দুর্গতি কাটাতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন

মনে রাখতে হবে, এ মুহূর্তে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সমস্যার যুতসই সমাধান দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা।

বহুল আলোচিত গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেয়া তার ভাষণে বলেন, ‘আমাদের গুরুদায়িত্ব হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান। আমি ঘোষণা করেছি, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচন উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য আমরা সব প্রস্তুতি গ্রহণ করছি। আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণের দিন একই সাথে জুলাই সনদ নিয়ে গণভোটে চারটি বিষয়ে হ্যাঁ/না ভোট অনুষ্ঠিত হবে।’

ভাষণের আগে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশের বিষয়টি চূড়ান্ত হলে এর মধ্যে এই আদেশে সই করেছেন রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিন। তবে জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার সর্বশেষ ভাষণেও সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক বিষয় ছিল নির্বাচন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্যের সারকথাও নির্বাচন। সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল বক্তব্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে সরকারকে তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন অনুষ্ঠান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কর্তব্য’। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী দলগুলোর আসল কথা নির্বাচন। সেনা সদরের সর্বশেষ ব্রিফিংয়েও জানানো হয়েছে, নির্বাচনী কাজে সরকারকে যাবতীয় সহায়তায় প্রস্তুত সেনাবাহিনী। আর সাধারণ মানুষ তো নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে আছে। দৃশ্যত নির্বাচনমুখী সবাই। যে যা করুন-বলুন ‘নির্বাচন হবেই’- এমন সাফ কথা আছে সরকারের ওপর মহল থেকে। নির্বাচন কমিশনও নিজেদের প্রস্তুতির কথা জানান দিচ্ছে নিয়মিত। সংস্কার দরকার। বিচারও লাগবে। সনদ, গণভোট, উচ্চকক্ষ-নিম্নকক্ষ ইত্যাদির একটিও বাদ দেয়া যাবে না। কিন্তু কোনোটিকে নির্বাচনের সাথে মেলানো কাম্য নয়।

টানা ১৫ বছর শাসন-শোষণের পর আওয়ামী লীগের বিদায় জনমনে স্বস্তি এনেছে। মানুষের চাওয়াপাওয়ার একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার সে জায়গাটায় আছে। যারপরনাই বাংলাদেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে একটি নির্বাচনের জন্য। অন্তর্বর্তী সরকার একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রণমূলক নির্বাচন উপহার দেবে- সে আশায় বুক বেঁধে আছে গোটা জাতি।

হাজারো শহীদের আত্মত্যাগে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় পর দেশ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়েছে। এটি শুধু ক্ষমতার হাতবদলের জন্য হয়নি। ব্যবসায়-বিনিয়োগ, আইনশৃঙ্খলা, সামাজিক স্থিতাবস্থা- সবকিছুর জন্য। গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশবাসীর অন্যতম চাওয়া, গত ১৫ বছরে যে ভোটাধিকার খর্ব হয়েছে, তা ফিরিয়ে দেয়া। অর্থাৎ অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা। বিগত সময়ের নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে, জালভোট, কেন্দ্র দখল আর খুনের ঘটনাও ছিল। তাই সাধারণ ভোটাররা অপেক্ষা করছে একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের। সবাই একটি ভোটের উৎসবের দিন গুনছে। তাই দেশের বর্তমান সঙ্কট সমাধানে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন হওয়া বাঞ্ছনীয়। নির্বাচনের ক্ষেত্র যখন প্রস্তুত হচ্ছে- তখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্ন অবস্থা একটু একটু করে দৃশ্যমান হচ্ছে। তারা যেন মাঝে মধ্যে ভুলে যান, নিজ নিজ দলীয় সমর্থক নেতাকর্মীর বাইরেও অরাজনৈতিক কিংবা নির্দলীয় বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে। এই লাখো কোটি অরাজনৈতিক কিংবা নির্দলীয় জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা বাস্তবায়নে তাদের করার অনেক কিছু আছে। মাসের পর মাস ধরে দেশের জনগণ দেখে আসছিল অনেক রাজনৈতিক দলের আমন্ত্রিত প্রতিনিধি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকালের একটি উল্লেখযোগ্য সময় পার করে দিয়েছেন। রাজনীতি নিয়ে তাদের অনেক কথা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের পাকা কথাও হয়েছে; কিন্তু তাদের কারো কারো কথায় মাঝে মধ্যে বাগড়া বাধছে। কথার বাগড়ায় নির্বাচন নিয়েও সংশয় বেধে যাচ্ছে।

সম্প্রতি জাতীয় নির্বাচন বানচাল করার যে দুরভিসন্ধি নিয়ে পতিত স্বৈরাচার ও দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর, রাজনীতিবিদদের মতভেদ আর বিপরীতমুখী অবস্থানে তা আরো গতি পাচ্ছে। এ কথা নতুন করে উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল। মাত্র ১৫ মাসের মধ্যে সেই ঐক্যে বড় ফাটল ধরেছে।

রাজনীতির সমান্তরালে অর্থনীতিও রয়েছে; কিন্তু সে দিকে খেয়াল দেয়ার তেমন অবকাশ হচ্ছে কই? গত কয়েক মাসে রফতানি খাতে নেতিবাচক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। দেশের ব্যবসায়ী সমাজ এবং বিদেশে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীরাও বলছেন, দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে প্রয়োজন নির্বাচিত একটি স্থিতিশীল সরকার। অথচ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ তীব্র মাত্রায় বিদ্যমান। তাই জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জটিলতা এখনো যে শতভাগ কেটেছে তা বলা যাবে না। এতে যে পতিত পলাতক স্বৈরাচারের পুনর্বাসনের পথ সুগম হতে পারে সে দিকে কারো খেয়াল আছে বলে মনে হয় না। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার রায় ঘিরে পলাতক স্বৈরাচারীর সহযোগীরা গত কয়েক দিন খোদ রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় যেভাবে আগুনসন্ত্রাস চালিয়েছে- ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির করণীয় সম্পর্কে এটি একটি সতর্ক বার্তা হতে পারে।

এ দিকে ব্যবসাবাণিজ্যে বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে। ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে রয়েছেন। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ তেমন নেই। সবাই হাত গুটিয়ে বসে আছেন। দুশ্চিন্তায় তারা। বায়াররা আমাদের এখানে অর্ডার করতে চান না। এ জন্য আমাদের ২৫ শতাংশের বেশি অর্ডার অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। প্রশাসন ও কাস্টমসে নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় রাজনৈতিক বিভিন্ন ছোট-বড় দল এখন ঝুট ব্যবসা নিয়ে কারখানায় গিয়ে সমস্যা তৈরি করছে। বাধাহীন চলছে চাঁদাবাজি-রাহাজানি। চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। চাঁদাবাজিতে বাড়ছে পণ্যমূল্য। আগের মতো পণ্য ওঠাতে-নামাতে চাঁদা দিতে হয়। এর প্রভাব পড়েছে পণ্যমূল্যে। সাপ্লাই চেইনে ব্যাঘাত ঘটায় পণ্যের দাম বাড়লেও অভিযান চালানো হয় কেবল পাইকারি ও খুচরা বাজারে। তার ওপর সাধারণ ব্যবসায়ীদের ওপর করপোরেট ব্যবসায়ীরা রাহুর মতো বসে আছে, শোষণ করছে।

সামগ্রিকভাবে তা অর্থনীতিতে সঙ্কট বাড়াচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে হাহাকার। চাপে পড়ছে সাধারণ মানুষ। তারতম্য দেখা গেছে চাহিদা ও ভোগে। ফলে গতি হারিয়েছে অর্থনীতি। যার প্রভাব পড়েছে দেশের রাজস্ব আয়েও। এবার ঠিকমতো কর দিতে পারছেন না করদাতারা। যারা এবার বাধ্যতামূলক আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন, তাদের ৮৮ শতাংশ দিয়েছেন ‘শূন্য কর’। সূত্র মতে, গত ১৪ মাসে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে মোট ৩৫৩টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। ফলে বেকার হয়ে গেছেন এক লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ শ্রমিক। পোশাক খাত ছাড়াও বিগত সময়ে আরো অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে কর্মহীন হয়েছেন অনেক মানুষ। তাদের মধ্যে কর্মকর্তা পর্যায়ের অনেকের ছিল করযোগ্য আয়। ফলে যে ব্যক্তি আগে কর দিতেন, এখন তিনি শূন্য কর দিচ্ছেন। অবশ্য শুধু যে কারখানার কর্মকর্তারা চাকরি হারানোয় কর দিতে পারছেন না তা নয়; ব্যবসাবাণিজ্যে মন্দায়ও অনেক করদাতার আয় কমে গেছে। তারাও কাক্সিক্ষত কর দিতে পারছেন না।

চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অর্থ ব্যয় হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ঋণের পরবর্তী কিস্তি ছাড়বে কি না, সে বিষয়টি আগামী ফেব্রুয়ারিতে চূড়ান্তভাবে জানা যাবে। এক বছরের বেশি সময় পার হলেও অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত স্থিতিশীলতা আসেনি। মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখনো অনেক বেশি, যা অর্থনীতির দুর্বলতা প্রকাশ করে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সঙ্কুচিত হওয়ার জন্য দায়ী দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি, অধিক বেকারত্ব, কর্মসংস্থানের সঙ্কট এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি।

অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটাতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘ দিনের উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অতিদারিদ্র্য ও বেকারত্ব বাড়ায় দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সঙ্কট আরো বেড়েছে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অন্তরায়। যদিও চলতি অর্থবছরকে প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরিবর্তে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বছর হিসেবে ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। যার পরিপ্রেক্ষিতে গত এক বছরে দেশের অর্থনীতি আরো সঙ্কুচিত হয়েছে। এ ছাড়া আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দেশে অন্তত এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্যসঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করে জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং জাতিসঙ্ঘের শিশু তহবিল ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি। এবার এই তিন সংস্থার সাথে একমত পোষণ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি বলছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের গতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে হলে দারিদ্র্য কমাতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক হারে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ।

এ ধরনের পরিস্থিতি সামনে এলে বাড়তি জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে চলমান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরো বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সম্প্রতি প্রকাশিত দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি প্রতিবেদনেও অর্থনীতিতে ঝুঁকি হিসেবে দেখা হচ্ছে- আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দেশের অভ্যন্তরে সৃষ্ট রাজনৈতিক ঘটনাবলি ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা। সামগ্রিক এ পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারীসহ অর্থনীতিবিদদেরও একই কথা। নির্বাচিত সরকার ছাড়া ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি হবে না, অর্থনীতিতেও গতি ফিরবে না বলে তারা মনে করেন। সঙ্গত কারণে জনগণের চাওয়া, রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করবেন। মনে রাখতে হবে, এ মুহূর্তে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সমস্যার যুতসই সমাধান দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট