কার ইশারায় অশান্ত পার্বত্য অঞ্চল

সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে দেশের মানুষের ঐক্য- জনগণ যদি সচেতন ও সংহত থাকে, বিদেশী প্ররোচনা পরাজিত করে। এতে যেকোনো বাহ্যিক ষড়যন্ত্র ভেঙে পড়বে। মোটকথা বাংলাদেশকে দুর্বল করে অন্য কারো স্বার্থ হাসিল করার অধিকার কারো নেই।

পার্বত্য চট্টগ্রাম দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সবচেয়ে সংবেদনশীল সীমান্ত অঞ্চল। দুর্গম পাহাড়, ঘন জঙ্গল আর ভারত-মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষা অবস্থান এ অঞ্চলকে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। যে এই পাহাড়কে নিয়ন্ত্রণ করবে, সে-ই আসলে বঙ্গোপসাগরের প্রবেশদ্বার ও ভারতের অতি দুর্বল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের করিডোর প্রভাবিত করতে পারবে। কিন্তু স্বাধীনতার সূচনা থেকে এ পাহাড় রয়ে গেছে অস্থির- যেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী স্বপ্ন, বিদেশী প্রভাব আর জাতীয় আত্মত্যাগ বারবার মুখোমুখি হয়েছে।

এই বিশ্বাসঘাতকতা শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। যখন বাঙালিরা জীবন দিয়ে স্বাধীনতার জন্য লড়ছিলেন, তখন পাহাড়ি অভিজাতদের একাংশ পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী হয়েছিল। তারা সুযোগ দেখেছিল বিশৃঙ্খলার মধ্যে- অস্ত্র সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ নেয়া ও নিজেদের আলাদা রাষ্ট্রগঠনের প্রস্তুতি। বাংলাদেশের জন্ম তাদের কাছে একীভূত বিজয় নয়; বরং নিজস্ব ‘জুম্মাল্যান্ড’ নামের স্বপ্ন পূরণের সোপান। সে উচ্চাশা দ্রুত প্রকাশ পায়। ১৯৭৩ সালে দীঘিনালার গাছে গাছে পোস্টার ঝুলে- ‘বাঙালির রক্ত নেবা, পাহাড়িরা হবে স্বাধীন।’ এ স্লোগান তখনকার দুর্বল রাষ্ট্রের জন্য শুধু উসকানি নয়, এক ধরনের যুদ্ধ ঘোষণা। শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার তখন দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও চরমপন্থী উত্থানের চাপে ক্লান্ত। সেই দুর্বল মুহূর্ত ব্যবহার করেছিল মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এবং পরে তার ভাই শান্তি লারমা- স্বাধীনতার পথে না গিয়ে স্বায়ত্তশাসন ও বিচ্ছিন্নতার স্লোগান তুলতে।

আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটও তাদের পক্ষে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালের জয়ে ভারত গর্বিত হলেও নিজস্ব উত্তর-পূর্বাঞ্চল তখনো বিদ্রোহে জ্বলছিল নাগা, মিজো, ত্রিপুরা- সবখানে বিচ্ছিন্নতাবাদ। দিল্লির আশঙ্কা ছিল, যদি ঢাকা একদিন এই বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেয়, তাহলে ভারতের উত্তর-পূর্ব অগ্নিগর্ভ হবে। তাই সহযোগিতার বদলে ভারত বেছে নিলো কূটকৌশল- পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঢাকার বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টির হাতিয়ার করে তুলল। সীমান্তপাড়ে আশ্রয়, পাহাড়ি নেতাদের আশীর্বাদ, আর ‘জুম্মা পরিচয়’ নামে ভিন্নতাবাদের ধারণা চর্চার মাধ্যমে ভারত নিশ্চিত করল, এ অঞ্চল কখনো স্থিতিশীল হবে না। তাদের হিসাব ছিল সহজ। পাহাড় অস্থির থাকলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সবসময় ব্যস্ত থাকবে, ফলে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি নিতে পারবে না দেশ। যখনই ঢাকা ভারতের দাবি ট্রানজিট, পানি, বাণিজ্য প্রতিরোধ করেছে, ঠিক তখনই পাহাড়ে হঠাৎ অশান্তি বেড়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে উঠেছে ভারতের কাছে চাপ প্রয়োগের এক নিরাপদ হাতিয়ার।

পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য ভারতের এ সমর্থন ছিল অক্সিজেন। সত্তরের দশকে তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) গঠন করে, আর তার সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনী সংগঠিত করে। ত্রিপুরা ও মিজোরামে ভারতীয় সীমান্তঘেঁষে ক্যাম্প গড়ে ওঠে। পাকিস্তানি সহযোগীদের থেকে পাওয়া অস্ত্র, পরে ভারতের নীরব সহায়তায় পাওয়া রসদ ব্যবহার করে তারা চালায় অতর্কিত হামলা, হত্যা, আর বাঙালি বসতিগুলোতে ভয়াবহ আক্রমণ।

বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াও ছিল কঠোর ও ব্যয়বহুল। সেনাবাহিনীকে পূর্ণ শক্তিতে নামতে হয়, দুর্গম পাহাড়ে টহল দিতে হয়। এক শত্রুর মুখোমুখি হতে হয় যে কখনো দৃশ্যমান, আবার মুহূর্তে সীমান্ত পেরিয়ে অদৃশ্য। বহু তরুণ অফিসার ও সৈনিক জীবন দিয়েছেন এ লড়াইয়ে। তাদের কাছে সিএইচটি শুধু যুদ্ধক্ষেত্র নয়, আত্মত্যাগের প্রতীক- এক স্থান যেখানে প্রজাতন্ত্রের ঐক্য রক্ত দিয়ে রক্ষা করা হয়েছে। তবু বিদ্রোহীরা পুরোপুরি পরাস্ত না হলেও সফল হয়েছিল- বিভেদ ছড়িয়ে দিতে। বাঙালি বসতিদের হত্যা, সরকারপন্থী পাহাড়ি নেতাদের টার্গেট করে হত্যা, এসবের মাধ্যমে ভয়কে তারা অস্ত্র বানাল। ১৯৭৩ সালের পোস্টার কেবল উসকানি ছিল না, তা রূপ নিলো বাস্তবতায়, হাজারো মানুষের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে। নব্বইয়ের দশক নাগাদ এ দ্ব›দ্ব অচলাবস্থায় পৌঁছায়। বিদ্রোহীরা দেশ ভাঙতে পারেনি, আর বাংলাদেশও তাদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। ভারত তখনো খেলছিল দ্বৈত খেলা- প্রকাশ্যে অস্বীকার, আড়ালে মদদ। পাহাড় তাই রয়ে গেল এক অমীমাংসিত ক্ষত।

জুম্মাল্যান্ডের স্বপ্ন ছিল না স্বতঃস্ফূর্ত। তা জন্ম নিয়েছিল বিশ্বাসঘাতকতা থেকে, ভারতীয় আশ্রয় থেকে, আর বাংলাদেশের দুর্বল মুহূর্তকে কাজে লাগানো থেকে। দীঘিনালার পোস্টারগুলো ছিল না স্রেফ স্লোগান; ছিল রাষ্ট্রভাগের এক ভয়ঙ্কর নকশা। অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে গেছে। আজ বিদ্রোহীদের হাতে আর স্রেফ রাইফেল নেই- আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, এনজিওর ছত্রছায়া, আর বিদেশী মঞ্চে কান্নার সুর। কিন্তু লক্ষ্য একই- বাংলাদেশকে দুর্বল করা, বিভক্ত করা। তাই ইতিহাস স্মরণ জরুরি। ভুলে গেলে আবারো একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম দূরবর্তী প্রান্ত নয়। এটি আমাদের সার্বভৌমত্বের সীমানা। এখানে সৈনিক, বসতি স্থাপনকারী আর বিশ্বস্ত পাহাড়িরা রক্ত দিয়েছেন বাংলাদেশের ঐক্যের জন্য। পাহাড় আমাদের মানচিত্রে যেমন, তেমনি আমাদের হৃদয়ে। ১৯৭৩ সালের শিক্ষা অটল- সার্বভৌমত্ব রক্ষার একমাত্র মূল্য হলো সতর্কতা। সম্প্রতি খাগড়াছড়ি ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য এলাকায় যে অশান্তি দেখা দিয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রে সীমান্তপাড়ের স্বার্থপর শক্তির প্ররোচনার ফল। বাইরের কিছু মহল উসকানিমূলক তহবিল, মিথ্যা প্রচারণা ও স্থানীয় উদ্বেগকে উত্তেজনায় পরিণত করে দেশের ঐক্য ভাঙার চেষ্টা করছে। এর মোকাবেলায় রাষ্ট্রকে দ্রুত, লক্ষ্যভিত্তিক ও আইনিভাবে শক্ত ভাষ্যে কাজ করতে হবে।

প্রথমত, গোয়েন্দা অনুসন্ধান দিয়ে বাহ্যিক হস্তক্ষেপ, অর্থ-চ্যানেল ও নেতৃত্বের চিহ্নিতকরণ জরুরি; প্রমাণভিত্তিক তথ্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে উত্থাপন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, নিরাপত্তা বাহিনীকে পরিকল্পিত, লক্ষ্যভিত্তিক অপারেশন চালাতে হবে- সীমান্ত তল্লøাশি, অস্ত্র-প্রবাহ বন্ধ ও সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করতে; কিন্তু সব কিছু সংবিধান ও মানবাধিকারের সীমার মধ্যে রেখে। তৃতীয়ত, ডিজিটাল ক্ষেত্রে দ্রুত কৌশল নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা শনাক্ত ও প্রতিহত করতে হবে; সরকারি ফুটেজ, সাক্ষ্য ও তথ্য দিয়ে সঙ্কেতিত কুসংবাদ খণ্ডন করা প্রয়োজন। চতুর্থত, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে আন্তরিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে- শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও মৌলিক সেবা নিশ্চিত করে তরুণদের প্ররোচনামুক্ত করা সম্ভব। স্থানীয় কমিউনিটি লিডার ও প্রশাসনের সমন্বয়ে সতর্কতা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হলে উপদ্রব দ্রুত ধরবে। পঞ্চমত, কূটনীতিতে সাহসী পদক্ষেপ নেয়া জরুরি- প্রমাণসহ আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের মতো সংশ্লিষ্ট বাহিনীর নীলশক্তিকে চিহ্নিত করে বাধ্যতা সৃষ্টি করা যেতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- সংবিধানগত সীমা মেনে, প্রমাণভিত্তিক, স্বচ্ছ ও ন্যায়পরায়ণ পদক্ষেপ নেয়া, তখনই কড়া নিরাপত্তা প্রয়োগও বৈধ ও কার্যকর হবে। তবে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হচ্ছে জাতীয় ঐক্য : জনগণ সচেতন ও সংহত থাকলে কোনো বিদেশী ষড়যন্ত্র সফল হবে না।

সব শেষে, শক্তি প্রয়োগের আভাস দিলে সেটি কাজ না করলে রাষ্ট্রকে প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হতে হবে। কারণ সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে নিচু অবস্থান গ্রহণ করা সর্বোচ্চ জবাবদিহির অনুপস্থিতি সৃষ্টি করে। তবে সেই পদক্ষেপগুলো যেন অতি-নির্বাচিত, লক্ষ্যমুখী ও আইনি কাঠামোর মধ্যে থাকে- না হলে তা উল্টো ফল দেখাতে পারে। সরকারি কাজের স্বচ্ছতা, নিহত বা আহতদের পরিবারের প্রতি সহানুভূতি ও বারবার তদন্ত প্রক্রিয়ায় সম্মিলিতভাবে কাজ করলে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক লেজিটিমেসি বজায় থাকবে। পরিবেশগত ও সামাজিক ক্ষতির কথা অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। জ্বলন্ত ভাঙনে, বাড়িঘর ধ্বংস, অথবা নিরীহ নাগরিকদের ওপর অনুর্ধ্বায়ী শক্তি প্রয়োগ করলে সমস্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। অতএব প্রতিটি নিরাপত্তা পদক্ষেপের সাথে পুনর্বাসন, নির্যাতন-মুক্তি প্রক্রিয়া ও আইনি সুরক্ষা জোড়া লাগাতে হবে। বর্তমান সময়ে জনমত, কৌশল ও কাজ- তিনটি সমান্তরালে রাখতে পারলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক উত্তেজনার লোকসান রোধ করা সম্ভব।

সীমান্তপাড়ের যে স্বার্থপর শক্তি এ অশান্তি গড়ে তোলার অপচেষ্টা করছে, তাদের কঠোরভাবে প্রতিহত করতে হবে। আইনি ও নৈতিক দিশা বজায় রেখে প্রয়োজনে সশস্ত্র, নিষ্পাপ ও প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার মতো শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। যাতে দেশের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ থাকে। তবে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে দেশের মানুষের ঐক্য- জনগণ যদি সচেতন ও সংহত থাকে, বিদেশী প্ররোচনা পরাজিত করে। এতে যেকোনো বাহ্যিক ষড়যন্ত্র ভেঙে পড়বে। মোটকথা বাংলাদেশকে দুর্বল করে অন্য কারো স্বার্থ হাসিল করার অধিকার কারো নেই।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক