আবু এন এম ওয়াহিদ
২০২৫ সালের শেষভাগে ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল (এনএসএস) ঘোষণা করেছে। এই নীতি শুধু দেশীয় নিরাপত্তা নয়, আন্তর্জাতিক কূটনীতি, অর্থনীতি, সামরিক ও ভূরাজনৈতিক বিকাশ, সব কিছু নতুনভাবে সাজানোর পরিকল্পনা উপস্থাপন করে। এটি আগের নীতিমালাগুলোর ধারাবাহিকতা নয়; বরং এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ‘আগ্রাসী বিশ্ব নেতৃত্ব’ থেকে ‘স্বস্বার্থ ও সুরক্ষাকেন্দ্রিক’ কৌশলে সরে এসেছে।
নিচে এ নীতির মূল দৃষ্টিকোণ এবং সম্ভাব্য প্রভাব বিশ্লেষণ করা হলো।
১. নীতি-মন্ত্র : জাতির সার্বভৌমত্ব, বাস্তববাদ ও ‘হেমিস্ফেরিক ডমিন্যান্স’।
১.১ জাতির সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং বহুপক্ষীয় মাঠে অতিরিক্ত সংশ্লিষ্টতা থেকে নিজেকে গুটিয়ে আনা।
নতুন নীতি স্পষ্টভাবে বহুপক্ষীয় সংস্থা ও গ্লোবালাইজড আন্তর্জাতিক কাঠামোর প্রতি অবিশ্বাস প্রকাশ করে। নীতি বলছে, ‘বিশ্বের মৌলিক রাজনৈতিক একক জাতিরাষ্ট্র (নেশন স্টেট)’ এবং যুক্তরাষ্ট্র তার জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেবে। এমনকি নীতি দাবি করে, অন্যান্য দেশ বা অঞ্চলের রাজনৈতিক বা সামাজিক ঘটনায় অনিয়মিত হস্তক্ষেপ (যেমন- অতীতে হয়) বন্ধ করা হবে; বিশেষ করে ‘গণতন্ত্র রফতানি’, ‘নিয়ন্ত্রিত পরিবর্তন’ বা ‘মানবাধিকার জোরদারকরণ’ মিশনের দৃষ্টিকোণ থেকে।
১.২ ‘হেমিস্ফেরিক আধিপত্য’
নতুন নীতি একটি প্রাধান্যশীল ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আত্মসাৎ করেছে- যুক্তরাষ্ট্র তার মূল প্রাধান্য পুনরুদ্ধার করবে পশ্চিম গোলার্ধে। এটি পুরনো গড়হৎড়ব উড়পঃৎরহব-এর পুনরুজ্জীবন বা ‘ট্রাম্প কোলোনি’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
এই অংশে যুক্তরাষ্ট্র মূলত ল্যাটিন আমেরিকা, ক্যারিবীয় ও পশ্চিম গোলার্ধের দেশগুলোর সাথে কৌশলগত, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তামূলক সম্পর্ককে প্রাধান্য দেবে। এ ছাড়া অন্য দেশগুলোর বিশেষত চীনের প্রভাব সীমিত করার চেষ্টা করবে। এতে মাদক পাচার, অপরিবর্তিত অভিবাসন, নিরাপত্তা হুমকি এবং বিদেশী প্রতিক্রিয়ার মতো বিষয়গুলো মোকাবেলার কথা বলা হয়েছে।
২. সামরিক শক্তি, প্রযুক্তি ও শিল্প ‘নতুন প্রতিরক্ষা কাঠামো’
২.১ সামরিক আধুনিকীকরণ ও প্রভাবশালী প্রতিরক্ষা
নতুন এনএসএসে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বাহিনীকে যুগোপযোগী করতে একাধিক উদ্যোগ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। শুধু অস্ত্র বা পারমাণবিক সক্ষমতা নয়; বরং হাইপারসনিক ব্যবস্থা, সাইবার ও স্পেস/অ্যাডভান্সড ওয়ারফেয়ার এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
নীতি বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র তার সুরক্ষা এবং রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় ‘মোস্ট লেথাল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যালি অ্যাডভান্সড মিলিটারি’ গঠন করতে চায়।
২.২ শিল্পীকরণ ও পরিপূর্ণ অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা
নতুন নীতিতে যুক্তরাষ্ট্র তার ‘শিল্প শক্তি’ ফিরে পেতে চায়। কারণ নীতি মতে শিল্প এবং উৎপাদনশীলতা ছাড়া কোনো দেশ শক্তিশালী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না।
সেমিকন্ডাক্টর, বিরল খনিজ, ব্যাটারি, শক্তি, যুদ্ধ সামগ্রী, এসব কৌশলগত প্রয়োজনীয় পণ্য ও উপাদান স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। সেই সাথে সাপ্লাই চেনের ওপর বিদেশী-নির্ভরতা কমিয়ে আনা হবে। একই সাথে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং শিল্পভিত্তিক সুরক্ষা জাতীয় নিরাপত্তার অংশ হবে।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে, নতুন নীতি ‘অর্থনৈতিক রূপান্তর এবং প্রতিরক্ষা শক্তির’ একটি মিশ্রিত মডেল উপস্থাপন করেছে।
২.৩ প্রযুক্তিগত আধিপত্য : ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে প্রযুক্তি
নতুন কৌশল কাগজে প্রযুক্তিকে (যেমন- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বায়োটেকনোলজি, ডিজিটাল অবকাঠামো, উন্নত ইলেকট্রনিক যুদ্ধ) সামরিক সক্ষমতার পরিপূরক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
একে ইকোনমি প্লাস মিলিটারি প্লাস টেকনোলজিক্যাল সিকিউরিটি নেক্সাস হিসেবে দেখা হচ্ছে, যেখানে কোনো দেশ যাতে চীন বা অন্য প্রতিদ্ব›দ্বীর সাথে প্রযুক্তিগত শীর্ষে প্রতিযোগিতা বজায় রাখতে পারে; এটি মূল লক্ষ্য।
৩. ভূরাজনীতি : মুখ ঘুরিয়ে নতুন অগ্রাধিকার
৩.১ ইউরোপ ও রাশিয়া : এক বদলে যাওয়া অবস্থান
নতুন নীতিতে ইউরোপের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে। নীতিপত্রে ইউরোপকে ‘সিভিলাইজেশনাল ইরেজ’ বা ‘সভ্যতার অবলুপ্তি’র সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক করেছে, বিশেষ করে অভিবাসন, জনসংখ্যার পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনকে এতে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
এতে বেশির ভাগ ইউরোপীয় দেশকে দায়িত্ব নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সবসময় প্রতিরক্ষার ভার বহন করবে না।
রয়েছে রাশিয়ার সাথে কূটনৈতিক পুনর্মিলনের সম্ভাবনা : নতুন এই নীতি রাশিয়াকে রূপান্তরযোগ্য প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সেই সাথে ইউক্রেনে সঙ্ঘাত দ্রুত সমাপ্তির পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা তুলে ধরেছে।
৩.২ মধ্যপ্রাচ্য ও গ্লোবাল ‘নিয়ম গঠনে’র প্রতি মনোপলি বাতিল
বিগত দশকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মধ্যপ্রাচ্য ছিল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অঞ্চল। কিন্তু এ নীতিমালায় সেই গুরুত্ব কমে গেছে। নীতি বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র এখন আর মিডল ইস্টকে ‘প্রধান নিয়ন্ত্রণ ক্ষেত্র’ হিসেবে দেখবে না, কারণ যুক্তরাষ্ট্র নিজে এখন বিপুল জ্বালানির অধিকারী এবং জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশ।
নতুন নীতি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র আর দীর্ঘকালীন ‘গ্লোবাল হেজেমনি’, বা ‘বৈশ্বিক ন্যায্যতা ও মানবাধিকার রফতানির’ আদর্শে বিশ্বাসী নয়; বরং প্রতিটি দেশকে নিজস্ব পথ অনুসরণের এবং ‘নিজস্ব শর্তে গঠনের’ সুযোগ দিতে হবে।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে নীতিমালা গ্লোবালাইজড সুপারপাওয়ার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে প্রতিদ্ব›দ্বী শক্তিমূলক ‘স্বনির্দিষ্ট, প্রতিযোগিতামূলক ও অংশীদারভিত্তিক’ ভাবনায় রূপান্তরিত করে।
৪. অভিবাসন, অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা ও নীতি-সংস্কার
নতুন এনএসএস অভিবাসনকে জাতীয় নিরাপত্তার এক বড় ইস্যু হিসেবে রেখেছে। নীতি ঘোষণা করেছে, ‘ম্যাস মাইগ্রেশন ইজ ওভার’ অর্থাৎ- বড় আকারের নিয়ন্ত্রিত নয় এমন অভিবাসন, অনিয়মিত অভিবাসন ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের অভাবকে এখন একটি নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে গণ্য করা হবে।
এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ সাইবার নিরাপত্তা, প্রযুক্তিগত সুরক্ষা এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সবকিছু নতুন নীতির দৃষ্টিকোণের অংশ। এ অংশে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতি এবং বিদেশী নীতি একসাথে গেঁথে দেয়া হয়েছে, অর্থাৎ- ‘বাহ্যিক শত্রু’ ও ‘ভিত্তিগত হুমকি’ উভয়কে এক সুরক্ষাবলয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
৫. যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিরাপত্তা কৌশল : সুফল ও ঝুঁকি
৫.১ সম্ভাব্য সুফল
যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তি, শিল্প ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে নতুন শক্তি ফিরে পেতে পারে; সাপ্লাই চেন নির্ভরতা কমবে।
‘স্বনির্ভরতা প্লাস প্রতিরক্ষা প্লাস অর্থনৈতিক শক্তি’র মিশ্রণ যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখবে।
গ্লোবাল হেজেমনিকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে, যুক্তরাষ্ট্র ‘সুপ্রাধান্য’ বজায় রাখার নতুন পথ তৈরি করতে পারে।
নীতি যদি কার্যকর হয়, তাহলে পশ্চিম গোলার্ধে স্থিতিশীলতা, মাদক ও অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
৫.২ ঝুঁকি, সমালোচনা ও অনিশ্চয়তা
বহু ঐতিহ্যগত মিত্র (বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশ) থেকে দূরত্ব তৈরি হতে পারে; বহুপক্ষীয় সহযোগিতা দুর্বল হতে পারে।
‘হেমিস্ফেরিক প্রাধান্য’ বা মনরো ডকট্রিন- আই পুনরাবৃত্তি নতুন প্রাদেশিক দ্ব›দ্ব সৃষ্টি করতে পারে।
গ্লোবালাইজেশনের বিরোধিতা, বৃহৎ অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত বিচ্ছিন্নতা- এগুলো বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
নীতি যদি সাম্প্রদায়িক মনোভাব উৎসাহ দেয় (যেমন- অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ, সংস্কৃতি-রাজনীতি), তাহলে আন্তর্জাতিক সমন্বয় ও মানবাধিকার মানদণ্ড ক্ষুণ্ণ হতে পারে।
উপসংহার
২০২৫ সালের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল দেখায়, যুক্তরাষ্ট্র এখন পরিবর্তনের পথে। পুরনো গ্লোবাল হেজেমনি, বহুপক্ষীয় সমঝোতা বা সমন্বিত বিশ্বনীতি থেকে অনেক দূরে সরে আসছে, একটি ‘রিয়েলিজম প্লাস সার্বভৌমত্ব প্লাস স্বনির্ভরতা প্লাস প্রযুক্তি-শক্তিভিত্তিক’ কৌশলে যুক্তরাষ্ট্র এগোচ্ছে।
এ নীতি শুধু সামরিক বা কূটনৈতিক পরিকল্পনা নয়, এটি যুক্তরাষ্ট্রকে পুরো অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিকভাবে পুনর্গঠনের একটি দৃষ্টিপত্র। তবে পরিবর্তন সব সময় ঝুঁকি নিয়ে আসে। কৌশলে যে সংহতি, মিত্রতা ও বহুপক্ষীয় সমন্বয় ছিল, সেগুলো হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্ববাসীর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নতুনভাবে নির্ধারণ হবে; সেই সাথে নতুন বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রকে নিজস্ব স্বার্থ বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। তাই সংক্ষেপে বলা যায়- ২০২৫ সালের এনএসএসের মূল ভাবনা, সংহতি নয়, স্বার্থ; বৈশ্বিক নেতৃত্ব নয়, স্বনির্ভরতা; সহযোগিতা নয়, প্রতিযোগিতা। এ পরিবর্তন বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন ধরনের অস্থিরতা, নতুন ধরনের প্রতিপক্ষ এবং নতুন ধরনের কূটনীতি গড়ে তুলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
লেখক : অর্থনীতির অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইউএসএ


