বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান সঙ্কটে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হলো খেলাপি ঋণ। দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের ভয়াবহ চাপে আছে। এখন এটি এমন জটিল রূপ নিয়েছে যা সামগ্রিক অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের শিকড় বেশ পুরনো। স্বাধীনতার পরপরই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ঋণ বিতরণে উৎসাহী হয়। সত্তরের দশকে ব্যাংকগুলোর মূল দায়িত্ব ছিল শিল্প ও কৃষির পুনর্গঠন। কিন্তু তখন সঠিক আর্থিক অবকাঠামো ও আইনি কাঠামো ছিল না। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ছিল না এবং ঋণ পুনরুদ্ধারের সংস্কৃতিও গড়ে ওঠেনি। ফলে আশি ও নব্বইয়ের দশকে এ সমস্যা ভয়াবহ রূপ নেয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ অনুমোদনের প্রবণতা এতটাই বেড়ে যায় যে, অনেক ক্ষেত্রেই অযোগ্য উদ্যোক্তারা ঋণ পেয়েছেন এবং তা ফেরত দেননি। এ সময় ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি’ শব্দটি আলোচনায় আসে। আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী যেমন- বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ তখন থেকেই বাংলাদেশকে ঋণ পুনরুদ্ধার ও ব্যাংকিং সংস্কার বিষয়ে সতর্ক করতে থাকে। ২০০০ সালের পর বেসরকারি ব্যাংকের উত্থান ঘটে। মনে করা হয়েছিল, বেসরকারি ব্যাংক আসায় ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়বে। বাস্তবে প্রথম দিকে কিছুটা পরিবর্তন এলেও ক্রমশ একই সমস্যার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। করপোরেট গোষ্ঠীগুলো রাজনৈতিক সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে বড় অঙ্কের ঋণ নিতে থাকে। সেই সাথে ঋণের অর্থ ফেরত না দেয়ার প্রবণতা বাড়ে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকও খেলাপি ঋণের জালে আটকা পড়তে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে বিতরণকৃত মোট ঋণের এক-চতুর্থাংশই খেলাপি। গ্রস খেলাপি ঋণের হার ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। নিট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ, যেখানে এক বছর আগেও এই হার ছিল মাত্র ১১ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান আরো উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে যখন দেখা যায়, অনেক ব্যাংকই প্রকৃত খেলাপি ঋণ আড়াল করছে। পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন এবং আদালতের মাধ্যমে স্থগিতাদেশের কারণে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ সরকারি তথ্যের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, যদি সব তথ্য স্বচ্ছভাবে প্রকাশিত হয়, তবে ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ খেলাপি হিসেবে স্বীকৃত হবে। এটি কেবল দক্ষিণ এশিয়া নয়, পুরো এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি।
খেলাপি ঋণ সব খাতে সমান নয়। কৃষি খাতে তুলনামূলকভাবে খেলাপির হার কম, কারণ সরকার কৃষকদের জন্য বিশেষ সহায়তা দেয় এবং ঋণের পরিমাণও তুলনামূলক কম। খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি শিল্প ও করপোরেট খাতে। বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী প্রভাব খাটিয়ে হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়ে ফেরত দেয় না। এসএমই খাতে ঋণের পরিমাণ তুলনামূলক কম হলেও ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা, সুদের হার ও বাজারে প্রতিযোগিতার কারণে অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা খেলাপি হয়ে পড়ে। ভোক্তা ঋণ বা কনজিউমার লোনেও খেলাপির সংখ্যা বাড়ছে, বিশেষত আবাসন ও গাড়ি ঋণে।
বাংলাদেশে ঋণ খেলাপি হওয়ার মূল কারণগুলোর অন্যতম দুর্বল ক্রেডিট কালচার। এখানে ঋণকে একটি দায় হিসেবে নয়; বরং সুযোগ হিসেবে দেখা হয়। প্রভাবশালীরা ধরেই নেন যে, ঋণ পরিশোধ না করলেও তাকে কেউ ধরতে পারবে না। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে রাজনৈতিক নিয়োগের কারণে ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ থাকে না। যোগ্যতা ও প্রকল্পের সম্ভাবনা না দেখে কেবল সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ দেয়া হয়। ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল থাকলেও মামলার জট, দীর্ঘসূত্রতা ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর কারণে সেগুলো কার্যকর নয়। ফলে শাস্তিহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিকবার পুনঃতফসিলের অনুমতি দিয়েছে, যার ফলে খেলাপি ঋণকে কাগজে-কলমে সুস্থ ঋণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এতে সমস্যা আড়াল হলেও বাস্তবে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে।
বিগত সরকারের শেষ সময়ে ব্যাংক লুটপাট ও খেলাপি ঋণের বিস্তার ঘটে ব্যাপকভাবে। বিশেষ করে, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সহযোগিতায় ব্যাংক থেকে বিপুল ঋণ গ্রহণ এবং তা বিদেশে পাচারের ঘটনা সঙ্কট আরো জটিল করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের জুনে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা ২০২৫ সালের জুনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকায়। অর্থাৎ এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিন লাখ ১৯ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। এই ঋণের অধিকাংশই আদায়যোগ্য নয়, যা ব্যাংক খাতের জন্য বড় ঝুঁকি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য, দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৫৪টি ব্যাংক গত ২১ বছরে খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে। মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ ৮১ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। এসব ঋণ আদায়যোগ্য নয়।
খেলাপি ঋণের প্রভাব কেবল ব্যাংক খাতেই সীমাবদ্ধ এমন নয়। এটি পুরো অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। কারণ, ব্যাংকের মূলধন সঙ্কুচিত হয়, ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমে। বিনিয়োগ কমে গেলে নতুন শিল্প হয় না, কর্মসংস্থান হয় না। খেলাপি ঋণের কারণে সুদের আয় না হওয়ায় ব্যাংকের আয় কমে, লোকসানে পড়ে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে এ সমস্যা সবচেয়ে বেশি। ফলে সরকারকে অর্থ দিয়ে সেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, যা জনগণের অর্থের অপচয়। সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব পড়ে জনগণের আস্থায়। যখন সাধারণ মানুষ দেখে প্রভাবশালীরা হাজার কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ না করেও পার পেয়ে যাচ্ছে, তখন তারা ব্যাংকের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। সামাজিক দিক থেকে এর প্রভাব গভীর।
খেলাপি ঋণের কারণে একদিকে প্রভাবশালী ধনী গোষ্ঠী আরো ধনী হয়, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ ব্যাংকের সহায়তা না পেয়ে পিছিয়ে পড়ে। ফলে সামাজিক বৈষম্য বাড়ে।
ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, গ্রিস, ইতালি- সব দেশই কোনো না কোনো সময়ে খেলাপি ঋণের সঙ্কটে পড়েছে। ১৯৯৭ সালের এশীয় আর্থিক সঙ্কটের সময় দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যাংক খাত খেলাপি ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ে। সরকার দ্রুত ‘কোরিয়া অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন’ নামে একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, যার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর অকার্যকর ঋণ কিনে নেয়া হয় এবং ধাপে ধাপে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালানো হয়। এই পদক্ষেপ শুধু ব্যাংক খাতকে স্বস্তি দেয়নি; বরং দ্রুত বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধারেও সাহায্য করেছিল। চীনের ব্যাংক খাত টিকিয়ে রাখতে একাধিক ‘অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করা হয়, যেগুলো খেলাপি ঋণ আলাদা করে নিয়ে তা পুনর্গঠন বা বিক্রি করার কাজ করে। এর ফলে ব্যাংকগুলো নতুন করে কার্যক্রম শুরু করতে পারে এবং আর্থিক ব্যবস্থায় আস্থা ফিরে আসে। ভারত ২০১৬ সালে ‘ইনসলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাংকরাপ্সি কোড’ প্রণয়ন করে, যা খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে আইনি কাঠামো দেয়। এর মাধ্যমে ঋণগ্রহীতা যদি সময়মতো দায় শোধ করতে ব্যর্থ হয়, তবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তার সম্পদ পুনর্গঠন বা নিলামে বিক্রির ব্যবস্থা নেয়া হয়। এর ফলে ভারতে খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের হার বাড়তে শুরু করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোও ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সঙ্কটের সময় ব্যাপক খেলাপি ঋণ সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছিল। বিশেষ করে ইতালি, স্পেন ও গ্রিসে এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। সেখানে সমাধান হিসেবে ব্যাংকগুলোতে মূলধন পুনঃপুঁজিকরণ, খেলাপি ঋণ আলাদা করার জন্য ‘ব্যাড ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা এবং ঋণ পুনর্গঠনের জন্য বিশেষ আর্থিক আদালত গঠন করা হয়।
এই আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের জন্য কয়েকটি মূল শিক্ষার বিষয় আছে। প্রথমত, খেলাপি ঋণকে যত দ্রুত আলাদা করে সমাধান করা যায়, ততই ব্যাংক খাত পুনর্গঠনের সুযোগ পায়। দ্বিতীয়ত, আইনি কাঠামো শক্তিশালী না হলে খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার কার্যত অসম্ভব। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে এই প্রক্রিয়া চালাতে না পারলে কোনো সংস্কারই টেকসই হয় না এবং চতুর্থত, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত না করলে আবারো ঋণ খেলাপি হবে।
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশকে বলে আসছে, ব্যাংক খাতের সংস্কার ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে না। আইএমএফের সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে ‘স্ট্রাকচারাল রিস্ক’-এর মুখে আছে। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে বৈদেশিক ঋণপ্রবাহ ব্যাহত হবে। সুতরাং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও প্রযুক্তি ব্যবহার খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে। অনেক ঋণ খেলাপি বিদেশে সম্পদ স্থানান্তর করেন। সে অর্থ উদ্ধারের জন্য আন্তঃদেশীয় সহযোগিতা জরুরি।
বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি একটি ভয়াবহ সতর্কবার্তা। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়ার সক্ষমতা হারাবে। তবে এখনই সংস্কার করা হলে ব্যাংক খাত বাঁচানো সম্ভব।
বাংলাদেশ এখন জরুরিভিত্তিতে যে সব পদক্ষেপ নিতে পারে তা হলো, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ব্যাংক পরিচালনা, শক্তিশালী ইনসলভেন্সি আইন প্রণয়ন, বিশেষ আর্থিক আদালত গঠন, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠা, পুনঃতফসিলের সুযোগ সীমিত করা, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা এবং প্রযুক্তিনির্ভর ঋণ যাচাই-বাছাই চালু করা। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট



