ভিন দেশে এমন আচরণ প্রত্যাশিত নয়

সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, আরো এক উপদেষ্টা এবং বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা যুক্তরাষ্ট্র সফরকালীন সে দেশের বিমানবন্দরে বিব্রতকর ও অবমাননাকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। বিদেশের মাটিতে এ ধরনের কর্মসূচি যেন না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।

বাঙালিদের স্থায়ী আবাসস্থল বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিম বাংলা হলেও বাংলাদেশে বসবাসরত বাঙালিদের জাতীয়তা বাংলাদেশী। অন্য দিকে ভারতের পশ্চিম বাংলায় বসবাসরত বাঙালিদের জাতীয়তা ভারতীয়। বর্তমানে পৃথিবীর সর্বত্র জাতীয়তা ভূখণ্ড-ভিত্তিক হয়। ভারত বহুজাতি সমন্বয়ে গঠিত একটি দেশ হলেও সামগ্রিক অর্থে সবার জাতীয়তা ভারতীয়। পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, চীন প্রভৃতি দেশের ক্ষেত্রেও এটি সমভাবে প্রযোজ্য।

বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশীদের বসবাস রয়েছে। এদের কেউ স্থায়ী নাগরিক হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে বসবাস করে আবার কেউ কাজ বা পেশার তাগিদে অস্থায়ীভাবে বিদেশে বসবাস করে। ইউরোপের যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, সুইডেন, নরওয়ে, উত্তর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা, মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমান, বাহরাইন, জর্দান, দক্ষিণ এশিয়ার সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশীর বসবাস রয়েছে।

যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত একটি অংশের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ প্রজন্ম সেখানে বসবাস করছে। এ ধরনের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ প্রজন্মের অনেক বাংলাদেশী সে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছেন। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বর্তমানে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ প্রজন্মের একাধিক ব্যক্তি সেখানকার পার্লামেন্টের মেম্বার, বিভিন্ন শহরের মেয়র ও কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হয়ে জাতি হিসেবে বাংলাদেশীদের সুনাম বাড়িয়ে চলেছেন। যুক্তরাজ্যের সরকারের উচ্চ পদেও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতরা তাদের মেধা ও যোগ্যতার স্বীকৃতিতে আসন করে নিতে পেরেছেন। কোনো একসময় খোদ বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ছিলেন। যুক্তরাজ্যের মতো যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়ও বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশীর বসবাস। এ দু’টি দেশেও দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ প্রজন্মের বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের বসবাস রয়েছে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতরা সেখানকার অর্থনীতি ও রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত। তাদের একজন প্রথমোক্ত দেশটির সিনেটর পদে নির্বাচিত হওয়ার গৌরবধারী। অন্য একজন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জভুক্ত দেশ ফিজির রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তা ছাড়া উভয় দেশের জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতরা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় অবতীর্ণ হয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে চলেছেন।

জন্মসূত্রে বাংলাদেশী এমন যারা সে দেশের নাগরিক অথবা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বিদেশে বসবাস করছেন তাদের অনেকে দেশের রাজনীতির সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতীত ও বর্তমানে যে চারটি দলের বড় ধরনের প্রভাব ছিল বা আছে, এ দলগুলো হলো- বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি। এ চারটি দলের তিনটি দল এককভাবে এবং অন্যটি জোটগতভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। পৃথিবীর যেসব দেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশীর বসবাস রয়েছে, এমন সব দেশে এ চারটি দলের শাখা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অঙ্গসংগঠনগুলোর শাখা রয়েছে। এসব শাখা ও অঙ্গসংগঠনের শাখাগুলো বাংলাদেশের দলগুলোর কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদনপ্রাপ্ত। এমনও দেখা যায়, দুয়েকটি দেশে একই দলের একাধিক কমিটি থাকায় নিজেদের মধ্যে কলহ, বিবাদ, সহিংসতায় রূপ নিয়ে দেশের মর্যাদাহানির অবকাশ ঘটায়।

বিগত প্রায় চার দশক ধরে দেখা গেছে, বাংলাদেশের সরকারপ্রধানরা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফরকালীন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে পড়ে বিব্রত ও অবমাননাকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। সচরাচর দেখা যায়, এ ধরনের প্রতিবাদ সমাবেশ সরকারপ্রধানদের আগমন-পরবর্তী বিমানবন্দরে, তারা যে হোটেলে অবস্থান করেন সেই হোটেলের সামনে এবং তারা যেসব স্থানে সমাবেশে মিলিত হন, সেসব স্থানের সম্মুখে সংগঠিত হয়ে থাকে। এ ধরনের প্রতিবাদ সমাবেশে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফরকালীন একাধিক সরকারপ্রধানকে নির্ধারিত যাত্রাপথের পরিবর্তে বিকল্প পথ ধরে বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছাতে দেখা গেছে। কোনো কোনো প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে সরকারপ্রধানকে লক্ষ্য করে কালো পতাকা প্রদর্শন ছাড়াও জুতা ও পচা ডিম নিক্ষেপের ঘটনা প্রত্যক্ষ করা গেছে। এসব সমাবেশস্থলে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা ক্ষমতাসীন সরকারপ্রধানের দুঃশাসন ও অপকর্মের চিত্র ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ডের মাধ্যমে তুলে ধরেন। এমনও দেখা গেছে, বাসের চার পাশে অপশাসন ও দুঃশাসনের বাণী-সংবলিত বার্তার মাধ্যমে অভিনবভাবে প্রতিবাদের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাসটি শহরের বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণকালে শহরবাসীদের একটি বড় অংশের এ বার্তা পাঠের মাধ্যমে দেশে যে অস্বাভাবিক কিছু ঘটে চলেছে তার বাস্তব চিত্রের খণ্ডিতাংশ জানার সুযোগ ঘটেছে। এ ধরনের অভিনব ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিবাদ বাস কর্তৃপক্ষের জন্য আয়ের একটি বাড়তি সুযোগ করে দিয়েছে।

পৃথিবীর যেসব দেশে ক্ষমতাসীনদের দমন-পীড়নে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা নিজ দেশে সংবিধান স্বীকৃত পন্থায় যেকোনো ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচি আয়োজনে পুলিশ ও দলীয় ক্যাডারদের দ্বারা অন্যায়ভাবে বাধাগ্রস্ত হয়ে শারীরিকভাবে প্রহৃত হচ্ছেন অথবা কারান্তরীণে বাধ্য হচ্ছেন, সেসব দেশের নাগরিকদের নিজ নিজ দেশে বৈধ ও গণতান্ত্রিক পন্থায় প্রতিবাদ জানানোর সুযোগ না থাকায় আজ এসব দেশের বিদেশে অবস্থানরত নাগরিকরা যখন তাদের দেশের সরকারপ্রধানরা বিদেশ সফরে যান, তখন এভাবে প্রতিবাদ জানানোর প্রয়াস নিয়ে থাকেন।

পৃথিবীর যেসব দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু রয়েছে এবং একটি সরকারের মেয়াদান্তে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে মসৃণভাবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে- সেসব দেশের নাগরিকরা সরকারের কোনো ধরনের কর্মসূচিতে বিক্ষুব্ধ হলে তার প্রতিবাদ জানানোর ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক কোনোভাবে বাধার সম্মুখীন হন না। এ কারণে এসব দেশের সরকারপ্রধান বিদেশের যেকোনো রাষ্ট্রে সফরে গেলে সেখানে বসবাসরত ওই দেশের নাগরিকরা তাদের সম্মানে সংবর্ধনার আয়োজন করেন। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও ক্ষমতাসীনদের স্বীয় রাজনৈতিক মতাবলম্বীরা বিদেশে অনুরূপ সমাবেশের আয়োজন করলেও তা বিরোধীদের বাধায় অনেকসময় সফলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

যেকোনো দেশের সরকারপ্রধান অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হলে তাকে সরকার পরিচালনায় দেশ ও সমাজের সব শ্রেণিপেশার মানুষ সহযোগিতা করে থাকেন। আর অস্বচ্ছ ও কলুষতাপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে কেউ জোরপূর্বক ক্ষমতাসীন হলে এর ব্যত্যয় ঘটে। এভাবে যারা ক্ষমতায় আসীন হন তারা দেশের অভ্যন্তরে তাদের অপশাসন ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচি বরদাশত করেন না। এ কারণে অনেকটা বাধ্য হয়ে বিদেশের মাটিতে প্রতিবাদের আয়োজন করে। কথাটি অনস্বীকার্য যে, এ ধরনের প্রতিবাদ বিদেশের মাটিতে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে। একই সাথে দেশের জন্য মর্যাদাহানিকর। এ ধরনের প্রতিবাদ জাতি হিসেবে আমাদের ছোট করলেও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেখা যায়, এর কোনো বিকল্প নেই।

সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, আরো এক উপদেষ্টা এবং বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা যুক্তরাষ্ট্র সফরকালীন সে দেশের বিমানবন্দরে বিব্রতকর ও অবমাননাকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। বিদেশের মাটিতে এ ধরনের কর্মসূচি যেন না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এমন সংস্কার করতে হবে যাতে বাইরে কেউ এভাবে অন্য কাউকে বিব্রত করতে উৎসাহী না হয়। যেসব দেশের সরকারপ্রধান এটি নিশ্চিতে সফল তাদের জন্য কখনো বিদেশের মাটিতে বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেনি। সুতরাং বিদেশের মাটিতে আমাদের কোনো সরকারপ্রধানের জন্য যেন কোনো ধরনের অবমাননাকর ও বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্ভব না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হলে তাকে অবশ্যই নিজ দেশে সবাইকে আস্থায় আনার ব্যবস্থা নিতে হবে।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক