আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব যেভাবে টেকসই হতে পারে

নেপালসহ বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশের বাস্তবতা বিবেচনায়, আমরা যে ৬০ : ৪০ মডেলটি প্রস্তাব করছি তা একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও কার্যকর পথ হতে পারে। এটি রাজনৈতিক বিভাজন কমাবে, ভোটের মূল্যায়ন নিশ্চিত করবে এবং সরকারে প্রতিনিধিত্ব বৈচিত্র্য বাড়াবে। এই প্রস্তাব সব পক্ষের জন্য গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিসঙ্গত একটি বাস্তবসম্মত জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।

বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক চলছে। বর্তমানে নির্বাচন হয় First-Past-The-Post (FPTP) পদ্ধতিতে, যেখানে একজন প্রার্থী সর্বাধিক ভোট পেলেই নির্বাচিত হন, এমনকি যদি তিনি মাত্র ৩০-৪০ শতাংশ ভোটও পান বা তার চেয়ে কম পেলেও। এতে একটি দল মোট ভোটের ৪০ শতাংশ পেয়ে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে যেতে পারে, অন্যদিকে বিপুল ভোট পেয়েও অনেক দল একটি আসনও না পেতে পারে।

এই ব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্বের ভারসাম্য থাকে না। তাই Proportional Representation (PR) পদ্ধতি অনেকেই অধিক অংশগ্রহণমূলক ও ন্যায্য হিসেবে বিবেচনা করেন। আবার কেউ এটিকে অস্থিতিশীল জোট রাজনীতির আশঙ্কা হিসেবে দেখেন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পিআর-ভিত্তিক নির্বাচনকে ‘ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা’ বলে অভিহিত করেছেন। তারা পিআর-ভিত্তিক নির্বাচনপদ্ধতির পক্ষে নয়।

বাস্তবতা হলো- সাধারণ মানুষের মধ্যে এই দু’টি ব্যবস্থার মধ্যে প্রকৃত পার্থক্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই। অনেকেই দলীয় আনুগত্য বা অন্ধ সমর্থনের ভিত্তিতে এ বিষয়ে মত প্রকাশ করেন, প্রকৃত বিশ্লেষণ নয়।

এই প্রবন্ধে আমরা উভয় পক্ষের যুক্তি বিচার করে বাংলাদেশের বাস্তবতায় একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তবসম্মত প্রস্তাব (৬০ : ৪০ মডেল) তুলে ধরছি। আমরা আশা করি, এটি জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছাতে সহায়ক হবে।

পিআর কী এবং বিশ্ব প্রেক্ষাপট

পিআর একটি ভোটিং পদ্ধতি, যেখানে একটি দলের মোট ভোটের অনুপাতে সংসদীয় আসন বরাদ্দ করা হয়। এতে প্রতিটি ভোটের মূল্যায়ন হয় এবং ছোট দলগুলোও প্রতিনিধিত্ব পেতে পারে। যেখানে কোনো রাজনৈতিক দল জাতীয়ভাবে যত শতাংশ ভোট পায়, তারা সেই অনুপাতে সংসদে আসন পায়। এতে করে মানুষের ভোটের প্রকৃত প্রতিফলন সংসদে দেখা যায়।

উদাহরণ : ১০০টি আসনের একটি কল্পিত সংসদ

Mohiuddin

বিশ্বে ৮০টিরও বেশি দেশে কোনো না কোনো ধরনের পিআর পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে একেক দেশে একেক ধরনের পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় :

দেশ ব্যবহৃত পদ্ধতি মন্তব্য

জার্মানি MMP (Mixed-Member Proportional) ৫০ শতাংশ সরাসরি, ৫০ শতাংশ পিআর, নিউজিল্যান্ড MMP একটি প্রার্থী ও একটি দলকে ভোট দেয়া হয়। নরওয়ে, সুইডেন Closed List PR দল মনোনীত করে সংসদ সদস্য, নেদারল্যান্ডস Full PR পুরো দেশ একক ভোটক্ষেত্র, ইসরাইল Full PR শুধু দলকে ভোট, প্রার্থীকে নয়। নেপাল MMP প্রায় অর্ধেক আসনে পিআর, দলীয় ভোটের ভিত্তিতে প্রতিনিধি বাছাই। বিশেষভাবে নেপালের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। নেপালে ২৭৫টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৬৫টি হয় সরাসরি (FPTP), বাকি ১১০টি বরাদ্দ হয় পিআর পদ্ধতিতে। ভোটাররা একটি প্রার্থী এবং একটি দলকে ভোট দেয়। পিআর তালিকা নির্বাচনে দলগুলোকে সংখ্যালঘু, নারী ও অনগ্রসর শ্রেণীকে অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। এতে করে অধিক অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়।

বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত ৬০ : ৪০ মডেল

আমরা একটি মিশ্র নির্বাচনপদ্ধতির প্রস্তাব করছি, যেখানে ৬০ শতাংশ আসন নির্বাচিত হবে সরাসরি এবং ৪০ শতাংশ আসন বরাদ্দ হবে পিআর পদ্ধতিতে। এই ব্যবস্থায় ভোটের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটবে। জনপ্রিয় অথচ অল্প ব্যবধানে পরাজিত প্রার্থীও সংসদে সুযোগ পাবে। দলীয় প্রধানের একচ্ছত্র মনোনয়ন ক্ষমতা হ্রাস পাবে। সরকার ছোট দলের জোট চাপে অকার্যকর হয়ে পড়বে না।

৬০ : ৪০ মডেল বাস্তবায়নের ধাপ

১. সংবিধান ও নির্বাচন আইনে সংশোধন করে মিশ্র পদ্ধতির অনুমোদন

২. ১৮০টি আসনে FPTP ও ১২০টি আসনে পিআর নির্বাচন নির্ধারণ

৩. পিআর আসনে মনোনয়নের জন্য দলীয়ভাবে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া অথচ পরাজিত প্রার্থীদের তালিকা তৈরি।

৪. নির্বাচন কমিশন ডিজিটাল পদ্ধতিতে পিআর তালিকা যাচাই ও বণ্টন নিশ্চিত করবে

৫. প্রয়োজনে Run-off (দ্বিতীয় দফা ভোট) বাধ্যতামূলক করা হবে যদি কেউ ৫০ শতাংশ ভোট না পান।

উপকারিতা

১. ভোটের প্রকৃত প্রতিফলন নিশ্চিত হয়

২. দলীয় একচ্ছত্রতা হ্রাস পায়

৩. অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র বিকশিত হয়

৪. জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও পরাজিত প্রার্থীর জন্য সংসদে সুযোগ থাকে

৫. জাতীয় ঐক্য ও স্থিতিশীলতা বাড়ে

নেপালের অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের বাস্তবতা

নেপালে পিআর ব্যবস্থার কিছু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে দলভিত্তিক জোটগঠনের জটিলতা ও দল ভাঙনের কারণে। তবে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত ৬০ : ৪০ মডেলে সে আশঙ্কা হ্রাস পাবে। কারণ এখানে ৬০ শতাংশ আসন সরাসরি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের জন্য নির্ধারিত থাকবে, যা সরকারগঠনে একটি স্থিতিশীল ভিত্তি দেবে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ দলত্যাগ বা দলবদলের পথ রুদ্ধ করে দেয়। ফলে পিআর অংশের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দলীয় শৃঙ্খলার বাইরে গিয়ে সরকারের পতনের কারণ হতে পারবেন না। এ কারণে নেপালের তুলনায় বাংলাদেশের মডেলটি অনেক বেশি ভারসাম্যপূর্ণ, স্থিতিশীল ও বাস্তবমুখী হবে।

উপসংহার : নেপালসহ বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশের বাস্তবতা বিবেচনায়, আমরা যে ৬০ : ৪০ মডেলটি প্রস্তাব করছি তা একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও কার্যকর পথ হতে পারে। এটি রাজনৈতিক বিভাজন কমাবে, ভোটের মূল্যায়ন নিশ্চিত করবে এবং সরকারে প্রতিনিধিত্ব বৈচিত্র্য বাড়াবে। এই প্রস্তাব সব পক্ষের জন্য গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিসঙ্গত একটি বাস্তবসম্মত জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।

লেখক : কানাডা প্রবাসী মানবাধিকারকর্মী রাজনীতি বিশ্লেষক