ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্বৈরাচারের দোসরদের নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা সহ্য করা হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এ জন্য দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে তাকে মোবারকবাদ জানাই। তিনি জনগণের মনের কথাটি প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি তিনি দেশের আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনী প্রধানদের জরুরি সভায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ এবং এ জন্য একটি কমান্ড সেন্টার গঠনের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে সর্বোচ্চ আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা উদ্ভূত পরিস্থিতি দ্রুত ও কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে পারে। বাহিনীগুলোর নিয়ন্ত্রণ এবং ভ‚মিকার মধ্যে নিবিড় সমন্বয় সাধন করতে হবে। নিরাপত্তা বাহিনী প্রধানদেরকে স্বৈরাচারের যেকোনো অপতৎপরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মতো সতর্ক ও অবিচল থাকার নির্দেশ দিয়ে তিনি চাঁদাবাজ ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালানোর জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে বলেন। প্রধান উপদেষ্টা পুলিশকে গণহত্যা, নিপীড়নসহ স্বৈরাচারের যাবতীয় অপরাধের মামলাগুলো দ্রুত সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে গিয়ে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যেন হয়রানির শিকার না হন।
এই কঠোর ব্যবস্থা ও নির্দেশাবলি সময়ের দাবি। প্রধান উপদেষ্টার এই কঠোর অবস্থান দেশবাসীর কাছে নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং ব্যতিক্রমধর্মী বলে মনে হয়েছে। তার প্রতি অনুরোধ, আপনি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং শ্রদ্ধাশীলদের প্রতি উদার এবং একই সাথে গণতন্ত্র হত্যাকারী, গুম, খুন, নিপীড়ন ও নির্যাতনে বিশ্বাসীদের প্রতি কঠোর হোন।
এ দেশে গণতন্ত্র এবং জাতীয় ঐক্যে বিশ্বাস করে না ভারতীয় আগ্রাসনবাদী বিজেপির বাংলাদেশ শাখা আওয়ামী লীগ, তাদের চ্যালাচামুণ্ডা, ভারতপন্থী প্রকাশ্য ও গোপন দল বা লেজুড় সংগঠন, নাস্তিক বুদ্ধিজীবী চক্র, উগ্র হিন্দু দল বিজেপি ও ইসকন এবং ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের বাংলাদেশী স্থানীয় প্রতিনিধি, স্বৈরাচারের প্রতিপালিত গৃহভৃত্য ঠগ ব্যবসায়ী, সামরিক-বেসামরিক কাঠামোতে থেকে যাওয়া ও সদ্য ভোল পাল্টানো কর্মকর্তা, দুর্নীতিবাজ এবং অর্থ লুটেরা ও পাচারকারী চক্র, অসৎ ব্যবসায়ী, অসাধু পেশাজীবী, ঠিকাদার এবং স্বৈরাচারের দালাল শ্রেণী এবং জোগানদাতা চক্র। এই চক্র বহাল তবিয়তে থাকলে তাদের হাত থেকে দেশ, জনগণ ও জনস্বার্থ রক্ষা করা কারো পক্ষেই সম্ভব কি না সংশয় থেকেই যাবে। এই চক্রটি তাদের প্রভুদের খুশি করতে দলবাজ মিডিয়াকে দিয়ে গত কয়েক মাস বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিষ ঢেলেছে, যা সর্বৈব মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাদেরই নতুন শিখণ্ডী হলো মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড। যদিও তার থোতা মুখও ভোঁতা হয়ে গেছে।
অবশ্য বিলম্বিত বোধোদয়ে এবার শোচনীয় অনুশোচনা জাগতে শুরু করেছে ভারতের দিল্লির প্রধান সংবাদ ও গণমাধ্যমের। বাংলাদেশ পরিস্থিতি তথা জুলাই ’২৪-এর সফল ছাত্র-জনতা গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে এত দিন ধরে চালানো অপব্যাখ্যা, অপসাংবাদিকতা ও উদ্দেশ্যমূলক ঘৃণা-বিষোদগারে এখন তারা বিবেক দংশনের অস্বস্তিতে ভুগছে। দ্য প্রিন্ট, হিন্দুস্তান টাইমস, ইন্ডিয়া টুডে, দ্য হিন্দুর মতো নেতৃস্থানীয় সর্বভারতীয় গণমাধ্যমগুলো তাদের অন্ধ হাসিনা স্বৈরাচারের সমর্থন এবং বাংলাদেশে পরিবর্তন-বিরোধী মূল্যায়নে নতুন মাত্রা যোগ করতে চলেছে। ভারত সরকারের এ ধরনের আগ্রাসনবাদী নীতি অবস্থান নিয়ে তারা এখন একের পর এক প্রশ্ন তুলছে। অনেকে এই প্রথম সম্পাদকীয় অভিমত দিচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের কাছে পতিত হাসিনা স্বৈরাচারের ‘সামান্যতম গ্রহণযোগ্যতা নেই’। অন্যান্য গণমাধ্যম পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে, ‘ভারতকে বাংলাদেশের ব্যাপারে নতুন কৌশল নিতে হবে। গত পাঁচ-ছয় মাস ধরে দিল্লির প্রধান প্রধান গণমাধ্যমে বাংলাদেশে পতিত স্বৈরাচারের নৃশংস দমননীতি, একদলীয় শাসন, সীমাহীন দুর্নীতি, গুম, খুন, নিপীড়ন, গণতন্ত্রহীনতা- এসব নিয়ে, বিশেষ করে বিগত সাধারণ নির্বাচনগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো কখনোই কোনো প্রশ্ন তুলত না; বরং বলা হতো- শেখ হাসিনাই ভারতের কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র মিত্র। কিন্তু এখন তাদের একচোখা নীতি থেকে পশ্চাৎপসরণ হাসিনাসহ উৎখাতকৃত আওয়ামী স্বৈরাচারীদের পরম বন্ধু ভারতীয় গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারকদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আওয়ামী-স্বৈরাচারের দোসরদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দ্য প্রিন্ট পত্রিকায় সম্প্রতি মন্তব্য বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনাকে সমর্থন করে ভারত নিজেই নিজের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। বাংলাদেশে তার জনপ্রিয়তা তলানিতে। এই মন্তব্য দিয়ে সাজানো এই বিশ্লেষণে পত্রিকাটি লিখেছে, বাংলাদেশের জনগণ ভারতের উপর ক্ষুব্ধ। ভারতের স্বার্থ এখন হুমকির মুখে।
ভিন্ন ভাষায় প্রায় একই সুরে কথা বলছেন অন্যান্য সর্বভারতীয় বিশ্লেষকও। পশ্চিম বাংলায় বিজেপি দল রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানের মিত্র হয়ে উঠছে- এই মর্মে প্রচারণা চালালেও দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশকে হারানো ভারতের কৌশলগত আত্মহত্যার শামিল বলেও কোনো কোনো বিশ্লেষক অভিমত প্রকাশ করছেন। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার লঙ্ঘনের নির্মমতা নিরূপণে গঠিত তথ্যানুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদন গত ফেব্রুয়ারি মাসে জেনেভায় জাতিসঙ্ঘ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাই কমিশনার ফলকার তুর্ক সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত থেকে এই প্রতিবেদন জনসমক্ষে উন্মুক্ত করেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, জনগণের চরম বিরোধিতার মুখেও স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আরো অজস্র প্রাণহানি করে হলেও ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। তিনি সাবধান করে দিয়ে বলেন, জুলাই গণহত্যার সাথে যারা যুক্ত তারা যেন পার না পায়। তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, জুলাই-আগস্টে বিক্ষোভ দমনের নিষ্ঠুর পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের যাবতীয় সিদ্ধান্ত দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত ‘কার কমিটি’র মাধ্যমে এবং এই বর্বর নিপীড়নকে সরাসরি সহায়তা দেয় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা এনএসআই, পুলিশের বিশেষ শাখা এসবি, ডিবি, এটিএমসি পুলিশ ও সিটিটিএসের কর্মকর্তারা। জাতিসঙ্ঘের তদন্তে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব সদস্যদের পাশাপাশি সেনা সদস্যদের কিছু সম্পৃক্ততার প্রমাণও পাওয়া যায় বলে উল্লেøখ করা হয়। রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারী কর্মীরা অংশ নেয় বলে জাতিসঙ্ঘ প্রতিবেদনে উল্লেøখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়, ওই সময়ে ছাত্র-জনতার ওপর বর্বর নৃশংসতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ও দল সরাসরি দায়ী। ওই সময়ে ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারবিরোধী মতামত স্তব্ধ করার জন্য এই নিষ্ঠুর দমননীতি পরিচালনা করে, যে জন্য এত মানুষকে গুম, খুন, নির্যাতন, মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার হতে হয়। শেখ হাসিনার এই খুনের রাজনীতি প্রত্যক্ষ মদদ পায় আধিপত্যবাদী ও উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে। তার সাথে যুক্ত হয় কিছু কেন্দ্রীয় মিডিয়া এবং পশ্চিম বাংলার বেশ অনেকগুলো হিন্দুত্ববাদী ও বিজেপির পা-চাটা মিডিয়া। বাংলাদেশবিরোধী বিষোদগারে তারা সাংবাদিকতার ন্যূনতম শিষ্টাচার পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারযুদ্ধ চালিয়েই যাচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতবিরোধী জনমতের যেন সুনামি নেমে এসেছে। অনেক বিশ্লেষক বলেছেন, ‘ভারত তাদের কৌশলগত মিত্র (শেখ হাসিনাকে) বাঁচাতে গিয়ে পুরো বাংলাদেশকেই হারাতে বসেছে।’ বাংলাদেশকে নিয়ে নয়াদিল্লির ক‚টনৈতিক মহলের ভাবনা চিন্তার কথা উল্লেখ করে দ্য প্রিন্ট মন্তব্য করে, শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে। একপক্ষ এখনো হাসিনার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে, আরেক পক্ষ বলছে- এখনই সরে আসার সময়।
একজন বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন, শেখ হাসিনার ভারত-নির্ভরতা এখন তার জন্য রাজনৈতিক অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের সমর্থন তাকে টিকিয়ে রাখতে পারবে না; বরং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ডেকে আনবে। দিল্লির নীতিনির্ধারকদের সামনে এখন দু’টি পথ খোলা- হয় শেখ হাসিনাকে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা, নয়তো হাসিনাকে বাঁচাতে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে পড়া বা নতুন কোনো কৌশলের আশ্রয় নেয়া। এটি ভারতের জন্য বড় ঝুঁকির কারণ হতে পারে। ভারতের নীতি অবস্থান শুধু বাংলাদেশ প্রশ্নেই নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে।
এখানে মনে রাখা দরকার, ভারতীয় গণমাধ্যম গত পাঁচ-ছয় মাস ধরে যেভাবে আওয়ামী স্বৈরাচারের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশবিরোধী বিষোদগার এবং অপসাংবাদিকতা চালিয়েছে তাদের জোঁকের মুখে নুন ঢেলে দিয়েছে জাতিসঙ্ঘ তথ্যানুসন্ধানী দলের প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদনে পতিত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনাকেই বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট (২০২৪) গণহত্যার মূল হোতা এবং নির্দেশ দানকারী খুনি হিসেবে দায়ী করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ড মানবতাবিরোধী অপরাধ। তার সরাসরি পরিকল্পনা ও নির্দেশে পতনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সে জুলাই-আগস্ট বিক্ষোভে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা, শিশু-নারীদের খুনের নির্দেশ এবং মৃত্যুর পর লাশ গুমের নির্দেশ দেয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এই ঠাণ্ডা মাথার নারকীয় গণহত্যায় প্রায় দুই হাজার মানুষ নিহত এবং প্রায় ৩৬ হাজার প্রতিবাদকারী তরুণ-যুবক-সাধারণ মানুষ পুলিশ-র্যাবের গুলিতে চিরতরে পঙ্গু হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে।



