‘আমার কী লাভ’

প্রতুল তার প্রবন্ধে তুলে ধরবেন স্বার্থবাদী শিক্ষা গুরুদের কুষ্ঠীনামা। বাপ-দাদাদের আমল থেকে আত্মস্বার্থ রক্ষার ধান্ধায় থাকতে গিয়ে যেভাবে হোক দেশবাসীকে ভেড়া বানানোয় তাদের ছলচাতুরি শেষ যেন হয়েও হয় না। ‘আমার কী লাভ’ করতে করতে নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তারা। তাদের নৈতিক স্খলন কিংবা ন্যায়নীতি নির্ভরতার অধঃপতন দেখেও কেউ কিছু বলতে যে পারে না তা নয়, প্রতুল অদূর একটি জনপদে হতাশ ও বিক্ষুব্ধদের সাম্প্রতিক তীব্র প্রতিক্রিয়ার কথা তুলে আনলেন।

খড়িতলার খাড়িতে তারা যখন পৌঁছাল তখন বিকেল ৫টা। বাদায় তারা রাত কাটাবে এমন একটি পরিকল্পনা তাদের। তারা মানে পাখিমারির পাঁচজন- জালাল, মুজিবর, মুশফিক, গাফফার আর গফুর। সমবয়সী এ পাঁচজন পড়ত একই ক্লাসে, পাশের হরিনগর হাইস্কুলে। এখন তাদের পড়াশোনায় মন নেই- থাকার দরকার কী? সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ানো আর রাতে ডাল টানা আর চাঁদাবাজি করা। জুনিয়র চাঁদাবাজরা বাদার বড় পার্টির সাথে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপার স্যাপার নিয়ে আলাপ-আলোচনা সারবে, রাতে ফুর্তি-আর্তি করবে আর কী? বাদার বড় পার্টির সরদার কইখালীর মন্তেজ মাদবর, ভেট খালির সুখেন সরদার আর দাতিনাখালির মেছের মোড়ল। সুখেনের পা দুপারে আর মাদবর মোড়লের বাদায় ঘোরাফিরার অভিজ্ঞতা বহুদিনের। বনের পাশও আছে তাদেরও। এ পাশ না ভারতের আধার না বাংলাদেশের এনআইডি জাতীয় কিছু। বাদার প্রশাসন ইচ্ছে করে বড় বড় ডাকাতকে হাতে রাখতে বিশেষ পাশ ইস্যু করে।

মেছের মোড়ল আগে মুন্সীগঞ্জের বাজারে তরিতরকারি বিক্রি করত। দুই ছেলে, তিন মেয়ে আর বউ সোনাভানকে নিয়ে তার সংসার ভালোই চলছিল। একদিন হরিনগরের এক চ্যাংড়া পোলার সাথে কী একটা ব্যাপার নিয়ে মেছেরের কথা কাটাকাটি হয়। হরিনগরের মাতব্বরের ভাই এই ছোকড়া ধরাকে সরাজ্ঞান করে চলে। মেছের তাকে বেশি কথা বলেছে এ ধরনের অভিযোগ সেই মাতব্বরের কানে যায়। আর যায় কোথায়- মেছেরকে খুঁটিতে দড়িতে বেঁধে রেখে তার বউ ও ছেলে-মেয়েদের মারধর শুরু করে পোষা গুণ্ডারা। পরে দক্ষিণ চণ্ডিপুর, মলেঙ্গা, সাপখালী গ্রামের মানুষরা তেড়ে আসে। গুণ্ডারা পালিয়ে যায়। তবে মেছেরকে শাসিয়ে যায়। এরপর হরিনগরের গুণ্ডা গাইদ্যা খুন হলে মেছেরকে সে খুনের মামলায় জড়ানো হয়। মেছের নিজের অপমান সইতে না পেরে পলায় বাদার দিকে। সেই থেকে সে বাদায়। দাতিনাখালি গ্রামে তার বউ, ছেলে-মেয়েদের সাথে অগোছালো যোগাযোগ আছে, কিন্তু খুনের মিথ্যা মামলায় আসামি হয়ে সে গ্রামে ফিরে অপদস্ত হতে চায় না। মেছের মোড়ল বাদাতে ভালো আছে। বাদার বড় মিয়ার সাথে তার দু-একবার দেখা হয়েছে। মেছেরের মনে হয়েছে এ বন-বাদাড়েও একটি নিয়ম শৃঙ্খলা আছে, এমনকি বাছ-বিচারও। এখানকার বানরেরা যথেষ্ট সুশীল যদি না কেউ তাদের খ্যাপায়। হরিণেরা সত্যি শান্ত ও শান্তিপ্রিয়। বিধাতা তাদের বাঘের চেয়ে দুই পা বেশি জোরে দৌড়ানোর ক্ষমতা দিয়েছেন। কোনো বেকায়দায় বা বেখেয়ালে না পড়লে শুধু দৌড়িয়ে বাঘ হরিণকে ধরতে পারে না। কুমিরের চেহারা চরিত্র অন্যরকম। তার গায়ের ডোরাকাটা অনেকটা শুকনা চৌচির হওয়া মাঠের মতো। ফলে সে নদীর চরে শুয়ে থাকলেও কেউ বুঝতে পারে না। পারতপক্ষে কুমির কাউকে কামড়ানোর মতো পদক্ষেপে যায় না। আজকাল নানান ধারায় তাকে আটকানোর চেষ্টা চলে- তবে তার বংশবৃদ্ধির জন্য পরিবেশবাদীরা পয়সা খরচ করতে প্রকল্প নেয়। প্রকল্প আরো অনেকে নেয়- সিডর ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ছবি দেখিয়ে, এমনকি বাঘ বিধবাদের কথা বলে কোপেন হেগেনের বিশ্ব জলবায়ু ও উষ্ণতা প্রশমন জাতীয় সম্মেলনে গিয়ে চালাকেরা টাকা-পয়সা তহবিল নিয়ে আসে আর নিজেরা ভাগ-বাটোয়ারা করে খায়। বাদার, বাঘ, হরিণ, কুমির (বাবাহকু) সম্প্রদায়রা মানবিক না হলেও প্রাণিসম্পদের পরিচয়ে কিছু টেস্ট রিলিফ পেতে পারত। হরিনগর, শ্রীফলকাটি, গুমানতলী এমনকি ঈশ্বরীপুরের মাতব্বররা যেমন টেস্ট রিলিফের টাকা আরামসে ভাগ-বাটোয়ারা করে খায়।

বাদার বড় বাবু বা বাঘ মামারা রাজকীয় সম্প্রদায়ের সুনাম ও স্বনামে ধন্য। বাঘ মামার দফতর থেকে সম্প্রতি একটা ফরমান জারি করা হয়েছে ‘নিজের স্বার্থ নিয়ে যারা সদা ব্যস্ত তারা কেন সবার সেবার নাম করে নেতা সাজবে, পাবলিক মানিতে ভাগ বসাবে। ‘নিজের স্বার্থ বনাম সবার স্বার্থ’ শিরোনামে একটা বুনো সংলাপের আয়োজন করতে বনে জঙ্গলের মুখ্য অধ্যক্ষ শিয়ালেন্দু মামাইয়াকে এত্তেলা দেয়া হয়েছে বাবাহকুর (বাঘ বানর হরিণ কুমির সংঘ) কেন্দ্রীয় দফতর থেকে। শিয়ালেন্দু সবার কাছে মামা বা বুদ্ধিমান বা চালাক বা ধূর্ত এমনতরো স্বনামে বেনামে পরিচিত। তিনি বাদার কেন্দ্রীয় সংসদের অধ্যক্ষ-মানব জনপদে যাকে বলা হয় স্পিকার। শিয়ালেন্দুর সদর দফতরের মুখপত্র সাপানাল সাপালিয়া বুনো সংলাপের স্ট্রাকচারাল অবয়ব তুলে ধরেন সংবাদ কর্মীদের কাছে। মূল শিরোনামের পাশে উপ-শিরোনাম ‘আমার কী লাভ?’ নিখিল বঙ্গীয় চিন্তাভাবনা সংঘের মুখ্য গবেষক (জনপদে যাকে বলা যায় প্রফেসর ইমেরিটাস) প্রতুল প্রদাধান মূল প্রবন্ধ পাঠ করবেন। জনপদে আজকাল উচ্চ বিদ্যাপীঠের শীর্ষ পদধারীদের পদ-পদবিতে পরিবর্তন/আপগ্রেড করতে ইমেরিটাস শব্দ ব্যবহার করা হয়। জনপদের ক্ষমতালয়ের প্রধানকে আগে সচিব বলা হতো, পরে তারা হন সিনিয়র সচিব। মুখ্য এবং মন্ত্রিপরিষদ নামে দু-দুজন প্রধানের পদ-পদবি আরো একটু উপরে। এখন চিন্তা-ভাবনা চলছে সিনিয়র সচিবদের ইমেরিটাস সচিব বলা যায় কিনা- তাহলে বেতন ও মর্যাদা বাড়ানো যাবে। এরপর কোনো একসময় হয়তো ‘জাতীয়’ তকমাও দেয়ার কথা উঠতে পারে। যেমন জাতীয় সচিব।

আগামী পূর্ণিমার রাতে নিজের স্বার্থ বনাম সবার স্বার্থ- সাবটাইটেল ‘আমার কী লাভ?’ সংলাপ-সম্মেলনটি করার চিন্তা-ভাবনা নিয়ে এগোচ্ছেন বাদা কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে প্রতুল প্রদাধানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে প্রবন্ধ লেখার জন্য। সমাজ সন্দর্শন বিভাগের মুখ্য পরিচালক মধুভান মাইতিয়া সংলাপের একটি কনসেপ্ট পেপার তৈরির দায়িত্ব পেয়েছেন। তাকে জনপদের বিদ্যায়তনের প্রধান ব্যক্তির, ভূমি বিভাগের তহশিলদারের, চৌকিদার দফাদারদের, নেতা নেত্রীদের চেলাচামুণ্ডারা, টেন্ডার দখল-দাখিল কাজের আদেশ দান, বিল পরিশোধকারী, রাস্তার ঠিকাদার, বদলি ও নিয়োগ ব্যবসায়ী অধিকাংশ অনেকের সবকিছু কাজ বা উদ্যোগের ব্যাপারে বা বিষয়ে ‘আমার কী লাভ’ জাতীয় বাক্য আউড়িয়ে থাকেন সে প্রসঙ্গটি আনবেন। যিনি সবার হয়ে কাজ করবেন- সবাইকে নিঃস্বার্থ সেবা করবেন, সবার মঙ্গলের জন্য শিষ্য সাগরেদ, অধঃস্তনদের উদ্বুদ্ধ করবেন এমন তাদের প্রতিষ্ঠান, পেশাকে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদন করবেন তারাও যদি সারাক্ষণ এমনকি সবার জন্য খিচুড়ি পাকাবার সময়ও ‘আমার কী লাভ’, ‘আমার কী লাভ’ করতে থাকেন; তাহলে খিচুড়িতে নুন-লবণ ঝাল-মরিচ কমানো বাড়ানো চলবে কী করে? বেশি বেশি আত্মস্বার্থ দেখতে গিয়ে সেই যে বয়োবৃদ্ধ বঙ্গপতি লক্ষণ সেন (১১৭৮-১২০৬) দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় পালিয়ে যান নদীয়ায় তারপর মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরে। পরে তার চেলাচামুণ্ডারা পথের কোনো দিশা পাননি। ইতিহাস রচনাকারকরা তার জন্য ভালো কোনো বাক্য বা প্যারা রাখার জায়গা পেলেন না।

বাদার কাছাকাছি জনপদে দিনরাত যা ঘটছে তা যদি এ সংলাপ সম্মেলনে তুলে ধরা যেত, তাহলে গোটা জনপদের স্বার্থচিন্তার শতকরা হার নিয়ে গবেষণার কাজও ত্বরান্বিত হতো। প্রতুল তার প্রবন্ধে তুলে ধরবেন স্বার্থবাদী শিক্ষা গুরুদের কুষ্ঠীনামা। বাপ-দাদাদের আমল থেকে আত্মস্বার্থ রক্ষার ধান্ধায় থাকতে গিয়ে যেভাবে হোক দেশবাসীকে ভেড়া বানানোয় তাদের ছলচাতুরি শেষ যেন হয়েও হয় না। ‘আমার কী লাভ’ করতে করতে নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তারা। তাদের নৈতিক স্খলন কিংবা ন্যায়নীতি নির্ভরতার অধঃপতন দেখেও কেউ কিছু বলতে যে পারে না তা নয়, প্রতুল অদূর একটি জনপদে হতাশ ও বিক্ষুব্ধদের সাম্প্রতিক তীব্র প্রতিক্রিয়ার কথা তুলে আনলেন। প্রতুলের প্রবন্ধে এসব তথ্য-উপাত্ত পেয়ে বাদার বড় বাবু বেশ রেগে গেলেন। হুঙ্কার দিলেন।

লেখক : অনুচিন্তক