সংস্কৃতি থেকে সভ্যতা

ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। এই ছোট পৃথিবীতে আমরা সবাই এক পরিবারের মতো। এই ছোট্ট পৃথিবীতে সবার সাথে মিলেমিশে বসবাস করতে চাই।

আরবি ১২ রবিউল আউয়াল প্রতি বছর হিজরি বর্ষ অনুযায়ী পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সা: পালন করা হয়। এ বছর ১২ রবিউল ছিল ৬ সেপ্টেম্বর। দিনটি উপলক্ষে জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশসহ বাণী দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা, রাষ্ট্রপতিসহ দেশের সুধীজন। অন্য দিকে দিনটি পালন করা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। দিনটি পালন করার কারণ আমাদের সংস্কৃতি। প্রথাগত বিধান, আইন, সংস্কৃতি, ধর্ম ও সভ্যতা একের পর এক যেন তাকে ঘিরে অবস্থান করছে। এই সাজানো তাক তুলনা করা চলে বহুতলবিশিষ্ট ইস্টিমারের সাথে।

প্রথাগত বিধান বলতে বোঝায়, কোনো নির্দিষ্ট সমাজে যুগ যুগ ধরে চলে আসা রীতিনীতি, আচার-আচরণ, বিশ্বাস ও নিয়মকানুন, যা জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে চলে। যা সমাজের স্থিতিশীলতা বজায় রাখাসহ সংস্কৃতি সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে।

এগুলো আইনের প্রাচীনতম উৎস। কারণ এসব থেকে পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করে আনুষ্ঠানিকভাবে আইনে পরিণত হয়। ধর্মের একাংশ থেকে যে সংস্কৃতির উৎপত্তি হয় তা ধর্মীয় সংস্কৃতি। ধর্মীয় সংস্কৃতির সাথে প্রথা ও রীতিনীতির মিশ্রণে নতুন সংস্কৃতির জন্ম হয়। নতুন সংস্কৃতি সমাজের সাথে মিলেমিশে এমনভাবে একাকার হয়ে পড়ে যে, একটি থেকে আরেকটি আলাদা করার সুযোগ থাকে না।

মানুষের আচরণ ও বিশ্বাসের সাথে মিশে যাওয়া প্রথাগত বিধান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য দীর্ঘ দিন ধরে সমাজে প্রচলনের মাধ্যমে এমনই অনিবার্য হয়ে পড়ে যে, যা অগ্রাহ্য করলে সামাজিক সঙ্ঘাত দেখা দিতে পারে। তেমন অনিবার্য অংশ আইনে পরিণত হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র সর্ব মহল থেকে নিরঙ্কুশ স্বীকৃতি পায়।

ইংল্যান্ডে সাধারণ আইনগুলো প্রচলিত ‘প্রথা ও রীতিনীতি’ থেকে সৃষ্টি হয়েছে। প্রথা আইনের একটি প্রাচীন উৎস এবং যখন এটি রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত হয়, তখন এর প্রয়োজন এতটা অবিচ্ছেদ্য হয়ে ওঠে যে, এটি অমান্য করলে সঙ্ঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। ধর্ম থেকে আগত আইন যেমন- উত্তরাধিকার, বিয়েবিচ্ছেদ, যৌতুক নিরোধ, সম্পত্তি বণ্টন, বিয়ের রীতিনীতি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ধারণা ইত্যাদি।

কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রতি সম্মান জানানো সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি রক্ষা করতে জন্ম হয়েছে দণ্ডবিধি ৩৭৯ ও ৩৮০ ধারার আইন, যা ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষা করার জন্য। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঐতিহ্য ও অধিকার সংরক্ষণে ২০১০ সালে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন প্রণীত হয়েছে।

আইনের বীজ রোপিত হয় মানুষের প্রচলিত প্রথা, আচার-আচরণ, ধর্ম, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতির ভূমিতে। এর মধ্যে যে ভূমি উর্বর হয় সে ভূমিতে অঙ্কুরিত হয় আইন। অঙ্কুরিত আইন একসময় হয়ে ওঠে মহীরুহ, যা ইচ্ছে করলে জীবন ও সমাজ থেকে উপড়ে ফেলা যায় না। এভাবে প্রথা ও রীতিনীতি সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপন করে এবং সময়ের সাথে সাথে সে সংস্কৃতি এমন অনিবার্য হয়ে ওঠে যে, আইন করে রক্ষা করতে হয়। প্রভাবশালী আইন ও অনিবার্য সংস্কৃতি থেকে সভ্যতার জন্ম।

ধর্মীয় সংস্কৃতির কিছু উদাহরণ যেমন- আজান প্রচলনের সময় মাইক ছিল না, নামাজে দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেবের সূরা কালাম প্রত্যেক মুকতাদির শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে পৌঁছার জন্য ছিল না আধুনিক প্রযুক্তি। ছিল না অজু করার জন্য পানি সরবরাহের আধুনিক পদ্ধতিও। এখন প্রতিটি মসজিদে মাইকের সাহায্যে আজান প্রচারসহ ব্যবহৃত হয় আধুনিক প্রযুক্তি। জমজমের পানি বিশেষ ট্যাংকারে করে মদিনায় পাঠানো হয়, যেখানে এটি একটি নির্দিষ্ট স্টোরেজ প্ল্যান্টে রাখা হয় এবং তারপর বিভিন্ন সুরক্ষা মান অনুযায়ী পরীক্ষা করে মসজিদে নববীতে বিতরণ করা হয়। মসজিদে নববীতে আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়, যেখানে ঠাণ্ডা পানি ১৫১টি এয়ার হ্যান্ডলিং ইউনিটে পাঠানো হয়।

এ ইউনিটগুলো মসজিদের স্তম্ভগুলোর মধ্যে থাকা পাইপের মাধ্যমে ঠাণ্ডা বাতাস সরবরাহ করে, যা পুরো এলাকাজুড়ে একটি আরামদায়ক তাপমাত্রা বজায় রাখে। মসজিদে নববীর উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে (উঠোনে) স্বয়ংক্রিয়ভাবে খোলা ও বন্ধ হতে পারে এমন বিশাল আকারের ইলেকট্রিক বা রূপান্তরযোগ্য ছাতা স্থাপন করা হয়েছে, যা মুসল্লিদের ছায়া দেয়। এ ছাতাগুলো আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি এবং প্রয়োজনে বড় আকারের ছায়া দিতে পারে, যা মুসল্লিদের জন্য আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করে। এটি একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাইরের তাপমাত্রার ওপর ভিত্তি করে শীতলকরণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করে।

এসব উন্নয়নের পেছনে কাজ করছে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি। বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি বলতে বোঝায় বিজ্ঞানের মূল্যবোধ, আচরণ, রীতিনীতি এবং জ্ঞান যা কোনো সমাজ বা ব্যক্তি গ্রহণ করে এবং বিজ্ঞান কিভাবে ওই সমাজের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে। বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনে প্রয়োজন মৌলিক গবেষণা ও মুক্তচিন্তা। মুক্তচিন্তা সমাজের সামগ্রিক মূল্যবোধ গঠন করে এবং ব্যক্তি ও সমাজের জীবন প্রভাবিত করে।

একদিন কোথায় ছিলাম আমরা? নবী করিম সা:-এর আমলে মসজিদে নববী ছিল একটি তাৎপর্যপূর্ণ স্থাপনা, যা খেজুরগাছ ও তার পাতা দিয়ে তৈরি হয়েছিল। কালক্রমে মসজিদের অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ ইসলাম ধর্মে মাইকে আজান প্রচার, প্রযুক্তির সাহায্যে মক্কা থেকে জমজমের পানি মদিনায় নেয়ার কৌশলসহ মসজিদে নববী আরামদায়ক রাখার পদ্ধতি শুরুতে না থাকলেও পরবর্তী সময়ে যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে ইনসানের সুখ-স্বস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে তা এখন সংস্কৃতির অংশ হয়ে উছেছে। এ কারণে বলা হয় সংস্কৃতির ওপর ভর করে আসে সভ্যতা।

সভ্যতা হলো সংস্কৃতির উন্নত ও দৃশ্যমান রূপ, যা সামাজিক অগ্রগতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং মানবসমাজের সামগ্রিক বিকাশের স্তর বোঝায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গুহাবাসী মানুষের পশু শিকার ও খাদ্য সংগ্রহের মাধ্যমে সংস্কৃতির শুরু। পশুপাখির অনুসরণ করে এবং প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের জীবনযাপন উন্নত করে। এরপর শুরু হয় পশু পালন ও কৃষি। কৃষির আবিষ্কারের পর মানুষ স্থায়ীভাবে এক জায়গায় বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। স্থায়ী বসতি ঘিরে মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন আরো বিকশিত হয়। মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে শুরু করলে যোগাযোগব্যবস্থা, খাদ্য উৎপাদন ও বণ্টন, শত্রুর হাত থেকে সুরক্ষা ও জ্ঞান আত্মস্থ করার মতো বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যখন এ উন্নত সামাজিক কাঠামো, জ্ঞান, প্রযুক্তি ও জীবনযাত্রার মান একটি নির্দিষ্ট স্তরে পৌঁছায়, তখন তাকে সভ্যতা বলা হয়।

সভ্যতা হলো সংস্কৃতির একটি উন্নত ও সুশৃঙ্খল রূপ, যেখানে সামাজিক ও মানব উন্নয়নের একটি উন্নত স্তর পরিলক্ষিত হয়। আমরা যদি কয়েক হাজার বছর আগের অবস্থায় ফিরে যাই, দম বন্ধ হয়ে যাবে বিশ্বের। কারণ সভ্য জগতে অনগ্রসর জাতির পরিণাম খুব করুণ। অনগ্রসর জাতি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন- কথাটির মাধ্যমে বোঝানো যেতে পারে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী যারা আধুনিক প্রযুক্তিগত সভ্যতার সাথে কোনো যোগাযোগ ছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে নিজেদের মতো করে বসবাস করছে। যা বহির্বিশ্বের সভ্যতার বাইরে বা রীতিনীতি থেকে ভিন্ন জনগোষ্ঠী। বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী বলতে এমন সব আদিবাসী মানুষকে বোঝানো হয়, যারা দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বসম্প্রদায়ের সাথে কোনো ধরনের যোগাযোগ ছাড়া বসবাস করছে। এক জরিপ অনুসারে, বিশ্বে শতাধিক এমন আদিবাসী জনগোষ্ঠী আছে যাদের সাথে আধুনিক সভ্যতার কোনো যোগাযোগ নেই। তাদের অর্ধেক অ্যামাজন জঙ্গলে বসবাস করে।

ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। এই ছোট পৃথিবীতে আমরা সবাই এক পরিবারের মতো। এই ছোট্ট পৃথিবীতে সবার সাথে মিলেমিশে বসবাস করতে চাই।

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক