্পনাসমৃদ্ধ বয়ান উচ্চারণের হেতু কী? এ নিয়ে স্বাভাবিকভাবে জনমনে প্রশ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। অসময়োচিত অপ্রয়োজনীয় অযাচিত তর্ক যখন তোলা হয়, তখন তাকে কূটতর্ক, উদ্দেশ্যপূর্ণ কুকর্ম বলে অভিহিত করা থেকে কাউকে বিরত রাখা কি সম্ভব?

এ দিকে জাতীয় ঐকমত্যের কমিশন থেকে যে বার্তা আসছে, তা থেকে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে- সত্যিই কি জাতীয় ঐক্য সোনার হরিণ।

[email protected]