ইসলামী রাষ্ট্র : তাত্ত্বিক ভিত্তি ও শৃঙ্খলা

ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ব্যবস্থার কেন্দ্রে আছে তাওহিদ। অস্তিত্বের জগতে কোন জিনিস কোথায়, কোন সম্পর্কের মধ্যে, কোন অবস্থানে আছে তার মৌলিক বিন্যাস বা শৃঙ্খলার কেন্দ্র এই তাওহিদ।

ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ব্যবস্থার কেন্দ্রে আছে তাওহিদ। অস্তিত্বের জগতে কোন জিনিস কোথায়, কোন সম্পর্কের মধ্যে, কোন অবস্থানে আছে তার মৌলিক বিন্যাস বা শৃঙ্খলার কেন্দ্র এই তাওহিদ। তাওহিদ অস্তিত্বের স্তরভিত্তিক সত্যকে সঠিক জায়গায় রাখে। যে জিনিস যা তাকে তা-ই হিসেবে স্থাপন করে।

সে বলে মানুষ সৃষ্ট। স্রষ্টা অসৃষ্ট। নৈতিকতা মানবিক আচরণের ভিত্তি। বস্তু মানুষের অধীন। মানুষ স্রষ্টার অধীন।

এখানে আমরা পাই স্তরভিত্তিক অস্তিত্বের মানচিত্র, যেখানে বিভিন্ন সত্তার প্রকৃতি ও তাদের সম্পর্ক নির্দিষ্ট ক্রমে সাজানো। এটি মূলত ড়হঃড়ষড়মু ও যরবৎধৎপযু-এর সমন্বয়; যা প্রতিটি সত্তাকে তার অস্তিত্বগত অবস্থান অনুযায়ী সাজায় এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করে।

এই অস্তিত্বসত্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নির্দেশ করে। যেমন-

১. সত্তার প্রকৃতির স্বীকৃতি : প্রতিটি সত্তা তার প্রকৃতি অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট অবস্থানে থাকে। সর্বোচ্চে, প্রকৃত অর্থে ও অস্তিত্বে আছেন আল্লাহ। আল্লাহর অস্তিত্ব অসৃষ্ট, সীমাহীন এবং চূড়ান্ত ও পরম ক্ষমতা তিনিই। মানুষের অস্তিত্ব হলো সৃষ্টির সীমার মধ্যে। সে আল্লাহর খলিফা (প্রতিনিধি) ও বান্দা। অসীম ক্ষমতার অধিকার মানুষের নেই।

নিচে আছে বস্তুজগৎ; যা আছে মানুষের অধীনে। সে মানুষের নৈতিক ও ব্যবহারিক কার্যক্রমের উপকরণ। বস্তু নিজের আত্মপ্রকৃতিতে ধঁঃড়হড়সড়ঁং নয়। বস্তু কোনো নৈতিক বা জ্ঞানসম্পন্ন কাজ করতে পারে না। তার ক্ষমতা ও অস্তিত্ব সীমিত। সে কেবল প্রদত্ত নিয়ম ও প্রভাবের মধ্যে কাজ করে।

২. জ্ঞানতাত্ত্বিক দিক : মানুষ নিজের সীমা জানলে তার পক্ষে নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাস্তবসম্মত আচরণ সম্ভব। মানুষ সৃষ্ট হওয়ায় সব চূড়ান্ত ন্যায় বা ক্ষমতার এখতিয়ার দাবি করতে পারে না। তাকে স্রষ্টার আদেশ ও প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করতে হবে।

৩. পরিপূর্ণতা ও সামঞ্জস্য : প্রতিটি স্তরের সত্তা অপর স্তরের সাথে সম্পর্কিত হলেও তার প্রকৃতি অপরিবর্তনীয়; অর্থাৎ সৃষ্ট ও অসৃষ্টের অস্তিত্বগত ভিন্নতা হলো চূড়ান্ত সত্য। বিশ্বের প্রতিটি স্তর স্বয়ংসম্পূর্ণ; সুসংগঠিত, স্পষ্টভাবে যুক্তিপূর্ণ বা সহজে বোঝার মতো ধারাবাহিক।

এই যে অস্তিত্বগুলোর অবস্থান ও প্রকৃতি, তা চিরন্তন। কোনো সত্তার প্রকৃতিকে তার সঠিক স্থান থেকে সরানো যায় না। এগুলো ওলটপালট হলে অস্তিত্বগত বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। বাস্তবতার স্বরূপকে বিশৃঙ্খল করে ফেলা হয়। তখন জগৎ, মানুষ, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ক্ষমতা- সব কিছুর অস্তিত্বগত অবস্থান উল্টে যায়। এতে নৈতিক সামাজিক অসঙ্গতি, নৈরাজ্য তৈরি হয়। অস্তিত্বের গভীর শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়। এর ফলে যা ঘটে-

প্রথমত, অধীনতা ও কর্তৃত্বের বিপর্যয়। যা অধীন হওয়ার কথা, তা উপরে উঠে যায়। যেমন- বস্তু বা ক্ষমতা মানুষের সেবক। কিন্তু সে সেবক না থেকে মানুষের শাসক হয়ে যায়। রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক কাঠামো নৈতিক দায়বদ্ধতার অধীন। কিন্তু তার দায় ত্যাগ করে মানুষকেই শোষণের উপকরণ বানায়।

দ্বিতীয়ত, পবিত্রতা ও মানের লাঞ্ছনা। যা পবিত্র বা সত্য, তা লাঞ্ছিত হয়। যেমন- ধর্ম, নৈতিক আদর্শ বা মানবাধিকারকে ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য ব্যবহার করা।

তৃতীয়ত, মাধ্যম ও উদ্দেশ্যের বিপর্যয়। যা মাধ্যম, তা উদ্দেশ্য হয়ে যায়। যেমন- ওষুধ মানুষের চিকিৎসার মাধ্যম। কিন্তু মুনাফার জন্য তা উদ্দেশ্যে পরিণত হয়। সে নিজেই হতে থাকে ক্ষতির বাহন।

অস্তিত্বগত স্তর ও শৃঙ্খলা ভাঙলে অস্তিত্বগত অর্ডার ভেঙে যায়। এটি ভেঙে পড়লে- ক. আল্লাহর জায়গায় মানুষকে বসানো হয়। মানুষ তার সীমিত জ্ঞান ও ক্ষমতাকে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের স্থলে বসিয়ে দেয়। সে স্রষ্টার ক্ষমতা অনুকরণ করতে চায়।

এটি শুধু ফেরাউন-নমরুদের মতো শাসকদের উদাহরণ নয়। এখন তা ছড়িয়েছে নানা মাত্রায়। মানুষ এখন বাণিজ্যিক বা সৌন্দর্যগত লক্ষ্যে জিন পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। সামরিকভাবে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং- মানুষকে যুদ্ধযন্ত্রে রূপান্তর করার ধারণা বিস্তার করছে। এটি অস্তিত্বের প্রকৃত বিন্যাসের চূড়ান্ত লঙ্ঘন। খ. নৈতিকতার ওপর ক্ষমতাকে দাঁড় করানো হয়। ক্ষমতা নৈতিকতার স্থান দখল করে। আমরা দেখছি, করপোরেট লবিং বা রাজনৈতিক ক্ষমতার আচরণ। সে দুনিয়ার দিকে দিকে সত্য ও ন্যায়কে লাঞ্ছিত করছে। গ. সত্যের ওপর মতামতের জমিদারি শুরু হয়। সত্য বা বাস্তবতা স্থির। কিন্তু মানুষের ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক মতামত সত্যের জায়গা দখল করতে চায়। যেমনটি আমরা দেখছি; সংবাদ বা তথ্যকে বিকৃত করা হচ্ছে। ঘ. মানুষের মালিক বানানো হয় সম্পদকে। তখন অর্থ বা সম্পদ মানুষকে পরিচালনা করে। মানুষের নৈতিক বা জ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্তকে চালিত করে বস্তু, অর্থ। ঙ. বিজ্ঞানকে ধ্বংসের হাতিয়ার বানানো হয়। বিজ্ঞান মূলত সত্য অনুসন্ধান ও মানবকল্যাণের জন্য। কিন্তু যখন অস্তিত্বগত অর্ডার ভেঙে যায়- যখন নৈতিকতার বদলে ক্ষমতা ও স্বার্থ বিজ্ঞানকে চালিত করে। ফলে বিজ্ঞান মানবতার জন্য ধ্বংসের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। চ. পরিবেশ বনাম উন্নয়নের বিরোধ : প্রযুক্তির আশ্রয়ে মানুষ প্রকৃতির শত্রু হয়ে ওঠছে। উন্নয়নের নামে, ভোগের প্রয়োজনে তারা প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। ফসিল ফুয়েলনির্ভর শিল্পায়ন পৃথিবীকে জলবায়ু ও ইকোসিস্টেম ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে। প্লাস্টিক ও রাসায়নিক পদার্থের মাধ্যমে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। সৃষ্টির ভারসাম্য ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ছ. মানুষের নৈতিক সংবেদনহীন সিদ্ধান্তকে যন্ত্রের ওপর ছেড়ে দেয়া হয় : মানুষের নৈতিক বিচারকে মেশিন অ্যালগরিদম দিয়ে অদলবদল করা হচ্ছে। এর ফলে নৈতিক দায়িত্ব, ক্ষমতার ভারসাম্য ও মানবসত্তার পবিত্রতা ধ্বংস হচ্ছে।

এই যে বিপদের দরজা খুলেছে, তা ক্রমবর্ধমান। আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর অসুখের কাতরানি এর মধ্যে শোনা যাচ্ছে। অথচ আসমানি অর্ডার অনবরত বলেছে- ন্যায়, সত্য, জ্ঞান ও ক্ষমতাকে প্রাকৃতিক ও দার্শনিক প্রেক্ষাপটে নির্দিষ্ট স্থান এবং সম্পর্ক অনুযায়ী স্থাপন করতে হবে। অস্তিত্বগত সত্যের যথাস্থান ও বিন্যাস লঙ্ঘন হলে যেসব বিপদ ঘটে, তার পরিসর ব্যাপক ও বিস্তৃত।

এই সত্যলঙ্ঘনে জন্ম নেয়- ক. নৈতিক বিভ্রান্তি (গড়ৎধষ পড়হভঁংরড়হ) : নৈতিকতা অস্তিত্বগত ক্রম অনুযায়ী স্থাপিত একটি শৃঙ্খলা। এটি ভেঙে গেলে কি সঠিক, কি ভুল- তাও বোঝা যায় না। খ. আত্মপরিচয়ের সঙ্কট (ওফবহঃরঃু পৎরংরং) : মানুষের অস্তিত্বগত পরিচয় তার নৈতিক দায়িত্ব, উদ্দেশ্য ও ক্ষমতার সঠিক বিন্যাসের ওপর নির্ভর করে। যদি সত্য ও ন্যায় বিকৃত হয়, মানুষ জানতে পারে না সে কে বা তার লক্ষ্য কী? সে জানে না তার মূল্য কোথায়? গ. সমাজে ‘উল্টো নীতি’ (ওহাবৎঃবফ ড়ৎফবৎ) : সত্য, ন্যায় ও ক্ষমতার প্রাকৃতিক ক্রম উল্টে গেলে, সমাজের অস্তিত্বগত নৈতিক ফিতরাত বিপর্যস্ত হয়। তখন অপরাধী হয় প্রভাবশালী। সততা হয় দুর্বল। জ্ঞান হয় বাজারের দাস। সম্পদ হয় ঈশ্বরতুল্য। দুর্বৃত্তপনা হয় রাজনীতি।

রাজনৈতিক স্তরে ক্ষমতা নৈতিকতার অধীন থাকে না; বরং নৈতিকতাকে ক্ষমতার অধীন করা হয়। এর ফলে শাসক উঠে যায় নৈতিকতার ঊর্ধ্বে। আইনের উৎস হয়ে যায় স্বার্থ। ন্যায় বদলে যায় শক্তির পরিমাপে। সত্য তৈরি করা হয় প্রোপাগান্ডায়। রাষ্ট্র হারায় অস্তিত্বগত বৈধতা। এটি আধুনিক সেক্যুলার বাস্তবতায় খুব সাধারণ কিন্তু খুব ভয়াবহ অসুখ।

আধ্যাত্মিক স্তরে মানুষ স্রষ্টাকে ভুলে যায়। নিজেকে কেন্দ্র করে সভ্যতা গড়ে তোলে। নিজের খেয়ালকে সত্য বলে মানে। এর ফলে আধ্যাত্মিক অস্তিত্ব ভেঙে পড়ে। অতএব রাষ্ট্রকে তাওহিদের ধারক হতে হবে। নতুবা সে অস্তিত্বের সবচেয়ে গভীর বিশৃঙ্খলায় পতিত হবে।

অস্তিত্বগত শৃঙ্খলা অস্তিত্বগত অর্ডারিংয়ের ব্যবস্থাপনাকে আমন্ত্রণ করে। এটি এই শৃঙ্খলার কার্যকরী রূপ; যা স্রষ্টার নির্দেশনা অনুযায়ী বাস্তবায়িত হয়। এতে আছে আমর বা আদেশ; যে কাজ বা আচরণ সঠিক, তার আদেশ ও উৎসাহ দান। এ হচ্ছে অস্তিত্বের সঠিক বিন্যাসের অভিব্যক্তি।

তাওহিদভিত্তিক অস্তিত্বদর্শন এই অর্ডারিং বা তাশরিকে রাষ্ট্রের নির্দেশক বানায়। প্রতিটি সত্তাকে তার প্রকৃত স্থানে এবং প্রকৃত উদ্দেশ্যে রাখাই তাওহিদভিত্তিক শৃঙ্খলার মূল। এই তাশরি বা অর্ডারিং সম্পর্ককে সঠিক করে। একে চার ধারায় দেখা যায়।

প্রথমত, মানুষ-স্রষ্টার সম্পর্ক। মানুষের অস্তিত্ব আল্লাহর রহমত, ইরাদা (ইচ্ছা) ও কুদরতের ফসল। আল্লাহর সাথে তাকে সম্পর্কিত থাকতে হবে। এই সম্পর্ক খালিক (স্রষ্টা)-মাখলুকের (সৃষ্টির), আশিক-মাশুকের, আবিদ (বান্দা) মাবুদের। এই সম্পর্কের মাত্রা আরো বহুবিস্তৃত।

রাষ্ট্র এই সম্পর্ককে সম্মানিত করবে। আইন, শিক্ষা, নীতিনৈতিক কাঠামো, সবই আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্কের দায়িত্ব ও নৈতিক কর্তব্যকে প্রাধান্য দেবে।

দ্বিতীয়ত, এই শৃঙ্খলার দাবি, মানুষ একে অপরের প্রতি ন্যায়, সহানুভূতি ও দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করবে। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের হক আদায় করবে।

তৃতীয়ত, মানুষ-প্রকৃতির সম্পর্ক। প্রকৃতি ও বিশ্বজগতে মানুষ আল্লাহর খলিফা। আল্লাহর ফিতরাতের সুরক্ষা তার দায়িত্ব। প্রকৃতির সে সেবক। যথেচ্ছ ব্যবহারকারী নয়। ব্যবহারের অধিকার আছে, কিন্তু নিয়মের কঠোর আওতায়।

রাষ্ট্র পরিবেশনীতি, জীবের হক এবং সম্পদ ও প্রকৃতির সাথে ন্যায়সঙ্গত আচরণ নিশ্চিত করবে। পানি, বন, মাটি- সব কিছু মানবকল্যাণ ও সৃষ্টির ভারসাম্যের অনুকূলে ব্যবহৃত হবে।

চতুর্থত, মানুষের নিজের সাথে নিজের সম্পর্ক। মানুষ তার আত্মা, মনন ও দেহসত্তার সমন্বয়। প্রত্যেক সত্তার সাথে তার আচরণ হবে ভারসাম্যপূর্ণ। ইনসাফপূর্ণ। প্রতিটি সত্তার বিকাশ জরুরি। পরস্পরের সম্পর্ক ও প্রাপ্যকে সুস্থ ও যথাযথ করা জরুরি।

রাষ্ট্র এই সম্পর্ককে সম্মানিত করে। শিক্ষা ও সামাজিক কাঠামোর মাধ্যমে সুগঠিত করবে। শিক্ষাব্যবস্থা ও আইন ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে সমন্বয় বজায় রাখবে।

অতএব রাষ্ট্র কেবল ক্ষমতার যন্ত্র নয়; বরং সত্তাগুলোর সঠিক বিন্যাস রক্ষা ও প্রয়োগের প্রতিষ্ঠা। এটিই তাশরি-এর রাজনৈতিক দর্শন। এই দর্শনে আছে সংশ্লিষ্ট সব সত্তা, সম্পর্ক, মূল্য, কম- কোথায় থাকবে এবং কিভাবে চলবে, এর ন্যায়সঙ্গত বিন্যাস।

অতএব, রাষ্ট্রের সামনে এই তাশরি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টি উন্মোচন ঘটায়।

প্রথমত সে অস্তিত্বের স্তর নির্ধারণ করে। সে শেখায়, কোনটি উচ্চতর-কোনটি নিম্নতর।

ক্ষমতা বা রাষ্ট্র- ন্যায় প্রয়োগের মাধ্যম, উদ্দেশ্য নয়। সে শেখায় কোনটি উদ্দেশ্য- কোনটি মাধ্যম।

দ্বিতীয়ত, নৈতিকতার ভিত্তি নির্ধারণ করে এই অর্ডারিং। তাওহিদভিত্তিক অর্ডারিং নৈতিকতাকে ভিত্তিহীন রাখে না; বরং সরাসরি বলে দেয়, কেন একটি কাজ সঠিক? কেন একটি কাজ ভুল?

এখানে স্পষ্ট হয় অসংখ্য নীতিসূত্র। যেমন- ক. ঈশ্বর সর্বোচ্চ হলে, তাঁর অবাধ্যতা অন্যায়। তার অবাধ্যতা মানে- সর্বোচ্চ মূল্যকে অস্বীকার করা। সামঞ্জস্যের মূলকে ভেঙে ফেলা। খ. মানুষ সম্মানিত হলে, তার অপমান নৈতিক অপরাধ। কারণ মানুষের সম্মান কোনো সামাজিক চুক্তির ফল নয়। এটি তার অস্তিত্বগত মর্যাদার ফল। অতএব অবিচার, বৈষম্য, দাসত্ব, শোষণ- সবই অস্তিত্বগত অপরাধ। গ. সম্পদ মানুষের জন্য হলে সম্পদের দাসত্ব মানুষের জন্য অন্যায়। এটি ইসলামের উন্নত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দর্শন। সম্পদ উদ্দেশ্য নয়। সম্পদ মানবমর্যাদার উপরে নয়। সম্পদ জরুরি; কিন্তু নৈতিকতার নিচে। তৃতীয়ত, এই অর্ডারিং থেকে রাষ্ট্রের প্রকৃত ভূমিকা স্পষ্ট হয়।

তাওহিদি রাষ্ট্রতত্তে¡ রাষ্ট্রের তিনটি প্রধান কাজ :

ক. সত্তার মর্যাদা রক্ষা। মানুষ, প্রকৃতি, সমাজ, পরিবার, জ্ঞান, নৈতিকতা। সব কিছুকে সঠিক স্থানে স্থাপন করতে হবে রাষ্ট্রকে। কারো ভূমিকা কমবে না, বাড়বেও না। খ. হকগুলোর বিন্যাস ও বাস্তবায়ন। মানুষের প্রতি আল্লাহর হক। আল্লাহর প্রতি মানুষের হক। ব্যক্তির প্রতি সমষ্টির হক। সমষ্টির প্রতি ব্যক্তির হক। মানুষের প্রতি প্রাণ ও প্রকৃতির হক। প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি মানুষের হক। দেহের প্রতি আত্মার হক। আত্মার প্রতি দেহের হক। সব কিছুর পূর্ণাঙ্গ শৃঙ্খলাকে যথাবাস্তবায়ন রাষ্ট্রের অস্তিত্বগত দায়িত্ব। গ. ন্যায়কে নিশ্চিত করা। ন্যায় মানে প্রতিটি সত্তাকে তার প্রকৃত স্থানে রাখা। সত্তাগুলোর প্রকৃতি, মর্যাদা, উদ্দেশ্য ও সম্পর্ক প্রভৃতি মেটাফিজিক্যাল আর্কিটেকচারকে সামাজিক-রাজনৈতিক রূপ দেয়। সেখানে নৈতিকতা জন্মায় অস্তিত্বগত সত্য থেকে। আইন জন্মায় সত্যের বিন্যাস থেকে। ন্যায় প্রতিষ্ঠা পায় সত্তার প্রকৃত স্থানে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে। তাওহিদের কাছে এই তাশরি শুধু বিশ্বাস নয়; বরং মহাজাগতিক অস্তিত্বগত শৃঙ্খলা। রাষ্ট্র হচ্ছে তাওহিদভিত্তিক নৈতিক শৃঙ্খলার রক্ষক।

এখানে প্রতিটি সম্পর্ক অস্তিত্বগতভাবে ঠিক স্থানে থাকবে। এর অধীনে রাষ্ট্র হবে এমন একটি কাঠামো; যা ১. আদল বা ন্যায়কে শীর্ষ মূল্য হিসেবে রাখে; ২. মানুষকে সম্মানিত সত্তা হিসেবে সুরক্ষা দেয়; ৩. ক্ষমতাকে নৈতিকতার অধীনস্থ রাখে; ৪. সম্পদকে ব্যক্তিক ও সামাজিক আমানাহ হিসেবে দেখে; ৫. সব কিছুকে তাওহিদি সম্পর্কের মধ্যে স্থাপন করে।

ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্বতত্ত¡ ঘোষণা করছে যে, অস্তিত্বের প্রতিটি সত্তা তার প্রকৃত স্তর, সীমা ও উদ্দেশ্যের মধ্যে থাকলেই ন্যায়, জ্ঞান ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়।

লেখক : কবি, গবেষক