মাথা হেঁট সাংবাদিকতা ও ড. খলিলের শিরদাঁড়া

ভারত গায় গতরে বড় হতে পারে, কিন্তু তাদের নৈতিক বল বাংলাদেশের বিপরীতে এখন শূন্য।

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বলেছেন, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাংলাদেশ কারো হস্তক্ষেপ চায় না। কথাটি তিনি এমন একসময় বলেছেন যখন ভারতের সীমাহীন হস্তক্ষেপের জেরে সৃষ্ট জনবিস্ফোরণে শেখ হাসিনা পালিয়ে সে দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। ড. খলিল এ বক্তব্য দেন ভারতের রাজধানী দিল্লিতে এক আঞ্চলিক সম্মেলনে। কলম্বো কনক্লেভ নামের ভারত মহাসাগরীয় এ আঞ্চলিক জোট ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছে। এর লক্ষ্য চীনের প্রভাব মোকাবেলা। ভারতের দুর্ভাগ্য হলো- এ জোটের সব দেশে চীন প্রভাবিত সরকার। বিচলিত ভারত তাই বড় আগ্রহ নিয়ে গত বছরের মে মাসের দিকে বাংলাদেশকে এই জোটের সদস্য করে। তার কয়েক মাসের মাথায় দিল্লির তাঁবেদার হাসিনা পদচ্যুত হন। এখন সেই জোটের সম্মেলনে ড. খলিলের এই বক্তব্য দিল্লিকে হজম করতে হচ্ছে। খলিলের বক্তব্যে ভারতের প্রতি কোনো আক্রমণ বা বিদ্বেষ নেই। তার বক্তব্য ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপে পিষ্ট সমগ্র বাংলাদেশীর মনের কথা।

বাংলাদেশের সরকারি মুখপাত্রের মুখে ভারত শুধু সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ নিয়ে কথা শুনতে উৎসাহী। কারণ এ ধরনের বক্তব্য দিলে ভারতের অভ্যন্তরে মুসলমানদের ওপর পীড়নে সমর্থন মেলে। হাসিনা দেড় দশক ধরে খেয়ে না খেয়ে মুসলমানদের নানা ট্যাগ দিয়ে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী নীতি বাস্তবায়নে অব্যাহতভাবে সমর্থন যুগিয়েছেন।

গত কয়েক বছরে ভারতের প্রতিবেশী প্রায় সব দেশে ভারতবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় এসেছে। কেবল বাংলাদেশে তাদের একটা পুতুল সরকার ছিল। জুলাই বিপ্লবে হাসিনা পদচ্যুত হওয়ার পর দেশটির মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম। তারা বাংলাদেশের সাথে অস্বাভাবিক আচরণ করছে। অঙ্গীকার প্রতিশ্রুতি ও রাষ্ট্রীয় প্রটোকল মানতেও অস্বীকার করে। বিপুল আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে মৌলবাদের উত্থান তকমা দিয়ে অপপ্রচার চালায়। প্রকাশ্যে অবরোধ আরোপ না করতে পারলেও চেপে ধরার সব চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বীকৃতি দিতে গড়িমসি করেও শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশে তাদের সরকারি প্রতিনিধি দল পাঠানো প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকেও কাউকে ভারতে আমন্ত্রণ জানায়নি। এতে তাদের লাভ হয়নি। এখন নীতি বদলাচ্ছে। হাসিনা দণ্ডিত হওয়ার পর ভারত এখন এমন চাপে পড়েছে যে, নিষ্কৃতির পথ পাচ্ছে না। পেলে পুষে বানানো এই ফ্যাসিস্ট এখন তাদের গলার কাঁটা। শেষ পর্যন্ত তারা বাধ্য হলো কলম্বো কনক্লেভ সম্মেলনে ড. খলিলকে আমন্ত্রণ জানাতে।

হাসিনা পালানোর পর ড. খলিলই বাংলাদেশের সরকারি পর্যায়ের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা যিনি ভারতে গেলেন। ভারতে উপস্থিত হয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে ড. খলিল বাজিমাত করেছেন। তিনি প্রথম সুযোগে ঠিক জনগণের আকাক্সক্ষার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, ‘সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন বাংলাদেশ আপস করবে না।’ জলদস্যুতা, অবৈধ মাছ ধরা ও সামুদ্রিক সন্ত্রাসবাদ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ যে বিভ্রান্তিমূলক অপতথ্য ও অসত্য তথ্যের হুমকির মধ্যে পড়েছে তার উল্লেখ। সম্মেলনে উপস্থিত শ্রীলঙ্কা, মরিশাস ও মালদ্বীপ থেকে বাংলাদেশ এই হুমকিতে পড়েনি। পড়েছে মূলত ভারতের দিক থেকে। তারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ড. ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে তথ্য-সন্ত্রাস চালিয়েছে। দেশটির মূল ধারার সংবাদমাধ্যমেও অপতথ্য ও গুজব ছড়ানো হয়েছে। তারা এমনও বানোয়াট খবর প্রকাশ করেছে যে, ‘ড. ইউনূস ফ্রান্সে পালিয়ে গেছেন। উপদেষ্টা মাহফুজ আলম জঙ্গি হিজবুত তাহরীরের সদস্য। জুলাই বিপ্লবীরা বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র ঘোষণা করেছে এবং এক কোটি হিন্দু ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে।’ এগুলো যেমন তাদের মিডিয়া প্রচার করেছে। একই সাথে তাদের মন্ত্রী-এমপি এমনকি শীর্ষস্থানীয় নেতারাও জনপরিসরে অবলীলায় এসব উদ্ভট কথাবার্তা বলেছেন, যা মানুষের বিনোদনের খোরাক জুগিয়েছে। ভারতের মূল ধারার সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত এক ভিডিওতে দেখা যায়, সীমান্ত প্রাচীর অতিক্রম করে এক বাংলাদেশী ভারতীয় এক ব্যবসায়ীর বাড়ি থেকে সাইকেল চুরি করে নিয়ে আসছে। ভিডিও যাচাই করে দেখা যায়, ঘটনাটি দক্ষিণ আমেরিকার দেশ প্যারাগুয়ের।

হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পনেরো মাসে এমনই সব মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যে সয়লাব করে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতীয় মিডিয়া। এর ফলে ইউনূস সরকার দেশ চালাতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। সে কারণে ড. খলিল দিল্লিতে ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের উপস্থিতিতে এই হুমকি মোকাবেলার তাগিদ দেন। বাংলাদেশের দিক থেকে এমনটা শুনতে তারা অভ্যস্ত নন।

বাংলাদেশে শত শত মিডিয়া গড়ে উঠেছে, যাদের পাঠক বাংলাদেশীরা। তবে তারা ভারতের মিডিয়ার অপকর্মের জবাব দেয়ার কোনো প্রয়োজনই মনে করে না, বরং কিছু ক্ষেত্রে তাদের তথ্য সন্ত্রাসের সহযোগী হয়। সংখ্যালঘু নির্যাতনের বহু ভুয়া খবর এরাই আগবাড়িয়ে প্রচার করে। পরে পরিস্থিতির চাপে পড়ে সেসব খবর প্রত্যাহারও করে। কিন্তু যে মিডিয়া ও সাংবাদিক এই ভুয়া খবর বানিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ায় একই ধরনের মিথ্যা খবরের প্রচার বাংলাদেশী মিডিয়ায় চলছেই। বাংলাদেশী মিডিয়া ক্ষেত্রবিশেষে ভুল শিকার করলেও ভারতীয় মিডিয়া করেনি।

বাংলাদেশী মিডিয়া ভারত নিয়ে সংবাদ প্রকাশে অনেকটা যেন বিকারগ্রস্ত। মূল ধারার বেশির ভাগ মিডিয়া ভারতের ইতিবাচক খবর অতিরঞ্জন করে, যেটা তারা বাংলাদেশী খবরের ক্ষেত্রে করে না। এ দেশের মিডিয়া দেখে অনেক সময় বোঝার উপায় থাকে না, সেটা ঢাকা থেকে নাকি দিল্লি বা কলকাতা থেকে প্রকাশ হচ্ছে। প্রথম পাতার মাস্টহেডের পাশে প্রতিনিয়ত ভারতীয় নায়ক-নায়িকার ছবি ছাপায় তারা। বিনোদন পাতা ভরে ওঠে মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্রের নানামুখী বিবরণে। চলচ্চিত্রে মুসলিম দেশ ইরান ও তুরস্ক ভারতের চেয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। এসব দেশের চলচ্চিত্র ও নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে বাংলাদেশের মিডিয়ার আগ্রহ সামান্যই।

পত্রিকার আন্তর্জাতিক পাতায় ভারতের সব ইতিবাচক খবর। এর মধ্যে থাকে ভিত্তিহীন বাড়াবাড়িমূলক খবরও। ভারতীয় এজেন্সির খবর যাচাই-বাছাই ছাড়া ছেপে দেয়া হয়। অন্য দিকে ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানের সব নেতিবাচক খবর প্রকাশে তারা বেশি আগ্রহী। সম্প্রতি একটি প্রদর্শনীতে ভারতীয় বিমান তেজস বিধ্বস্ত ও তার পাইলট প্রাণ হারান। দুবাইতে অনুষ্ঠিত এই এয়ার শো সারা বিশ্বের মিডিয়ার নজর কাড়ে। এই শোতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ক্রয় আদেশ পায় বিমান কোম্পানিগুলো। ভারত তার তেজস নিয়ে বড় উৎসাহের সাথে এই শোতে অংশ নেয়। সম্প্রতি তাদের বিমানবাহিনী নানাভাবে কোণঠাসা। পাকিস্তানের কাছে যুদ্ধে ছয়টি বিমান হারায়। দুবাই প্রদর্শনীতে তেজসের অর্ডার পাওয়ার আশা ছিল তাদের। সেখানে পাইলটের দক্ষতা ও বিমানটির কার্যকারিতা নিয়ে উল্টো বড় প্রশ্ন উঠেছে। কারণ বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে পাইলটের মৃত্যু হয়েছে। কিছু দিন আগেও তেজস দুর্ঘটনায় পড়ে। যুদ্ধবিমান রফতানি করার ভারতের আশা বড় ধাক্কা খেলো। পাকিস্তানের সাথে আকাশ যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে খসে যাওয়া তাদের ভাবমর্যাদা এই এয়ার শোতে অংশ নিয়ে আরো ধসে গেল। এই গুরুত্বপূর্ণ খবরটি বৈশ্বিক মিডিয়ায় গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে। কিন্তু আমাদের মিডিয়ায় এই খবর স্থান পায়নি। এমনকি পত্রিকার আন্তর্জাতিক পাতায়ও এ খবরের অস্তিত্ব নেই। এভাবে আমাদের মিডিয়া যখনই ভারতের কোনো নেতিবাচক খবর আসে সেটাকে পাঠকের কাছে থেকে লুকিয়ে ফেলে। এ দিকে পাকিস্তানে জঙ্গিবাদ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, হত্যা ও খুনের খবর পেলেই গুরুত্ব দিয়ে ছেপে দেয়।

বাংলাদেশের সাংবাদিকদের ভারতপ্রীতি দৃষ্টান্তমূলক। দেশের প্রতিও তারা এতটা ইন্টিগ্রিটি দেখান না। তাই ভারতেরও ভরসা বাংলাদেশের সাংবাদিকদের ওপর। ৫ আগস্টের পর প্রথম ভারত সফরের আমন্ত্রণ পান একদল সাংবাদিক। পরে দেখা গেল আমন্ত্রিত সাংবাদিকদের সংশ্লিষ্ট মিডিয়ায় কোনো রিপোর্ট নেই। তবে উচ্ছ¡াস নিয়ে তারা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন। তারা ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিবিড় দেখতে চান। কিন্তু ভারতের সাথে সম্পর্ক কেন খারাপ সে দিকে নজর দিতে রাজি নন। এমনকি হাসিনার শাসনে ভারতের যে অবৈধ হস্তক্ষেপ তা নিয়েও চুপ। এ কারণে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো: তৌহিদ হোসেন ভারত সফরে সাংবাদিকদের দায়িত্বহীনতা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন।

এ দিকে ভারতের প্রতি অতিমাত্রায় নমনীয় আচরণের জন্য অনেকে তৌহিদ হোসেনের ওপর খুশি নন। পাঠকরা একটু ভেবে দেখুন। বাংলাদেশী সাংবাদিকদের সাথে আলোচনায় ভারতের পররাষ্ট্র সচিব, ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বচ্ছ’ নির্বাচনের কথা বলেন। এ সময় বাংলাদেশী সাংবাদিকরা অতীতের নির্বাচন নিয়ে ভারতের ন্যক্কারজনক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। তৌহিদ হোসেন সে জন্য এই সাংবাদিকদের ওপর বিরক্ত। তার বক্তব্য হচ্ছে, ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব নির্বাচন প্রসঙ্গে বক্তব্য দিয়ে বাংলাদেশী সাংবাদিকদের একটি সুযোগ দিয়েছিলেন। তারা অতীতের নির্বাচনে ভারতের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করতে পারতেন। কিন্তু কেউ সে প্রশ্ন করেননি। তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আপনাদের মুখে প্রশ্নটা তুলে দেয়া হয়েছিল যে আপনারা কেন এই কথা গত ১৫ বছরে বলেননি? আগের নির্বাচনগুলো কি আপনাদের এই ফর্মুলা অনুযায়ী সঠিক ছিল?’

হাসিনার সময়ে বাংলাদেশী শীর্ষ কর্মকর্তারা জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রতা নিয়ে ভারতীয়দের সামনে গরম গরম বক্তৃতা দিতেন। সেই প্রত্যাশা থেকে কলম্বো কনক্লেভে তারা বাংলাদেশকে সদস্য করেছিল। দুর্ভাগ্য, তাদের সেই পুতুল সরকার আর নেই। ড. ইউনূস সরকারের নিযুক্ত ড. খলীলের স্বাধীন মতামত প্রকাশ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। আশা করা যায়, পরবর্তী সরকারের পররাষ্ট্রনীতি ড. খলীলের দেখানো পথ ধরে হাঁটবে।

ড. খলীলের বক্তব্য বাংলাদেশে সেভাবে আলোচিত হয়নি। বরং এমন সব কথা সামনে এসেছে যে, তিনি নতি শিকার করে ভারতে গেছেন। এমনকি ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ভারতের ইচ্ছা অনুযায়ী ড. ইউনূস সরকারকে কী কী করতে হবে তারই একটা তালিকা ড. খলীলের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন এমন কথাও এসেছে। যদিও ড. খলীল-দোভালের মুখোমুখি হওয়ার প্রত্যেকটি ছবিতে দেখা গেছে, খলীলের মাথা সোজা, দোভাল মাথা নিচু করে আছেন। গুম খুন গণহত্যা চালিয়ে পালিয়ে যাওয়া এক দণ্ডিত অপরাধীকে আশ্রয় দেয়ার পর মাথা সোজা রাখা কিভাবে সম্ভব! ভারত গায় গতরে বড় হতে পারে, কিন্তু তাদের নৈতিক বল বাংলাদেশের বিপরীতে এখন শূন্য। দেড় দশক ধরে নগ্ন হস্তক্ষেপ চালানোর পর এখন তাদের পালা এত দিনের বিপুল অনিয়ম-অন্যায়ের জন্য অনুতপ্ত হওয়ার।

লেখক : সহকারী সম্পাদক, দৈনিক নয়া দিগন্ত