কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করা হবে না

জেনারেল আইয়ুব কয়েকজন সিনিয়র অফিসারকে পাশে সরিয়ে রেখে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে সেনাপ্রধান করেন। আর সেই ইয়াহিয়া খান তার বস আইয়ুব খানকে পদত্যাগ করিয়ে মার্শাল ল’ জারি করে দেন। আলতাফ গওহর পেসিডেন্ট আইয়ুব খানের কাছের লোক হওয়ার কারণে যেসব সিভিল সম্মাননা হাসিল করেছিলেন ইয়াহিয়া খান ছিনিয়ে নেন। এরপর আলতাফ সাংবাদিক-লেখক বনে যান। ভবিষ্যতের দিনগুলোতে আলতাফ গওহরের মতো কোনো রিটায়ার্ড ব্যুরোক্র্যাট তাদের বইতে কি জেনারেল জিয়াউল হক, জেনারেল পারভেজ মোশাররফ, বেনজির ভুট্টো, নওয়াজ শরিফ, ইমরান খান এবং শাহবাজ শরিফ তাদের ক্ষমতার মেয়াদে কী কী ভুল করেছেন তা লিখবেন

পাকিস্তানের ক্ষমতাবলয়ের লোকজন ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা নেবেন না মর্মে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে রেখেছেন। পাকিস্তানের ভৌগোলিক নকশা পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পরও আজ অবধি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়াকে অবজ্ঞা করার অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে। ভাবখানা এরকম যে, ভৌগোলিক নকশা বদলে যাচ্ছে তো কী হয়েছে, বদলে যাক। কিন্তু কোনো না কোনো বড় সাহেবের খুব কাছের লোক হওয়ার চেষ্টায় বিন্দুমাত্র ত্রুটি করা চলবে না।

যেসব লোক এখন নিজেকে বেশ জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান বলে জাহির করার খুব কাছাকাছি, তাদের কেউ কেউ ১০-১৫ বছর পর তাদের অতীতের কী কী কাজ পাকিস্তানের কত কত লোকসানের কারণ হয়েছে সেসব কথা বলবেন। এমনো হতে পারে, আলতাফ গওহরের মতো কোনো রিটায়ার্ড ব্যুরোক্র্যাট এমন দাবিও করতে পারেন, আমি পাকিস্তানে প্রদেশগুলোর মধ্যে যাতে মতদ্বৈধতা না বাড়ে সে জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমার কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি। আলতাফ গওহর মাত্র ৩৯ বছর বয়সে পাকিস্তানের তথ্যসচিব হয়েছিলেন। পাকিস্তানের প্রথম ফৌজি আমির জেনারেল আইয়ুব খানের এত কাছে তিনি পৌঁছেছিলেন যে, লোকে তাকে দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট বলে মনে করত। আইয়ুব খানের ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টারস’ বইয়ের প্রকৃত লেখক তিনি ছিলেন বলে শেষ জীবনে স্বীকারও করেছিলেন। যখন উনি আত্মজীবনী লেখা শুরু করেন সে সময় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়ায় সেটি সম্পূর্ণ করতে পারেননি। তবে তার সে অর্ধ-সমাপ্ত আত্মজীবনী ‘গওহর গজশাত’ নামে প্রকাশের ব্যবস্থা করে যান। বইটি অবশ্য তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়।

আজকাল কমপক্ষে তিনজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা তাদের আত্মজীবনী লিখছেন। তাদের মধ্যকার এক সাহেব জেনারেল মোশাররফের খুব কাছের লোক ছিলেন। বাকি দুইজন ছিলেন নওয়াজ শরিফের। তাদের একজন মুহতারাম সাবেক ব্যুরোক্র্যাট তার লেখা সম্পূর্ণ হয়েছে বলে আমাকে জানিয়েছেন। বইয়ে তিনি শুধু অতীত ক্ষমতাশালীদের নয়, তার নিজের ভুলগুলোও স্বীকার করেছেন। আলতাফ গওহরও তার গওহর গজশাতে এটি লিখেছেন যে, তিনি পূর্বপাকিস্তানে ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালে এক বাঙালিকে আটক করে বেদম পিটিয়েছিলেন। তা নিয়ে মামলা হয়েছিল এবং জজ সাহেবের সাথে মিলে কায়দাকানুন করে নিজেকে ওই মামলার সাজা থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি তার বস জেনারেল আইয়ুব খান সম্পর্কে যেসব কথা প্রকাশ করেছেন সেগুলো মাফ করার যোগ্য মোটেও না, তবে পাকিস্তান এখন যেসব সমস্যার মুখোমুখি সেগুলোর প্রেক্ষাপট বুঝতে দারুণ সহায়ক হচ্ছে।

আলতাফ গওহর লিখেছেন ১৯৫৪ সালে আইয়ুব খান সেনাবাহিনী প্রধানের সাথে প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হন। তখন থেকে আইয়ুব খান মন্ত্রিসভার বৈঠকে অংশ নিতে শুরু করেন এবং অনুভব করতে থাকেন যে, তার ভেতরে জাতিকে নাজাত দেয়ার ক্ষমতা সুপ্ত রয়েছে। তার এ নাজাতদানের ক্ষমতা প্রকাশ্যে আনতে তিনি এক পুস্তিকা রচনা করে প্রকাশ করেন। ১৯৫৪-তে লেখা ‘পাকিস্তানকি মওজুদাহ আউর আয়েন্দা মাসায়েল কা এক মুখতাছার জায়েযাহ’ শীর্ষক ওই প্রকাশনাতে তিনি পাকিস্তানের সমস্যার সমাধান প্রেসিডেন্ট-শাসিত সরকারে নিহিত বলে উল্লেøখ করেন। এ দলিল তিনি মন্ত্রিসভার বৈঠকে পেশ করেন। মন্ত্রিসভা সে দলিল নিয়ে তর্কবিতর্ক করে তার উপযুক্ততা পায়নি। এর কিছু দিন পর ১৯৫৬ সালের আইন মঞ্জুরি লাভ করে। আইয়ুব খানের সেনাপ্রধানের মেয়াদ দুইবার বাড়ানো হয়। এরপর তৃতীয়বারের মতো বর্ধিত করে নিতে তিনি তখন ব্যস্ত। প্রেসিডেন্ট ইস্কানদার মির্জা তার খায়েশ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। মির্জার চেষ্টায় প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুন ১৯৫৮ সালের জুন মাসে তার মেয়াদ আরো দুই বছর বাড়িয়ে দেন। মেয়াদ বাড়ানোর কয়েক মাস পর ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট ইস্কানদার মির্জার সাথে মিলে দেশে মার্শাল ল’ জারি করে সেনাপ্রধানের সাথে প্রধানমন্ত্রীও হয়ে যান। প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি আসল ক্ষমতার মালিক প্রেসিডেন্ট বুঝতে পেরে জেনারেল আইয়ুব প্রেসিডেন্ট মির্জাকে পদত্যাগে বাধ্য করে প্রেসিডেন্টের চেয়ার দখল করেন। অতঃপর ১৯৫৬ সালের আইনের কাহিনী শেষ হয়ে যায়।

আলতাফ গওহর লিখেন, মার্শাল ল’ জারি করার অনেক আগে থেকে আইয়ুব খান ১৯৫৬ সালের আইন স্থগিত করার মতলব এঁটেছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় তিনি একজন ধর্মীয় পণ্ডিত গোলাম আহমদ পারভেজের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছিলেন। ১৯৫৭ সালের জুন মাসে পারভেজ সাহেব ১৯৫৬ সালের অনৈসলামী আইন বাতিল করতে জেনারেল আইয়ুবকে ক্ষমতা দখল করা জরুরি বলে পরামর্শ দেন। পারভেজ সাহেব পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকারের বিপক্ষে ছিলেন এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে গায়ের ইসলামী মনে করতেন। তবে তিনি নতুন ইসলামী আইন তৈরির পক্ষে মতামত দেন। মার্শাল ল’ জারির পর ১৯৫৮ সালের ১৮ জুন পারভেজ সাহেব জেনারেল আইয়ুব খানকে একখানি চিঠি লিখে স্মরণ করিয়ে দেন, দেশে এখন উন্নতিকামী ইসলামী আইন করা জরুরি।

তখন পির আলি মুহম্মদ রাশদি নামে আরেক সাহেব ছিলেন। তিনি ফিলিপাইনে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ১৯৬০ সালের ১৯ ডিসেম্বর দেশে রাজতন্ত্র জারি করে নিজেকে বাদশাহ ঘোষণার আহ্বান জানিয়ে তিনি আইয়ুব খানকে এক চিঠি লেখেন। এরপর আইয়ুব খান গণতন্ত্র, ইসলাম ও শাহীতন্ত্রকে মিলিয়ে ১৯৬২ সালের আইন জারি করেন এবং দেশে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসন চালু করেন। সেটিকে তার বাঙালি আইনমন্ত্রী বিচারপতি মুহাম্মদ ইবরাহিম প্রত্যাখ্যান করে পদত্যাগ করেন।

আলতাফ গওহর তার বইয়ের কয়েক জায়গায় দাবি করেছেন, তিনি আইয়ুব খান এবং বাঙালি শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী মহলকে কাছাকাছি আনতে বহুত চেষ্টা করেন যাতে করে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার দূরত্ব খতম হয়ে যায়। কিন্তু যখন তিনি কোনো বাঙালি সাংবাদিক বা জ্ঞানীগুণী লোককে প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করিয়েছেন আইয়ুব খানের বাঙালি মন্ত্রীরা তাদের ব্যাপারে তার কান ভারী করতেন। ওই মন্ত্রীরা ভাবতেন কোনো লেখাপড়া জানা বাঙালিকে যদি আইয়ুব খানের পছন্দ হয়ে যায় তবে খোশামোদ করে প্রেসিডেন্টের কাছের লোক হয়ে যাওয়া এসব লোক ছোট হয়ে যাবেন।

একবার আলতাফ গওহর প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে স্মরণ করিয়ে দেন, আপনি ১৯৬২ সালের আইনের ভিত্তিতে ঢাকাকে দ্বিতীয় রাজধানী করেছেন। কিন্তু সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় দফতর স্থানান্তর করেননি। শুনে আইয়ুব খান গম্ভীর হয়ে গেলেন এবং বেশ রাগের সাথে বললেন, ওই লোকেরা আমাদের সাথে থাকতে পারবে না। আমি দ্বিতীয় রাজধানী এ জন্য করেছি যে, যখন তারা আলাদা হয়ে যাবে তখন অন্তত কোনো না কোনো অফিস কমপক্ষে পাবে।

জেনারেল আইয়ুব কয়েকজন সিনিয়র অফিসারকে পাশে সরিয়ে রেখে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে সেনাপ্রধান করেন। আর সেই ইয়াহিয়া খান তার বস আইয়ুব খানকে পদত্যাগ করিয়ে মার্শাল ল’ জারি করে দেন। আলতাফ গওহর পেসিডেন্ট আইয়ুব খানের কাছের লোক হওয়ার কারণে যেসব সিভিল সম্মাননা হাসিল করেছিলেন ইয়াহিয়া খান ছিনিয়ে নেন। এরপর আলতাফ সাংবাদিক-লেখক বনে যান। ভবিষ্যতের দিনগুলোতে আলতাফ গওহরের মতো কোনো রিটায়ার্ড ব্যুরোক্র্যাট তাদের বইতে কি জেনারেল জিয়াউল হক, জেনারেল পারভেজ মোশাররফ, বেনজির ভুট্টো, নওয়াজ শরিফ, ইমরান খান এবং শাহবাজ শরিফ তাদের ক্ষমতার মেয়াদে কী কী ভুল করেছেন তা লিখবেন? কিন্তু প্রশ্ন হলো ভুল যখন হতে থাকে তখন সেটি চিহ্নিত করা হয় না কেন? ২০২৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের কয়েক দিন আগে বিবাদ সৃষ্টিকারী চারটি নতুন খাল খনন পরিকল্পনা নেয়া হয়। তখন নিশ্চয় ব্যুরোক্র্যাটরা উপস্থিত ছিলেন। তারা কি এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নর সংক্রান্ত সরকারি ফাইলে চার খাল খনন জাতীয় নিরাপত্তায় যেসব বিপদ তৈরি করবে সে ব্যাপারে সাবধান করেছেন, না করেননি?

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক

পাকিস্তানের উর্দু দৈনিক জংয়ে ৭ এপ্রিল, ২০২৫ প্রকাশিত ভাষান্তর করেছেন এরশাদ আলী