বাংলাদেশে ভূমিকম্প

বাংলাদেশ হঠাৎ কেঁপে উঠল। জানা গেল ভূমিকম্প হয়েছে। এরকম মাঝে মধ্যে ঘটছে। বাংলাদেশের চার পাশে প্রতিবেশী দেশগুলো মারাত্মক ভূমিকম্পপ্রবণ। এর মধ্যে আছে চীন, নেপাল, ভারত, মিয়ানমার প্রভৃতি দেশ।

নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশ হঠাৎ কেঁপে উঠল। জানা গেল ভূমিকম্প হয়েছে। এরকম মাঝে মধ্যে ঘটছে। বাংলাদেশের চার পাশে প্রতিবেশী দেশগুলো মারাত্মক ভূমিকম্পপ্রবণ। এর মধ্যে আছে চীন, নেপাল, ভারত, মিয়ানমার প্রভৃতি দেশ। ছোটবেলায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড অঞ্চলে খালাত বোনের বিয়ে উপলক্ষে আম্মা গিয়েছিলেন। তিনি ফিরে এসে বলেছিলেন, সেখানকার ঘরবাড়ির জানালাগুলো নিচু। আমার কাছে মনে হয়েছে ভূমিকম্পের কারণে এমনটি ঘটেছে। সীতাকুণ্ড ও মীরেরসরাই অঞ্চলে মাটির নিচে আগ্নেয়গিরি আছে। যে অঞ্চল যত প্রাচীন, সে অঞ্চলে ভূমিকম্পের আশঙ্কা বেশি। বৃহত্তর নোয়াখালীর মধ্যে ফেনী প্রাচীন। তাই ফেনীতে ভূমিকম্পের প্রবণতা বেশি। লালমাটি অঞ্চলেও ভূমিকম্পের প্রবণতা বেশি।

মিয়ানমারে কয়েক দিন আগে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। এই ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মার্কিন ভূতাত্তি¡ক জরিপ সংস্থা ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভের এক মডেলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পেজার নামের এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনা ভূমিকম্পে হতাহতের সংখ্যা ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি সম্বন্ধে অনুমান করে থাকে। এই অনুমানের জন্য যেসব তথ্য-উপাত্তকে বিবেচনায় নেয়, তার মধ্যে কম্পনের তীব্রতা এবং ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জনসংখ্যাও আছে।

ইউএসজিএসের মডেল মৃতের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি হবে বলে আশঙ্কা করলেও মৃতের সংখ্যা হাজার এবং আহত ১৬৭০ জন বলে জানিয়েছে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ।

বিবিসির সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, ২৮ মার্চ ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের পর মান্দালয়ে ২৯ মার্চ সকাল পর্যন্ত একাধিক মৃদু কম্পন অনুভূত হয়েছে। আতঙ্কে শহরটির অনেক বাসিন্দাই খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছেন। মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তর শহর মান্দালয়ে প্রায় ১৫ লাখ বাসিন্দার বাস।

২৯ মার্চ সকাল পর্যন্ত মিয়ানমারের বৃহত্তম দুই শহর ইয়াঙ্গুন ও মান্দালয়ে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সেবা ফেরেনি। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের পর মিয়ানমারে দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়। অনেক মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছেন, বাঁচার জন্য কাঁদছেন তারা। কিন্তু তাদের উদ্ধার করতে কোনো ভারী যন্ত্রপাতি আসেনি। এ জন্য খালি হাতেই চলছে উদ্ধারের প্রচেষ্টা, এর মাধ্যমে সবাইকে বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না।

ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহৎ শহর মান্দালয়। সেখান থেকেই এমন নির্মম তথ্য তুলে এনেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। হেতেত মিন নামের ২৫ বছর বয়সী এক যুবক রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ‘ভূমিকম্পের পর তার ওপর একটি দেয়াল ভেঙে পড়ে। এতে তার অর্ধেক শরীর চাপা পড়ে যায়। তবে তিনি বেঁচে যান। কিন্তু ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছেন তার দাদী ও দুই চাচা। তিনি হাত দিয়েই ধ্বংসস্তূপ সরানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন।

‘ধ্বংসস্তূপের পরিমাণ অনেক বেশি। কোনো উদ্ধারকারী দল আমাদের এখানে আসেনি।’ এসব বলতে বলতে কেঁদে দেন হেতেত মিন। মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, মিয়ানমারে ভূমিকম্পটি আঘাত হেনেছে খারাপ সময়ে। দেশটি গৃহযুদ্ধের কারণে এমনিতেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যেই ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ল তারা।

আন্তর্জাতিক উদ্ধার কমিটির মিয়ানমারের পরিচালক মোহাম্মদ রিয়াস বলেছেন, পুরো দেশের মানুষ ‘ব্যাপক সহিংসতায়’ বিপর্যস্ত। গৃহযুদ্ধ, কলেরা ও অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা (আগেই) শোচনীয় হয়ে পড়ে। ভূমিকম্প এখন এটির ওপর আরো প্রভাব ফেলবে।’

যেসব অঞ্চল ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখানে সক্রিয় কোনো সরকারই নেই বলে জানিয়েছেন ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের মিয়ানমার একাডেমিক নই নই কয়ো। তিনি আরো জানিয়েছেন, মিয়ানমারের জান্তা তরুণদের জোর করে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এতে বেশির ভাগ অঞ্চলেই তরুণরা নেই, যা উদ্ধার কাজকে ব্যাহত করছে। তিনি বলেছেন, যদি তরুণরা তাদের নিজ অঞ্চলে থাকত তাহলে উদ্ধার অভিযানে সবার আগে তারা এগিয়ে আসত। অন্যদের জড়ো করত। কিন্তু এখন এগুলো হচ্ছে না। মিয়ানমারের জান্তার সাথে উদ্ধার অভিযানের ব্যাপারে যোগাযোগ করেছিল রয়টার্স। তবে তারা কোনো উত্তর দেয়নি। অপর দিকে জান্তাবিরোধী সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট জানিয়েছে, আক্রান্ত এলাকায় তাদের যোদ্ধাদের মোতায়েন করবে।

৩৩৪টি পরমাণু বোমার সমান ছিল ভূমিকম্পের শক্তি

যুক্তরাষ্ট্রের ভূতত্ত¡বিদ জেস ফনিক্স সিএনএনকে জানিয়েছেন, ‘মিয়ানমারের ভূমিকম্প যে পরিমাণ শক্তি নির্গত করেছে, তা প্রায় ৩৩৪টি পরমাণু বোমার সমান।’ আগামী আরো অন্তত দুই মাস মিয়ানমার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকবে বলে সতর্কবার্তাও দিয়েছেন এই ভূতত্ত¡বিদ। তিনি বলেছেন, ‘ইন্ডিয়ান টেকটোনিক প্লেট এবং ইউরেশিয়ান টেকটোনিক প্লেটের ওপর মিয়ানমারের অবস্থান। এ দু’টি প্লেটের স্থানান্তরের কারণেই ভূমিকম্প হয়েছে। এই স্থানান্তর আরো দুই মাস পর্যন্ত চলবে।

থাইল্যান্ডে ধসেপড়া ভবনের নিচে প্রাণের চিহ্ন

থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে শক্তিশালী ভূমিকম্পে ধসেপড়া ৩০তলা ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে ১৫ জনের জীবনের চিহ্ন শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের জীবিত উদ্ধারে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা। শনিবার ব্যাংকক দমকল ও উদ্ধার বিভাগের পরিচালক সুরিয়ান রাভিয়ান জানান, এই দুর্ঘটনায় অন্তত আটজন নিহত হয়েছেন এবং ৪৭ জন নিখোঁজ রয়েছেন। ব্যাংকক পোস্ট জানায়, নিখোঁজদের পরিচয় এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। সুরিয়ান জানান, ৩০তলা নির্মাণাধীন ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে ১৫ জনের অস্তিত্ব শনাক্ত করা হয়েছে। উদ্ধারকারী দল ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে তাদের কাছে পৌঁছার চেষ্টা চালাচ্ছে।

আরো বলেন, উদ্ধারের জন্য ৭২ ঘণ্টা সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। কারণ দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে ও পানিশূন্যতার কারণে ভুক্তভোগীরা শকে চলে যেতে পারেন। তবে আমরা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই উদ্ধার অভিযান শেষ করার চেষ্টা করছি।

এখন পর্যন্ত আটকেপড়া লোকদের কাছে পানি বা খাদ্য পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। কারণ তারা ধ্বংসস্তূপের প্রায় তিন মিটার গভীরে রয়েছেন। এ দিকে ব্যাংককের গভর্নর চাদচাট সিত্তিপুন্ত ভূমিকম্পের পরের দিন সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তিনি জানান, উদ্ধারকাজ সহজ করতে ক্রেন ট্রাক ব্যবহার করে ধ্বংসস্তূপের কংক্রিটের অংশগুলো সরানো হচ্ছে। এ ছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যাংকক মহানগর প্রশাসন ১৩০ জন স্বেচ্ছাসেবী প্রকৌশলী মোতায়েন করেছে।

গত ২৮ মার্চ মিয়ানমারে সৃষ্ট শক্তিশালী ভূমিকম্পের প্রভাবে ব্যাংককে তীব্র কম্পন অনুভূত হয়। এর ফলে বহু মানুষ আতঙ্কে খোলা স্থানে আশ্রয় নেন। ২৮ মার্চ রাতে তিন শতাধিক মানুষ ব্যাংককের পার্কগুলোতে রাত কাটিয়েছেন। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এসব পার্ক আরো এক রাত খোলা রাখা হবে জানিয়েছেন গভর্নর।

মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে পরপর দু’টি শক্তিশালী ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও হাজারের বেশি প্রাণহানির ঘটনায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছে বাংলাদেশেও। কেননা বাংলাদেশও ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশেও মিয়ানমারের মতো একই মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষত ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চল উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায় ভূমিকম্প মোকাবেলার জন্য সর্ব পর্যায়ে পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ ও সচেতনতা সৃষ্টির আহ্বান জানানো হয়েছে। গত ২৯ মার্চ গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ আহ্বান জানানো হয়। ফায়ার সার্ভিস বলছে, ভূমিকম্প মোকাবেলায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০ অনুযায়ী ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ করতে হবে, ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরনো ভবনগুলোর সংস্কার ও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বহুতল ও বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নি প্রতিরোধব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। ইউটিলিটি সার্ভিসগুলো যথা- গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের লাইনের সঠিকতা নিশ্চিত করতে হবে। ভূমিকম্পের সময় ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি পর্যায়ে বিভিন্ন করণীয় সম্পর্কে নিয়মিত মহড়া অনুশীলন ও প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। জরুরি টেলিফোন নম্বর যেমন- ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ, হাসপাতাল ও অন্যান্য জরুরি নম্বরগুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ের পাশাপাশি সব ভবন বা স্থাপনায় সংরক্ষণ করা এবং তা দৃশ্যমান স্থানে লিখে রাখতে হবে। ভলান্টিয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দুর্যোগকালীন সময়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। জরুরি প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য সরঞ্জামাদি যেমন- টর্চলাইট, রেডিও (অতিরিক্ত ব্যাটারিসহ), বাঁশি, হ্যামার, হেলমেট/কুশন, শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, প্রয়োজনীয় ওষুধসামগ্রী, ফাস্ট এইড বক্স, শিশু যতেœর সামগ্রী ইত্যাদি বাসাবাড়িতে নির্ধারিত স্থানে সংরক্ষণ করা যাতে ভূমিকম্প-পরবর্তীতে আটকা পড়লে তা ব্যবহার করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা যায়। সব পর্যায়ে তদারকি সংস্থার কার্যক্রমে সহযোগিতা করা।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া শাখার কর্মকর্তা মো: শাহজাহান সিকদার বলেন, এসব বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভিন্ন কার্যক্রম চালু রেখেছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সতর্কতায় ভূমিকম্পের মতো ভয়াবহ দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমানো সম্ভব।

মিয়ানমারে আঘাত হানা ভূমিকম্পটি দেশটির মধ্যাঞ্চলীয় শহর সাগাইংয়ে ভূপৃষ্ঠের ১৬ কিলোমিটার গভীরে ছিল এপিসেন্টার বা উৎপত্তিস্থল। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতত্ত¡ জরিপ ও গবেষণা সংস্থা ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, মিয়ানমারে ৭.৭ এবং ৬.৪ মাত্রার দু’টি ভূমিকম্প আঘাত হানে। মারাত্মক এই ভূকম্পনের রেশ মিয়ানমারের দুই প্রতিবেশী থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশেও পৌঁছেছিল।