খালেদা জিয়া : উচ্চ নৈতিকতার প্রতিচ্ছবি

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং কূটনীতিতে খালেদা জিয়ার ভূমিকা ছিল বিচক্ষণ ও দূরদর্শী। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা ও অবস্থান সুদৃঢ় করেছেন।

নেতৃত্বের মান কেবল ক্ষমতার দখলে সীমাবদ্ধ থাকে না। নেতার সত্যিকার পরিচয় পাওয়া যায় তার নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ ও জনগণের হৃদয়ের সাথে তার সংযোগ স্থাপনের সক্ষমতার মাধ্যমে। খালেদা জিয়ার জীবন এবং চরিত্র এই সত্যকে প্রতিফলিত করেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে তার পদচারণা ছিল অনড়; কিন্তু তার নৈতিকতা ও কোমলতা ছিল আরো শক্তিশালী। অসুস্থতার মধ্যেও জনগণের পাশে দাঁড়ানো, কঠোর কঠিন সিদ্ধান্তে আপসহীন থাকা এবং সবসময় ন্যায়ের পথে থাকা- এই সবই তাকে মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন দিয়েছে।

খালেদা জিয়ার মাতৃত্বগুণ শুধু পারিবারিক জীবনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এটি পুরো জাতির জন্য প্রসারিত হয়েছিল। মানুষ তার কাছে কেবল রাজনৈতিক নেতা নয়; বরং একজন অভিভাবক হিসেবে ভরসা পেত। দরিদ্র ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি তাদের জীবনে আলোকিত আশা বুনতেন। তার সংলাপ, উদার আচরণ এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মধ্যেও কোমলতা ও সহমর্মিতা বজায় থাকত। এটি প্রমাণ করে যে, শক্তি ও মমতা কখনো একে অপরের বিপরীত নয়।

খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে কটাক্ষ বা বিদ্বেষ কখনো স্থান পায়নি। অপরকে সম্মান জানানো এবং উত্তম আচরণ বজায় রাখা- এগুলো তার রাজনৈতিক দর্শনের মূল স্তম্ভ। সাধারণ মানুষ, যাদের বেশির ভাগই সক্রিয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা নেই, এমন মানুষগুলোও আজ তার অসুস্থতার খবরে ব্যথিত হচ্ছে। বারবার দুঃখ ও সহমর্মিতা জানাচ্ছে, মহান রবের কাছে মনখুলে দোয়া করছে। আবার বিভিন্ন রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত বা এমন দলমতের কিংবা বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ভিন্নমতের মানুষও আজ তার সুস্থতার জন্য দিন-রাত প্রার্থনা করে যাচ্ছে। পুরো দেশের জনগণ আজ তার রোগমুক্তির আশায় একবিন্দুতে মিলিত হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, সত্যিকারের নৈতিক নেতৃত্ব মানুষের অন্তরের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম।

প্রতিটি রাজনৈতিক সঙ্কট বা চ্যালেঞ্জের সময় তিনি জনগণের আশা ও সুরক্ষার জন্য কাজ করেছেন। তার নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ ও সততা রাজনৈতিক ক্ষমতার চেয়েও বেশি প্রভাব ফেলেছে। মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিক দৃঢ়তা এবং গণমানুষের প্রতি সম্মান- এই তিনটি গুণ তার চরিত্রকে নিখুঁত করেছে। এ কারণে রাজনৈতিক সমালোচনা বা বিতর্কের বাইরে মানুষ তাকে হৃদয়ের গভীরে অনুভব করে। তার আচরণ এক গভীর শিক্ষণীয় পাঠ। মানুষ শিখতে পারে কিভাবে ক্ষমতা এবং নৈতিকতা সমন্বয় করা যায়, কিভাবে কঠোর সিদ্ধান্তের মধ্যেও কোমলতা বজায় রাখা যায় এবং কিভাবে জনগণের দুঃখকে নিজের দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করা যায়।

নেতৃত্ব মানে কেবল ক্ষমতা নয়। প্রকৃত নেতৃত্ব ফুটে ওঠে মানুষের জীবনে স্পর্শ করার ক্ষমতায়। খালেদা জিয়া তার রাজনীতিতে এই সত্যকে জীবন্ত রেখেছেন। কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অসংখ্য চ্যালেঞ্জ এবং অসংখ্য সিদ্ধান্তের মধ্যেও তিনি কখনো নৈতিকতার পথে বিচ্যুত হননি। তার প্রতিটি পদক্ষেপে লক্ষ্য ছিল মানুষের কল্যাণ, জনগণের আশা পূরণ এবং দেশের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা। গণমানুষের সাথে তার সম্পর্ক ছিল গভীর ও আন্তরিক। সাধারণ মানুষের দুঃখ, কষ্ট ও আশা তিনি অনুভব করতেন। মানুষের হৃদয়ের অনুভূতিকে নিজের দায়িত্ব মনে করার এই ক্ষমতা তার নেতৃত্বকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। নেতৃত্ব শুধু সংলাপ বা বক্তৃতার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়নি; এটি বাস্তব জীবনের ছোট ছোট কর্মকাণ্ডের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। তার রাজনৈতিক জীবন নানা প্রতিকূলতায় ভরা ছিল। ব্যক্তিগত বিপর্যয়, অসুস্থতা, রাজনৈতিক চাপে থাকা- সব কিছুর মধ্যেও তিনি কখনো আত্মসমর্পণ করেননি। প্রতিটি সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সময় তার নৈতিক মানদণ্ড অটল ছিল।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল দিকগুলোর একটি হলো গণতন্ত্রের প্রতি তার অঙ্গীকার। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই পর্যন্ত- তিনি সবসময় গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তার এই আদর্শিক অবস্থান কেবল বক্তৃতা বা প্রতিশ্রুতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি কঠিন রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখেও বারবার নিজের এবং দলের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন, যেখানে ক্ষমতার প্রলোভনে আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে পারতেন। গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত করার জন্য তার ত্যাগ ও দৃঢ়তা তাকে আপসহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিত করেছে।

স্বৈরাচারের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার আন্দোলনে তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন, তা দেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। একটি জাতির রাজনৈতিক চেতনা ও নাগরিক অধিকারের প্রতি তার সম্মানবোধ তাকে জনগণের চোখে আরো শ্রদ্ধেয় করে তুলেছে। এই সংগ্রাম প্রমাণ করে, তিনি ক্ষমতার চেয়ে জনগণের অধিকারকে বেশি গুরুত্ব দিতেন।

খালেদা জিয়ার জীবন শুধু রাজনৈতিক সংগ্রামের নয়, তিনি স্বামী হারানোর শোক, প্রিয় ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর অকাল প্রয়াণের কষ্ট এবং বড় ছেলে তারেক রহমানকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার নৃশংস নির্মম নির্যাতনের চিত্র মুখ বুজে সহ্য করেছেন। তার পরিবারকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করার নিষ্ঠুর পরিস্থিতি কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সহ্য করা কঠিন; কিন্তু তিনি কখনো নিজের সঙ্কল্প থেকে টলেননি। দেশের মানুষকে পরিত্যাগ করেননি, দেশ ছেড়ে কোথাও যাননি। তিনি ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ে বলেছেন, ‘এই দেশের বাহিরে আমার দ্বিতীয় কোনো দেশ নেই।’ তিনি দেখিয়েছেন, ব্যক্তিগত ক্ষতি বা শোক কখনো নৈতিক দৃঢ়তা এবং জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা নষ্ট করতে পারে না। এই অধ্যায় আমাদের শেখায়, একজন সত্যিকারের নেত্রী কিভাবে ব্যথা ও সংগ্রামের মধ্যেও দেশের মানুষের পাশে থেকে আশা, আস্থা ও মানবিকতার আলো জ্বালাতে পারে।

ব্যক্তিগত আঘাত ও রাজনৈতিক দমন-পীড়ন সত্তে¡ও খালেদা জিয়া তার আদর্শ থেকে সরে আসেননি। জেল-জুলুম ও শারীরিক অসুস্থতার মধ্যেও তিনি জনগণের প্রতি যে আনুগত্য দেখিয়েছেন, তার এই অবিচল নিষ্ঠা রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষের মনে সাহস ও অনুপ্রেরণা জোগায়। তিনি দেখিয়েছেন, রাজনীতিতে সাময়িক সুবিধা বা ক্ষমতার মোহ আদর্শকে কখনো ম্লান করতে পারে না। সত্য ও ন্যায়ের প্রতি তার এই অঙ্গীকার তাকে কালজয়ী নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার জীবনের এই দিকটি প্রমাণ করে, সত্যিকারের নেতা তার আদর্শের কাছে কখনো আত্মসমর্পণ করেন না; বরং আদর্শের জন্য লড়াই করেন।

খালেদা জিয়ার জীবন ও নেতৃত্ব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক শিক্ষণীয় পাঠ। তিনি দেখিয়েছেন, কিভাবে কঠিনতম পরিস্থিতিতেও সাহস, ধৈর্য ও নৈতিকতা বজায় রেখে নেতৃত্ব দিতে হয়। নতুন প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের জন্য তার রাজনৈতিক দর্শন একটি আদর্শ মানদণ্ড স্থাপন করেছে। তিনি বুঝিয়েছেন, জনগণের ভালোবাসা অর্জন করতে হয় ত্যাগ, সততা ও সেবার মাধ্যমে। তারুণ্য তার জীবন থেকে শিখতে পারে, কিভাবে দেশপ্রেমকে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হয় এবং কিভাবে মানুষের দুঃখ-কষ্টকে নিজের দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করতে হয়।

তার নেতৃত্ব জনগণের মনে এই বিশ্বাস তৈরি করেছে, একজন নেতা কেবল ক্ষমতা ভোগ করার জন্য আসেন না; বরং জনগণের সেবার জন্য আসেন। রাজনীতি কেবল ক্ষমতার পালাবদল নয়, এটি জনগণের জীবনমান উন্নয়নের একটি মাধ্যম। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছিলেন, তা ছিল সুদূরপ্রসারী ও জনকল্যাণমুখী। তিনি মুক্তবাজার অর্থনীতিকে উৎসাহিত করেছেন, বেসরকারি খাতকে শক্তিশালী করেছেন এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করেছেন। তার গৃহীত নীতিগুলো দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে এবং অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষত নারীশিক্ষায় তার মনোযোগ এবং নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি তার সরকারের অন্যতম মানবিক পদক্ষেপ ছিল। তার নেতৃত্বে দারিদ্র্য বিমোচন ও মানবসম্পদ উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করাই প্রকৃত নেতৃত্বের অন্যতম দায়িত্ব।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং কূটনীতিতে খালেদা জিয়ার ভূমিকা ছিল বিচক্ষণ ও দূরদর্শী। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা ও অবস্থান সুদৃঢ় করেছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন দৃঢ়তার সাথে, যেখানে দেশের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্বকে সবসময় অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কোন্নয়ন, আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে তিনি বিশ্বমঞ্চে দেশের ইতিবাচক ভাবমর্যাদা তুলে ধরেছেন। এই আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা তার নেতৃত্বের নৈতিক ভিত্তি ও দেশের প্রতি তার গভীর ভালোবাসার ফল। তিনি প্রমাণ করেছেন, নৈতিকতা এবং প্রজ্ঞা একটি দেশকে বিশ্বসমাজে সম্মানের আসনে বসাতে পারে।

লেখক : কলামিস্ট ও লেখক