মোহাম্মদ সাদউদ্দিন
ভারতে সম্প্রতি বিজেপি সরকারের ওয়াকফ সংশোধনী আইনে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট আইনের আংশিক বদলের নির্দেশ দিলেও ভারতের মুসলিমরা তাতে সন্তুষ্ট নন। অন্য সম্প্রদায়ের খবরদারি প্রতিটি জেলা শাসকদের গঠিত কমিটির খর্ব করার দাবি আজও বিবেচিত হয়নি। ওয়াকফ বাঁচাতে যে ওয়াকফ বোর্ড তৈরি হয়েছিল এর মধ্যে অন্য কোনো অমুসলিম থাকবেন না। তারা যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেবেন।
বিজেপির সরকার আইন নিজের মতো ব্যবহার করে আদানি-আম্বানিদের স্বার্থ দেখতে চায়। বিজেপি-আরএসএস তার মুনাফা লুটতে চায়। এর ফলে মুসলিমদের ওয়াকফ আন্দোলনের পারদ এখন ঊর্ধ্বমুখী। এক দিকে ক্ষমতাধর দল রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ওয়াকফ সম্পত্তি গগনচুম্বী অট্টালিকা বানিয়েছে, তেমনি দলের ভবন পর্যন্ত তৈরি করেছে। আম্বানির মতো শিল্পপতির মুম্বাইয়ের গগনচুম্বী অট্টালিকা ওয়াকফ সম্পত্তিতে বলে মুসলিম সংগঠনগুলোর দাবি। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো ওয়াকফ সংশোধনী আইন মুসলিমদের মন ভেঙে দিয়েছে। তাই তারা এর শেষ দেখতে চান।
একটু পেছন ফিরে তাকানো যাক। ২০০৬ সালের ২৫ নভেম্বর বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচারের নেতৃত্বে গঠিত সাচার কমিটির রিপোর্ট সারা ভারতসহ পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের আর্থসামাজিক চালচিত্র কত করুণ তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এমনকি এ কথাও বলা হয়েছে, ভারতে মুসলিমদের অবস্থা এত করুণ যে, তা হিন্দু সমাজের তফসিলি জাতি, উপজাতি ও আদিবাসীদের থেকেও খারাপ।
পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা আরো ভয়াবহ। প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলিম বসবাসকারী রাজ্যে বাম জমানাতে চাকরির হার ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এখন তা কমে ২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সাচার কমিটির প্রতিবেদনের পাশাপাশি এমপাওয়ার ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন ২০১৮-১৯ সালে এবং ২০১৪-১৫ সালে অ্যাসোসিয়েশন স্নাপস নামে আরো একটি সংস্থা সমীক্ষা চালালে সেখানে আরো করুণ পরিস্থিতি ধরা পড়ে পশ্চিমবঙ্গে।
সাচার কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ভারতের মুসলিমদের আর্থসামাজিক করুণ চিত্র উত্তরণের উপায়, ওয়াকফ সম্পত্তিগুলো কাজে লাগানো। অর্থাৎ জবরদখল ও বেদখল হওয়া ওয়াকফ সম্পত্তি উদ্ধার করে কাজে লাগাতে হবে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, পশ্চিমবঙ্গে তা হয়নি, বরং পশ্চিমবঙ্গে যে যখন ক্ষমতায় এসেছে তারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ওয়াকফ সম্পত্তি দখল করেছে। এটা পশ্চিমবঙ্গের একটি বাস্তবতা। ভারতের মধ্যে উত্তরপ্রদেশের পর সবচেয়ে বেশি ওয়াকফ সম্পত্তি পশ্চিমবঙ্গে। বাংলার মাটিতে দীর্ঘ দিন ধরে সুলতানি শাসন, তুর্কি শাসন, মোগল শাসন ও নবাবী শাসনে বঙ্গদেশে বিশেষ করে খণ্ডিত পশ্চিমবঙ্গে ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণ অনেক বেশি। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত মিলে পশ্চিমবঙ্গে ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণ লক্ষাধিক বলে দাবি করা হয়। এটি অনুমান। কিন্তু এর সঠিক হিসাব কি পশ্চিমবঙ্গ ওয়াকফ বোর্ডে রয়েছে? এটা কিন্তু মস্ত বড় প্রশ্ন। চলতি বছরে ভারতের সংসদে ওয়াকফ সংশোধনী আইন সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিজেপি সরকার পাস করিয়ে নিলে মুসলিমদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ও উদ্বেগ তৈরি হয়। বিভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ দল বা ইন্ডিয়া জোট এ আইনের বিরোধিতা করেছে। তারা আইনের শরণাপন্ন হয়ে আদালতে মামলাও করে। বিভিন্ন মুসলিম বা মানবাধিকার সংগঠন আন্দোলন করছে। আবার আদালতে মামলাও করেছে। ভারতজুড়ে ওয়াকফ সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে মুসলিম সংগঠনগুলো রাস্তায়। আন্দোলন সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে। বিশেষত কর্নাটক, তামিলনাড়–, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশসহ দক্ষিণ ভারতে এ আন্দোলন বৃহৎপর্যায়ে নিয়ে গেছে সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব ইন্ডিয়া (এসডিপিআই)। এ দল একক শক্তিতে আন্দোলন তৃণমূলে নিয়ে গেছে, যা লোকসভায় এক বিজেপি সংসদ সদস্য তার ভাষণে বলেছেন।
চলতি বছরের ১১ এপ্রিল মুর্শিদাবাদের সামসেরগঞ্জ (ধুলিয়ান) ও সুতিতে (অরঙ্গাবাদ) মুসলিম সংগঠনগুলো ঐকবদ্ধভাবে রাস্তায় নামলে পুলিশ-বিএসএফ বাধা দিতে গেলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হয়। ফলে উভয় সম্প্রদায়ের কিছু দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারের মানুষ খুন হন। ওই ঘটনার মাসখানেক পরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূলের সভানেত্রী মমতা ব্যানার্জি সামসেরগঞ্জে গিয়ে বলেন, পশ্চিমবঙ্গে কেউ ওয়াকফ আন্দোলন করবেন না। আন্দোলন যদি করতে হয়, তাহলে দিল্লিতে গিয়ে করুন। এখানে আন্দোলন করলে আমি হব বড় শত্রু।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির এ কথায় মুসলিমরা যারপরনাই মর্মাহত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, মমতা ব্যানার্জির আসল স্বরূপ ধরে ফেললেন; কিন্তু মুসলিম সংগঠনগুলো থেমে থাকেনি। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে উঠে আসা তরুণ-তুর্কি আইএসএফ সুপ্রিমো বিধায়ক নৌশাদ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ২০টি সংগঠনের যৌথমঞ্চ কনস্টিটিউশন প্রটেকশন ফোরাম। এসডিপিআই, সারা বাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশন, ওয়েলফেয়ার পার্টি অব ইন্ডিয়া, আজাদ পার্টি, জামায়াতে ইসলামী হিন্দ, আইমিম, স্টুডেন্ট ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়াসহ ২০টি মুসলিম সংগঠন এ ফোরামে রয়েছে। এ ফোরাম কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলার ডরিনা ক্রসিংয়ে অবস্থান বিক্ষোভ করতে গেলে কলকাতা পুলিশ বাধা দেয়। তবে কনস্টিটিউশন প্রটেকশন ফোরামের নেতাকর্মীরা পাল্টা প্রতিরোধের চেষ্টা করে। পুলিশ গত ২০ আগস্ট ৯৬ জনকে গ্রেফতার করলেও তারা জামিনে মুক্ত হন। আবার ধরনা-অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। এখন পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাসহ আনাচেকানাচে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। একটাই বক্তব্য, মমতা ব্যানার্জি হিন্দুত্ববাদের পাল্টা আরেকটা হিন্দুত্ববাদী। তাই রামমন্দিরের বিকল্প হিসেবে তিনি দীঘায় তৈরি করেন জগন্নাথ মন্দির। আর দুর্গাঙ্গন করতে মাতোয়ারা। কয়েক হাজার ক্লাবকে পুজো অনুদান মাথাপিছু এক লাখ ১০ হাজার টাকা দেন। তিনি মুসলিমদের ওয়াকফ আন্দোলনে বাধা দিচ্ছেন। পুলিশ দিয়ে দমন-পীড়ন করে আন্দোলন ভেঙে দিতে চাইছেন। আমরা তার স্বরূপ বুঝে নিয়েছি।
কেন্দ্রে বিজেপি সরকার যে ওয়াকফ সংশোধনী আইন এনেছে, এর নতুন নাম ‘ইউনাইটেড ওয়াকফ ম্যানেজমেন্ট, এমপাওয়ারম্যান্ট, ইফিসিয়েন্সি অ্যান্ড ডেভেলপম্যান্ট অ্যাক্ট’ এ আইন যথেষ্ট নয়। একটি পৃথক বোর্ড করা হবে বোহরা ও আফগানি মুসলিমদের জন্য। অর্থাৎ মুসলিমদের মধ্যে বিভাজনরেখা টানা হলো। এ আইনের সুযোগ নিয়ে বিজেপির করপোরেট-প্রভু আদানি-আম্বানিরা প্রোমোটারি সাম্রাজ্য গড়ে তুলবেন... এ আতঙ্ক আর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে মুসলিমদের মধ্যে।
আম্বানির মুম্বাইয়ের বাড়িটাও ওয়াকফ সম্পত্তি, তাও মুসলিমরা জেনে গেছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের মধ্যে আন্দোলন দানা বেঁধেছে। এমনিতে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ক্ষমতাধর দলগুলো ওয়াকফ সম্পত্তি গ্রাস করেছে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূলের অনেকে তা দখল করে রেখেছে। ওয়াকফ আন্দোলন কেন বাধা দিচ্ছেন মমতা ব্যানার্জি? এটি সবাই বোঝেন। তাই পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরা এ জন্য রাস্তাকেই বেছে নিয়েছেন। আন্দোলন দিশা দেবে বলে মনে করছেন।
আমরা অনেকে জানি না, কলকাতার ধর্মতলা, ফোর্ট উইলিয়াম, রেড রোড, গড়ের মাঠ, মহামেডান-ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, বাবুঘাট, আকাশবাণীভবন, বিধানসভা ভবন, কলকাতা হাইকোর্ট, রাজভবন বা গভর্নর হাউজ, ইডেন গার্ডেন্স সব ওয়াকফ সম্পত্তি। তখন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দী খাঁ। রাজধানী মুর্শিদাবাদ। কলকাতার এ এলাকার দুই হাজার ৫৫৫ বিঘা জমি দান করে যান নবাব আলীবর্দী খাঁ। তার আমলে এই ২৫৫৫ বিঘা জমি ওয়াকফ করে দেন। তখন মোতায়াল্লি ছিলেন মৌলানা আমসুদ্দিন ও মৌলানা মসীহউদ্দিন। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত মাত্র ১৯৯ টাকা ভাড়া দিত সরকার। মোতায়াল্লি মৌলানা আবুল বরকত ৯৯ বছর বয়েসে মারা গেলে তার উত্তরাধিকারীদের এক পয়সাও দেয় না সরকার।
স্মরণ করা যেতে পারে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বাড়ি ঢিল ছোড়া দূরত্বে অবস্থিত কালীঘাটের মন্দিরের জায়গা দান করেন মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর।
দানবীর হাজী মুহম্মদ মুহসীনের বিশাল সম্পত্তি আজ বেদখল। মুর্শিদাবাদের নবাবদের ওয়াকফ সম্পত্তি আজ বেদখল। মুর্শিদাবাদের সদর বহরমপুর শহরের কারবালা ময়দানের ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়েও দখলদারির অভিযোগ উঠেছে। বর্ধমানের নবাবদেরও ঠিক তাই। কলকাতার টালিগঞ্জের টিপু সুলতান, অথবা মেটিয়াবুরুজের নবাব ওয়াজেদ আলী শাহদের ওয়াকফ সম্পত্তি আজ বেদখল ও জবরদখল হয়ে গেছে।
সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুসারে, সমগ্র ভারতে ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণ ছয় লাখ একর। ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা ও রেল মন্ত্রণালয়ের পরে বেশি জমি রয়েছে ওয়াকফ বোর্ডের অধীনে। ওই ওয়াকফ সম্পত্তি থেকে বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা আয় হতে পারে যা দিয়ে মুসলিম সমাজের নানা উন্নয়মূলক কাজ হতে পারত; কিন্তু সে ধরনের কোনো উদ্যোগ ভারত সরকার বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নেই। এভাবে ওয়াকফ সম্পত্তি রাজনৈতিক হাঙর ও প্রোমোটারদের গ্রাসে চলে যাচ্ছে। এটাই বাস্তবতা। মুসলিমরা তাই তাদের আন্দোলনের পারদ ঊর্ধ্বমুখী করতে চাইছেন।
লেখক : কলকাতার কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও কবি