উপদেষ্টাদের সেফ এক্সিট বিতর্ক

বিশ্লেষকরা বলেছেন, ভোটের আগে এই প্রশ্নগুলো নতুন করে সঙ্কট তৈরি করতে পারে, এই উপদেষ্টাদের তো নিয়মতান্ত্রিকভাবেই দায়িত্ব হস্তান্তর করা উচিত। সে ক্ষেত্রে সেফ বা আনসেফ এক্সিটের প্রশ্ন কেন উঠবে। এখানে দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা থাকলে বা কোনো দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সেগুলোর জন্য বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিকের মতোই তাদের বিচারের আওতায় আনা যেতে পারে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের কারো কারো ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে ছোড়া অভিযোগ থেকে সরছে না জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। এখন পর্যন্ত দুঃখিত হয়নি। কোনো সংশোধনীও দেয়নি। এ নিয়ে চলছে তোলপাড়।

আলোচনা-সমালোচনাও তুঙ্গে। পর্দার আড়ালে কী ঘটতে যাচ্ছে, এ কানাঘুষা বিস্তর। মূলধারার গণমাধ্যমে নানা সংবাদ ও বিশ্লেষণ আছে এই নিয়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তো অন্তহীন ন্যারেটিভ। সাথে গুজব-গুঞ্জন। উপদেষ্টারা অনেকটা খামোশ। এ অভিযোগ করা এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলাম কারো নাম বলেননি। কাজেই প্রতিক্রিয়া দেয়া মানে ‘ঠাকুর ঘরে কে?’ অবস্থা হওয়ার ঝুঁকি।

এ অবস্থার মাঝেও পরিবেশ এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘উপদেষ্টারা সেফ এক্সিট খুঁজছে, নাহিদ ইসলামের এই বক্তব্য তাকেই প্রমাণ করতে হবে।’ উপদেষ্টাদের আর কেউ এ নিয়ে এখন পর্যন্ত মন্তব্য করেননি। ‘উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে লিয়াজোঁ করে ফেলেছেন, তারা নিজেদের সেফ এক্সিটের কথা ভাবতেছেন’- একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি এমন কথা ছুড়ে রীতিমতো কথার বোমা ছুড়েছেন এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক দফা ঘোষণা করেছিলেন সে সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি উপদেষ্টা হন। একপর্যায়ে হন তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। গত ফেব্রুয়ারিতে সরকার থেকে পদত্যাগ করে এনসিপির আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন নাহিদ।

টেলিভিশন চ্যানেলে দেয়া সাক্ষাৎকারে নাহিদ ইসলাম আরো বলেছিলেন, ‘তারা কেউ সরকারের উপদেষ্টা পদে যেতে চাননি। তাদের দাবি ছিল একটি জাতীয় সরকার গঠনের। সেটা হলে ছাত্রদের দায়িত্ব নিতে হতো না। রাজনৈতিক শক্তি বা অভ্যুত্থানের শক্তি সরকারে না থাকলে অন্তর্বর্তী সরকার তিন মাসও টিকত না। প্রথম ছয় মাস সরকারকে উৎখাত করা বা প্রতিবিপ্লব করার নানা ধরনের চেষ্টা চলমান ছিল। এটা এখনো মাঝেমধ্যে আছে। রাজনৈতিক দলের নেতাদের এবং যারা উপদেষ্টা হয়েছেন, তাদের অনেককে বিশ্বাস করাটা আমাদের অবশ্যই ভুল হয়েছিল। আমাদের উচিত ছিল ছাত্র নেতৃত্বকেই শক্তিশালী করা, সরকারে গেলে সম্মিলিতভাবে যাওয়া। নাগরিকসমাজ বা রাজনৈতিক দলকে আমরা যে বিশ্বাসটা করেছিলাম, যে আস্থা রেখেছিলাম, সেই জায়গায় আসলে আমরা প্রতারিত হয়েছি। অনেক উপদেষ্টা নিজেদের আখের গুছিয়েছেন অথবা গণ-অভ্যুত্থানের সাথে বিট্রে করেছেন। যখন সময় আসবে, তখন আমরা তাদের নামও উন্মুক্ত করব।’

তিনি তার কথায় অটল। তার ওপর মানুষ অপেক্ষমাণ কখন তিনি ওইসব উপদেষ্টার নাম জানাবেন? সেই সাথে জানাবেন তারা কে কী আখের গুছিয়েছেন? এমন অপেক্ষার মাঝে এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, ‘কিছু উপদেষ্টার মধ্যে দেখা যাচ্ছে, তারা কোনোভাবে দায়সারা দায়িত্ব পালন করে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এক্সিট নিতে পারলেই হলো। এই দায়সারা দায়িত্ব নেয়ার জন্য অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি সরকার কাজ করতে পারে না। তারা এত শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে ওখানে আছেন। তারা এমনটি করে থাকলে দেশের মানুষের সামনে মুখ দেখাতে পারবেন না। যারা এ ধরনের চিন্তা করেন, তাদের জন্য মৃত্যু ছাড়া কোনো সেফ এক্সিট নেই। পৃথিবীর যে প্রান্তে যাক, বাংলাদেশের মানুষ তাদের ধরবে।’

অভিযোগ বিবেচনায় সারজিসের কথার তেজও কম নয়। নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের পাঁচ-ছয় দিন পর বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেছেন, দেশেই ছিলাম, বাকিটা জীবনও বাংলাদেশেই কাটাব।’ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। রিজওয়ানা হাসান আরো বলেন, ‘সব রাজনৈতিক দলের মতো নবগঠিত রাজনৈতিক দলের সাথেও সরকারের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তাদের অনানুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য নিয়ে সরকারের পক্ষে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। ‘মন্তব্য করা সম্ভব নয়’ বলে রিজওয়ানা মন্তব্য একদম কম করেননি। এ পর্যায়ে এসে নাহিদ-সারজিসদের বড়ভাই গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান কয়েক উপদেষ্টার জোগসাজশের কথা বলেছেন যারা বিতাড়িত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছেন বলে দাবি তার। তার ভাষায়- ‘শেখ হাসিনার সাথে পাঁচজন উপদেষ্টা হাত মিলিয়েছেন। তারা শেখ হাসিনার সাথে মিলে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন।’

এ কাতারে শামিল হয়েছেন, এখনো সরকারে থাকা স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তার কথার মার একটু ভিন্ন। ‘একাধিক দেশের পাসপোর্টধারীরাই অন্যদের সেফ এক্সিটের তালিকা করো’ বলে কথার মারপ্যাঁচ দিয়েছেন তিনি। নিজের ফেসবুক পেজের এক পোস্টে এ মন্তব্য করে পোস্টে আসিফ মাহমুদ লেখেন, যারা ৫ আগস্ট পালিয়েছিল, তাদের সিমপ্যাথাইজাররা কষ্টে মরে যাচ্ছে। বারবার ফ্যাসিস্টদেরই পালাতে হবে। আমাদের জন্ম এ দেশে, মৃত্যুও এ দেশের মাটিতেই হবে ইনশা আল্লাহ। ফ্যাসিস্ট, খুনিদের সাথে লড়তে লড়তে আমার ভাইদের মতো শহীদী মৃত্যু কামনা করি।

উপরিউক্ত এসব কথা একসাথে করলে মানে কিন্তু ভালো দাঁড়ায় না। রীতিমতো একটা উদ্বেগজনক অবস্থা। সচেতন যে কারোই প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়, উপদেষ্টারা কিভাবে ‘আখের গুছিয়েছে’, কেন ভাবছেন ‘সেফ এক্সিটের কথা? প্রচলিত অর্থে ‘আখের গোছানো’ বলতে বোঝায়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানারকম সুযোগ-সুবিধা হাতানো। ‘আখের গোছানো’ বলতে নিজের বা নিজের আত্মীয়স্বজন, এমনকি নিজের এলাকার জন্য বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা নেয়াকেও বোঝানো হয়ে থাকে। কোনো কোনো উপদেষ্টার সাথে কাজ করা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে সরিয়ে দেয়াও হয়েছে। দুই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং নুরজাহান বেগমের আলোচিত দুই ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেয়া হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তাদের অনিয়ম নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য কোনো তদন্তও করা হয়নি। আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার মন্ত্রণালয়ের অধীন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) কুমিল্লার সড়ক ও অন্যান্য গ্রামীণ অবকাঠামো মেরামত ও উন্নয়নে দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিচ্ছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে আসিফ মাহমুদের নিজ উপজেলা মুরাদনগরে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর উপজেলা দেবীদ্বারে।

এটা হচ্ছে ‘বিশেষ’ প্রকল্পের বরাদ্দ। দ্বিতীয়ত, প্রকল্পটি নেয়া হচ্ছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে। আসিফ মাহমুদ ও হাসনাত আবদুল্লাহ দু’জনেই তাদের এলাকা থেকে নির্বাচনে অংশ নেবেন, এলাকাবাসী তেমনটিই ধারণা করছেন। এর ফলে এই বরাদ্দের সাথে তাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার সম্পর্কটি খুবই স্পষ্ট। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের ক্ষেত্রে এটা শুধু ‘আখের গোছানো’, নাকি একই সাথে তা স্বার্থের সঙ্ঘাত- এই প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ।

আরেকটি উদাহরণ হতে পারে, সম্প্রতি দু’টি বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের (টিভি) লাইসেন্স পাওয়ার ঘটনাটি। অন্তর্বর্তী সরকারের দেয়া নতুন দু’টি টিভির একটির অনুমোদন পেয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক মো: আরিফুর রহমান (তুহিন)। আরেকটি টিভির লাইসেন্স পেয়েছেন আরিফুর রহমান; তিনি এনসিপির পূর্বতন সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য ছিলেন।

তাহলে এখন তো অভিযোগ এনসিপি ও উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধেই। সামগ্রিক লক্ষণ ভালো নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে কিছু দলের ভাগযোগের অভিযোগ আরো আগ থেকেই। রয়েছে ভাগে না মেলার অভিযোগও। উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, কাড়াকাড়ি করে প্রশাসনে লোক নিয়োগ করিয়েছে বিএনপি-জামায়াত। নিয়োগের আগে তারা সংস্কারের জন্য সরকারকে যত সময় লাগে দেয়ার পক্ষে ছিল। তবে নিয়োগ শেষ হওয়ার পরপরই ডিসেম্বর মাস থেকে তারা অসহযোগ শুরু করে দিয়েছে। মাহফুজ আরো যোগ করলেন- ‘বাংলাদেশে সবাই গোষ্ঠীস্বার্থের জন্য কাজ করে। জাতীয় স্বার্থ দেখে না। সামগ্রিকভাবে কোন জিনিসটা করলে একটা ভালো আইন পাওয়া যাবে, ভালো একটা নীতি পাওয়া যাবে সে বিষয়ে কেউ আগ্রহী নয়। আর আমলারা আছেন পরের সরকারের অপেক্ষায়। জুলাই অভ্যুত্থানের যে প্রত্যাশা ছিল, সে অনুসারে কাজ করা সম্ভব হয়নি বলে স্বীকার করেন মাহফুজ আলম। এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, সুনির্দিষ্ট কোনো উপদেষ্টার নাম তারা এখনই না বললেও তারা মনে করেন, এই উপদেষ্টা পরিষদই জনমানুষের প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, ভোটের আগে এই প্রশ্নগুলো নতুন করে সঙ্কট তৈরি করতে পারে, এই উপদেষ্টাদের তো নিয়মতান্ত্রিকভাবেই দায়িত্ব হস্তান্তর করা উচিত। সে ক্ষেত্রে সেফ বা আনসেফ এক্সিটের প্রশ্ন কেন উঠবে। এখানে দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা থাকলে বা কোনো দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সেগুলোর জন্য বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিকের মতোই তাদের বিচারের আওতায় আনা যেতে পারে। তা ছাড়া যেই ছাত্রনেতৃত্বের পরামর্শ রেখেই এই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তারাই কেন উপদেষ্টাদের সেফ এক্সিট নিয়ে অভিযোগ তুলছে সেই প্রশ্নও সামনে আসছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট