অভয়, আশ্বাস এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকলে, যেকোনো মুহূর্তে পিপিলিকার মতো পোকা-মাকড়ও গর্ত থেকে বেরিয়ে ডায়নোসরে রূপান্তরিত হতে পারে। সেটি দেখা গেল সম্প্রতি গোপালগঞ্জে। কেউ কেউ এ নিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে, আনন্দে বিভোর হয়েছে। কেউ কিছুটা অনুযোগ-অনুতাপ করছে, কেউ ক্ষিপ্ত হয়ে প্রবল প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
গোপালগঞ্জের ক্রিয়ায় যার যার মতো করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার অধিকার কি সবাই গড়ে, প্রত্যেকে সংরক্ষণ করে। এসব নিয়ে নানা মূল্যায়ন থাকতে পারে। তবে এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছা নিয়ে হয়তো আর কোনো বিতর্ক থাকা উচিত নয়। ঘটনাবলির যোগফল হচ্ছে প্লাস-মাইনাস- ইকুয়েল টু মাইনাস। ভয়ঙ্কর এমন ব্যাপার বিশ্লেষণ করলে এটি ধরে নিতে হবে। পতিতদের পতনের মূল কারিগর আগস্ট বিপ্লবীরা। তাদের প্রথম সুযোগে শেষ করতে হবে এটি ছিল গোপালগঞ্জের টার্গেট। তারপর একে একে এমন কর্মকাণ্ড, ধারাবাহিকতা বজায় রাখার অপচেষ্টা থাকবে সেই তাণ্ডবের।
কয়েক দিন আগে সচিবালয়ে এবং মাইলস্টোন স্কুলের দুর্ঘটনা নিয়ে যা ঘটানো হলো, সেটি ধারাবাহিকতা। এ থেকে সুরক্ষা পাওয়ার পথ শুধু একটি, দ্বিতীয় আর কোনো বিকল্প নেই। যা দৈনিক ‘আমার দেশ’-এর সম্পাদক বলেছেন। ‘এটি সবার জন্য ওয়েক-আপ কল’ অর্থাৎ, জেগে ওঠার আহ্বান, এদের রুখতে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। এ আহ্বানে যদি কোনো সাড়া না পড়ে তবে এই বাগধারা নিয়ে ভাবতে হবে, ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়ে’ও কোনো কাজ হবে না। এর শেষ পরিণতি কী হবে কেউ জানেন না।
আমাদের সাম্প্রতিক অর্জন ও এর বিসর্জনের এক মোহনায় এসে দেশ এখন দণ্ডায়মান। জাতি কি এখন শুধু সেই কৃতদাসের মতো অট্টহাসি হাসবে? এটি মহামূল্যবান প্রশ্ন, এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছার এক অনিবার্য সময় যা সবার দ্বারে কড়া নাড়ছে। এমন তত্ত্বকথা না হয় আপাতত একপাশে সরিয়ে রাখা যাক।
এখন অন্য কথা বলা যাক, এটি পরিষ্কার- জাতি এখন সৃষ্ট এক ভয়ঙ্কর নিরাপত্তাহীনতার ভেতর দিয়ে সময় অতিক্রম করছে। গোপালগঞ্জ তার এক জলজ্যান্ত প্রমাণ। চব্বিশের আগস্ট বিপ্লবের নেতাদের কথা না হয় থাক। যেকোনো একটি রাজনৈতিক সংগঠনে সভা-সমাবেশ করা সেটি তার মৌলিক অধিকার। যা সভ্য জগতের এক অনন্য শৈলী ও শিষ্টাচার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কি এ গ্রহের বাইরের কোনো স্থান, যেখানে আইন-কানুনের কোনো বালাই থাকবে না? তা যদি না হয়ে থাকে, তবে গোপালগঞ্জের ঘটনা ঘটল কার মদদে, সেই অনুসন্ধান কোথায়? এ নিয়ে ভাবা দরকার। সেই সাথে দোষী ও তাদের মদদদাতাদের তন্ন তন্ন করে খোঁজা প্রয়োজন। তাদের খুঁজে বের করে যথাযথ শাস্তির বিধান করা অতীব জরুরি বৈকি।
ধারণা করা হচ্ছে, নতুন দল এনসিপি এখন শুধু পতিত লীগ নয়, অনেক ব্যক্তি ও দলের কাছে যেন ‘চোখের বালি’। তাহলে রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো কোনো অংশে ও ব্যক্তির কাছে এনসিপি কি ‘চোখের বালি’ হয়ে উঠছে, এদের সংযোগস্থল কোথায়। মনে রাখা আবশ্যক, কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের সর্বত্র সৈন্যরা যুদ্ধ করেন কেবল যুদ্ধের সময়। অন্য দিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ যারা যুদ্ধ করে দিবা-নিশি প্রতিটি মুহূর্তে, তাদের বলা হয় ইন্টেলিজেন্স। গোপালগঞ্জে তারা কি ঘুমিয়ে ছিল! নাকি ঘুমের ভান করে জেগেছিল? পতিত যুগে এসব সংস্থার তৎপরতা ছিল মাত্রাতিরিক্ত ও ভয়ঙ্কর। সে কারণে আমজনতা তাদের প্রতি এখনো আস্থাশীল হয়ে উঠতে পারেনি। এসব প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে দিতে হবে। বাতাসে অনেক কথাই ভাসে বেড়াচ্ছে। আপাতত সেসব কথায় কান না দিয়ে মূক ও বধির হয়ে থাকাই বিধেয়।
এখন গোপালগঞ্জের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আবারো কিছু কথা স্মরণ করতে চাই। সবার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাত্রাটা নির্ণয় করা বোধহয় এ মুহূর্তে জরুরি ও প্রধান কাজ। বহু মূল্যে কেনা স্বাধীনতা আগলে রাখা এবং তাকে শক্তভিতে স্থাপন করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যাবশক। গণচিন্তা-চেতনাকে অনুভব-উপলব্ধি করা এবং এসব প্রশ্নে আপসহীন অবস্থানে থাকা এ মুহূর্তে অতি দরকারি কাজ। গোপালগঞ্জের ঘটনাবলি নিয়ে হয়তো এমন ধারণা জন্মেছে, পতিতদের পুনঃপ্রবেশের ছোট পরিসরে হলেও এটি ভয়ঙ্কর এক অনুশীলন। যারা রক্ত দিয়ে পতিতদের পতন ঘটিয়েছেন, গোপালগঞ্জে আবারো তাদের রক্ত ঝরল। এ কত আফসোসের ব্যাপার। এসব অঘটন ঘটন পটিয়সীদের গোড়াতে উপড়ে ফেলতে সবাইকে এখন একসাথে থাকতে হবে। আর যাদের এ প্রশ্নে ভূমিকাটা গতানুগতিক, তারা শুধু বলার জন্য বলেন, যেন ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’। তাদের কাছে নতুন এক বোঝাপড়ার ভিন্ন বার্তা থাকলেও থাকতে পারে। তাদের মধ্যে বহু ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট দ্বিচারিতার নানা লক্ষণ বারবার ফুটে উঠছে। আখেরে এমন দ্বৈত ভূমিকা কারো জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।
এক যুগ আগে এক প্রাজ্ঞজন গোপালঞ্জের অনেককে ‘গোপালি’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। সম্ভবত তাদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে তিনি জাতিকে আগাম বার্তা দিয়েছিলেন। সে কথা কেউ হয়তো ভুলে যেতে পারেন। ভুলে যাওয়া কখনো ইতিবাচক নয়, সেটি প্রমাণ হচ্ছে।
প্রখ্যাত গীতিকার আবু জাফরের অসাধারণ কিছু গান আছে, তার একটি- ‘তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদির নাম’। এখানে একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, তোমরা কি সবাই ভুলেই যাচ্ছ চব্বিশের জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান’-এর গান। পরিস্থিতি অনেকটাই যেন সেই রকম। ভুলে যাওয়ার ফল নিয়ে কেউ কি যোগ-বিয়োগ করে দেখেছেন, এর পরিণতি কী হতে পারে। এখন দেশের মানুষ নির্মল আকাশ, মুক্ত বায়ু এবং অনুকূল পরিবেশে যে প্রশান্তি অনুভব করছে; এই ‘মুক্ত স্বদেশ ভূমিতে’, এমন একটি সময় তৈরির পেছনে কার কতটুকু অবদান; সে হিসাব সবার জানা। এ নিয়ে কোনো তর্ক ও বিচ্যুতি শোভনীয় নয়। এমন কিছু নিয়ে যদি সারাক্ষণ বেশি ব্যস্ত থাকা হয়; তখন নিজেদের রাজনীতির পরিচর্যা করার অবকাশ কোথায় এবং কিভাবে আসবে। বেবল ইতিবাচক রাজনীতি সব নেতির অবসান ঘটাতে পারে। এখন দলে দলে যে ঠোকাঠুকি তার শেষ পরিণতি হচ্ছে, শুধু দল বা ব্যক্তি নয় গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ‘শাটডাউন’ করার শামিল। ইতোমধ্যে সবার পছন্দের সীমা একেবারে সঙ্কুচিত হয়ে গেছে, সময়ও খুব সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়েছে।
মনে রাখা ভালো, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে কেউ কোনো দলীয় ঝাণ্ডা নিয়ে রাস্তায় আসেননি। সেখানে কে কোন দলের ওই প্রশ্ন ওঠেনি, রাস্তায় ছিল সাধারণ মানুষ; শিশু-কিশোর-কিশোরী, বালক-বালিকা, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবাই। তাদের কোনো দলীয় দাবি-দাওয়া ছিল না। দাবি ছিল শুধু একটি ফ্যাসিস্টের পতন। কারো মুখ দেখে বা বাণী শুনে এমন ঝুঁকিপূর্ণ পথে সে দিন কেউ হাঁটেননি। শুধু হায়েনার কবল থেকে দেশ বাঁচাতে কণ্টকাকীর্ণ পথে অজানা সাথীদের সাথে প্রত্যয় নিয়ে দুর্বার গতিতে হেঁটেছেন, গান করেছেন, ছবি এঁকেছেন। তাদের এই ত্যাগতিতিক্ষা এখন সব এক কোলায় ঢুকানোর দরকার কী! তাহলে তো বিফলে যাবে। তাদের সেই মহান ত্যাগকে এখন ছিনতাইয়ের জন্য নানা ছলাকলা, কূটকৌশল অব্যাহতভাবে চলছে।
আসলে দিনের শেষে এমন সব প্রহসন প্রদর্শন সব বিফলে যেতে বাধ্য। কারণ সময় কাউকে বাড়তি সুযোগ দেয় না। যার যতটুকু পাওনা ঠিক ততটুকু তাকে বুঝিয়ে দেয়। কারো কাছ থেকে জবরদস্তি করে বাড়তি সুযোগ আদায় করাও নানা বিবেচনায় দুরারোগ্য এক ব্যাধি, যা দিনে দিনে জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। আজ জাতির আত্মজিজ্ঞাসার সময়, মুষ্টিবদ্ধ করে সংকল্পবদ্ধ হয়ে শপথ নেয়ার সময়। এর আর কোনো ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না।
এ লেখা শেষ করব ভুলতে বসা জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে। সেই অভ্যুত্থানের ইতিকথা আমরা যদি ভুলে যেতে থাকিÑ ভবিষ্যতে এই জনপদের মানুষ অতীত দিনের ইতিহাস পাঠ করে ‘আজকের কাউকে, কাউকে’ তীব্র ভাষায় নিন্দাবাদ করতে ছাড় দেবেন না। আমরা জানি, এই ভূ-ভাগের মানুষ ইতিহাসের পাঠ নিয়ে নিরাসক্ত, উদাসীন।
আমজনতার কথা বলছি না, সেসব বোদ্ধার কথা বলছি, যারা কেবল সময়ে অসময়ে নয় বস্তুত সবসময় ইতিহাসের মর্মবাণী আমজনতাকে জানাবেন। গণমানুষকে ইতিহাসের পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। জুলাই-আগস্টের যোগফলটা হচ্ছে, ‘তুমি চেয়েছিলে মুক্ত স্বদেশ ভূমি/তুমি চেয়েছিলে এ বিরান মাঠে/ফসলের মৌসুমী’-এই চাওয়ায় দোষটা কোথায়। সে এক চমৎকার মিলনমেলার গান। জিনসের পাশাপাশি হিজাবধারী কন্যা। এমন অনুপম দৃশ্য কিভাবে ভুলব। আমজনতা একে-অপরের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার অপূর্ব দৃশ্যের এমন সব প্রতিচ্ছবি কোনো রাজনৈতিক দলের সমাবেশ বা মিছিলে কেউ কি কখনো দেখেছেন? মেয়েদের মিছিলে যোগ দেয়া কখনো নিরাপদ বলে মনে করেননি নারীরা। এখানে মৌলিক পার্থক্য আছে, রাজনৈতিক দলের মিছিলে নেতার নামে জিন্দাবাদ ধ্বনি তোলা হয়। জুলাই-আগস্টের লাখো মানুষের মিছিলে শুধু দেশের কথা ছিল। দলের কথা কেউ উচ্চারণ করে বিভাজন সৃষ্টি করেননি। তাই ওই সব মিছিল হয়ে উঠেছিল শিল্পীর আঁকা অনন্যশৈলীর একেকটি ক্যানভাস।
বাস্তবতা হলো- চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিপক্ষ হওয়ার অর্থ হচ্ছে, আবারো হাতে-পায়ে জিঞ্জির ও ঠোঁটে তালা ঝুলবে। নিজ দেশে পরবাসী হয়ে থাকা। তাই সবাইকে মনে রাখতে হবে, এ দেশে মাটি ও মানুষ আষাঢ়-শ্রাবণে গলে কাদা হয়ে যায়; আবার চৈত্র-বৈশাখে শিলায় পরিণত হয়। অতএব সাধু সাবধান। সীমান্তের এ-পারে ও-পারে যদি কারো মাটি-মানুষের প্রতিপক্ষ হতে খায়েশ জাগে, তবে তাদের ওপর শিলাবর্ষণ হলে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বাংলাদেশের মানুষ একবার বেলতলায় গেছেন, আর কখনো নয়। ফ্যাসিবাদবিরোধী সবাইকে সৃষ্ট ব্যবধান দ্রুত ঘোচাতে হবে সময় উত্তরণের আগেই।
[email protected]