সাধারণত ‘মে’ মাসকে সবচেয়ে ঝঞ্ঝাবহুল বলে অভিহিত করা হয়; কিন্তু আমাদের দেশে জুলাই মাস সবচেয়ে ঘটনাবহুল হয়ে গেল। এবারো কোরবানির ঈদ পালিত হলো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কড়াকড়ি সত্ত্বেও বাড়ি যাওয়ার ঝামেলা, দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঠেকানো যায়নি। ইতোমধ্যে চলে গেছে ‘সামাজিক ব্যবসা’ দিবস। এই দিবসটি গত সরকারের আমলে পালিত হতে পারেনি। জাতিসঙ্ঘের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকার তার সমস্যা সত্ত্বেও সামাজিক ব্যবসার ওপর জোর দিচ্ছে। জাতিসঙ্ঘের এক কর্মকর্তা বলেছেন, এটি শুধুই সামাজিক অধিকার নয়। জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগ হঠাৎ করে রেগে ওঠে; কিন্তু তারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তবে গত ২১ তারিখে ঢাকার মাইলস্টোনের ঘটনা সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। একটি পত্রিকা বলেছে, ‘এ শহরের সবগুলো ফুল ঝরে গেছে’। এটি মিডিয়ার কথা। শিশুদের তুলনা করা হয়েছে ফুলের সাথে। মাইলস্টোন কলেজের তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত অনেক শিক্ষার্থী মারা গেছে। ঘটনাটি ঘটে মাইলস্টোনের দিয়াবাড়ি শাখায়।
বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণবিমান ধসে পড়ে স্কুলের উপরে। এতে অনেক শিক্ষার্থী নিহত হয়। এ ঘটনা প্রমাণ করে, আমরা কত বেখবর। আমরা সচেতন হলে প্রস্তুতি নিতে পারতাম। টিভিতে ধারাবিবরণী প্রচার করছিল। সারা রাত পরদিন বিকেল পর্যন্ত ধাপে ধাপে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে টিভিতে। উত্তরায় ১. চিকিৎসক সঙ্কট; ২. রক্তের সঙ্কট, বিশেষ করে নেগেটিভ রক্তের সঙ্কট;
৩. চিকিৎসা সরঞ্জাম সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। পুরো উত্তরাতে কোনো বার্ন ইউনিট নেই হাসপাতালগুলোতে। উত্তরা থেকে বার্ন ম্যানেজমেন্টের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে আনতে আনতেই রোগী মারা যায়। টিভি চ্যানেলগুলো আহত-নিহতদের সংখ্যা গরমিল করায় মা-বাবারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
৪. যমুনা টিভি ফায়ার সার্ভিস সঙ্কট, গাড়ি ও পানির সঙ্কট নিয়ে বিশেষভাবে প্রতিবেদন প্রচার করে। দেখা যাচ্ছে, মাইলস্টোন কলেজের উপরে বিমানটি পড়েছে আর টিভিতে দেখা যাচ্ছে গর্ত থেকে পানি তুলে বালতি ভর্তি করছে এবং ধ্বংসাবশেষ পানিতে ভিজিয়ে দিচ্ছে। উদ্বিগ্ন এক মা বলেছেন, বিভিন্ন চ্যানেল বিভিন্ন খবর প্রচার করে। আমাদের কয়টা ছেলেমেয়ে মারা গেল? কারণ সরকারবিরোধী বলে পরিচিত এক টিভি চ্যানেল হঠাৎ করে প্রচার করেছে, ২০ জন মারা গেছে। পরদিন এই সংখ্যা ওঠে ৩৪-এ। নিউজের জন্য বিখ্যাত একটি টিভি চ্যানেল প্রচার করেছে, ২০০ জন আহতকে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। আসলে তা ঠিক নয়।
প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ তালিকা (২৫ জুলাই, বিকেল সোয়া ৪টা) অনুযায়ী, বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ৫০ জন, এ পর্যন্ত ওই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৩ জন। প্রথমেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারণা হয়েছিল, শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকে নিহত হয়েছেন। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মাইলস্টোনের দু’জন শিক্ষক প্রাণ হারিয়েছেন। একজন হলেন মাহরীন চৌধুরী, যিনি নিজের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করেছিলেন। অপরজন হলেন- মাসুকা বেগম, তিনিও শিক্ষার্থীদের নিরাপদে বের করে আনতে চেষ্টা করেছিলেন।
৫. বজ্রপাত, ভূমিকম্প, ভূমিধস, হঠাৎ নদী ছোট হয়ে যাওয়া- প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। আমরা কি প্রস্তুত রয়েছি এ জন্য? ফায়ার সার্ভিসকে গড়ে তুলতে হবে সে মোতাবেক। উদ্ধারকর্মী বাহিনীকে প্রস্তুত রাখতে হবে। মাইলস্টোন কলেজের এ ঘটনা আমাদের সেই কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। আরেকটি কথা, মিডিয়ার কাজ শুধু ভয় পাইয়ে দেয়া নয়, সঠিক খবর পরিবেশন করা। দিয়াবাড়ি হচ্ছে উত্তরার পশ্চিম অংশের একটি স্থানের নাম। এখান থেকে সাধারণত বিমান নিরাপত্তার জন্য পাখি শিকার করা হয়। মেট্রোরেলের দু’টি বগি মাইলস্টোনের আহতদের বহন করার জন্য খালি রাখা হয়েছিল। আসলে মেট্রোরেলের সর্বপ্রথম স্টেশন দিয়াবাড়িতেই অবস্থিত।
৬. গত ২৫ জুলাই রাতে টিভির খবরে প্রচারিত হয়, ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স বলেছে, রাজউক থেকে কোনো অনুমতি নেয়নি মাইলস্টোন কলেজ। ওরা বিনা অনুমতিতে এত বছর কিভাবে চালাল? মাইলস্টোন কলেজ বরাবর ভালো ফল করেছে এবং ক্যাডেট কলেজের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।
গত বছর জুলাই মাসের ঘটনাবলির জন্য মোটামুটি প্রস্তুত ছিল আমাদের দেশ; কিন্তু চলতি বছর জুলাইয়ের এ ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল কি? টিভি দেখে সেটি মনে হয় না।



