যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্ট্র্যাটেজি ২০২৫ ও বাংলাদেশ

বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকরা যদি সময়োপযোগী কূটনীতি, অর্থনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রতিরক্ষামূলক সক্ষমতা গড়ে তুলতে পারেন, তবে এই কৌশলগত পরিবর্তনকে সম্ভাবনায় রূপান্তর করা সম্ভব।

২০২৫ সালের যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল (National Security Strategy- NSS) বিশ্ব রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। পুরনো উদার-আন্তর্জাতিকতাবাদী নীতির সরল প্রচার থেকে দূরে সরে এই দলিলটি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে : জাতীয় স্বার্থ, সীমান্ত, শিল্পনীতি ও প্রযুক্তিগত আধিপত্যই ভবিষ্যৎ আমেরিকার কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু। সংক্ষেপে বলা যায়, ÔAmerica First is National Security First.এ নিবন্ধে এনএসএস-২০২৫-এর মূল দিকগুলো, কৌশলগত বিবর্তন, আঞ্চলিক প্রভাব ও দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষত বাংলাদেশের ওপর এর সম্ভাব্য প্রভাব বিশ্লেষণ করা হলো।

প্রথমত, এনএসএস-২০২৫-এর ভাবধারা হলো- যুক্তরাষ্ট্র এ দলিলে শক্তির ওপর ভিত্তি করে শান্তি প্রতিষ্ঠার নীতিকে কেন্দ্রীয় করে নিয়েছে। আর্থ-সামরিক সক্ষমতা, শিল্প-নার্ভস এবং প্রযুক্তি-প্রাধান্য- এ সবকে জাতীয় নিরাপত্তার মূল স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে। এর সাথে যুক্ত রয়েছে বাস্তববাদী কূটনীতি, অর্থাৎ- মানবাধিকার বা গণতন্ত্রের সর্বজনীন প্রচারকে দৈনন্দিন কূটনীতির প্রধান অপারেটিং নীতিতে আর পরিণত করা হবে না; বরং যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ দরকার সেখানে লেনদেনভিত্তিক সম্পর্কই অগ্রাধিকার পাবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি পুরনো ‘ম্যাজিক-ডিপ্লোমেসি’ বা নরম শক্তি-কৌশল থেকে সরাসরি ফেরা- এখানে মূল বিষয় হচ্ছে স্থিতিশীল স্বার্থ সংরক্ষণ।

দ্বিতীয়ত, সীমান্ত ও অভিবাসন-সম্পর্কিত নীতি অত্যন্ত শক্ত করে চিহ্নিত করা হয়েছে। এনএসএস-২০২৫ অভিবাসনকে শুধু সামাজিক ইস্যু হিসেবে না দেখে তা জাতীয় নিরাপত্তার সরাসরি অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। মাদক-কার্টেল, মানবপাচার চক্র এবং অসংগঠিত সংখ্যক অভিবাসন- এসবকে ‘ট্রান্সন্যাশনাল হুমকি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে বিশেষ করে দক্ষিণ সীমান্তে (মেক্সিকো সীমান্ত) কড়া নজরদারি ও প্রযুক্তিভিত্তিক সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব উঠে এসেছে। এই নীতিকে ল্যাটিন আমেরিকাকে নিবিড়ভাবে দেখাশোনা করার এক নতুন মনরো-ধারণা হিসেবে ধরা যাচ্ছে, যা এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি কৌশলগত উপস্থিতি ফিরিয়ে আনতে পারে।

তৃতীয়ত, সামরিক ও প্রতিরক্ষা-আধুনিকায়ন এনএসএসের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার। আধুনিক হাইটেক যুদ্ধের জন্য নিউক্লিয়ার ট্রায়াড আধুনিকায়ন, হাইপারসনিক অস্ত্র, মহাকাশ ও সাইবার ক্ষমতা ও এআই-চালিত যুদ্ধব্যবস্থার উন্নয়নকে কেন্দ্রীয় বিষয় ধরা হয়েছে। কৌশলটি সরাসরি চীন ও রাশিয়ার প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মোকাবেলায় গড়া, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে যুদ্ধক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, লক্ষ্য শনাক্তকরণ ও রেসপন্স সিস্টেমে এআই-প্রযুক্তিকে প্রধান ভূমিকা দেয়ার মাধ্যমে প্রতিদ্ব›দ্বীদের তুলনায় পেছনে না পড়া। এ ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা শিল্পে দেশের অভ্যন্তরীণ জোগান বাঁচানো, অর্থাৎ- ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেস পুনরুজ্জীবিত করাও নথির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

চতুর্থত, অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব ও শিল্পনীতি এনএসএসের আরেকটি বড় স্তম্ভ। নথিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘অর্থনৈতিক নিরাপত্তা হলো জাতীয় নিরাপত্তা’। সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন, রিয়ার আর্থ উপাদান, ব্যাটারি ও অন্যান্য কৌশলগত উপকরণ পুনরায় দেশের মধ্যে আনতে হবে; সরবরাহ শৃঙ্খলকে চীন-নির্ভরতা থেকে মুক্ত করা অপরিহার্য। এখানে নিছক শুল্কনীতি নয়; কৌশলগত ভর্তুকি, সরকারি প্রণোদনা ও সরবরাহ-রিজিলিয়েন্স নীতির কথাই বলা হচ্ছে। এর ফলে চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অর্থনীতির ওপর সরাসরি প্রতিক্রিয়া পড়বে- বিশেষত যেখানে কম খরচে উৎপাদন নিয়ে বড় অংশ নির্ভর করে চীনের সাথে সংযুক্ত সরবরাহ চেইনে।

পঞ্চমত, প্রযুক্তি-প্রাধান্য কৌশলে এনএসএস গভীর গুরুত্বারোপ করেছে। এআই, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, বায়োটেকনোলজি ও ৫-জি/৬-জি টেলিকম-নেটওয়ার্ক- এসবকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। নথির প্রতিপাদ্য ‘প্রযুক্তি=ক্ষমতা=সার্বভৌমত্ব’। তাই টেলিকমে চীনের প্রভাব কমানো, কোয়ান্টামে সাইবার-শিকড় ভাঙার প্রতিরোধ, আর বায়োটেক খাতে দেশীয় অগ্রগতি অর্জন- এসব কৌশলগত অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা কেবল সামরিক নয়, এটি অর্থনীতির, কূটনীতির ও সামাজিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও নির্ধারণী ভূমিকা রাখবে।

ভূ-রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় এনএসএস বিভিন্ন অঞ্চলে পৃথক কৌশলগুলো স্পষ্টভাবে চিহ্নিত। পশ্চিম গোলার্ধে (ল্যাটিন আমেরিকা) একটি আধুনিক মনরো ডকট্রিনের সুর শোনা যাচ্ছে; চীনের আর রাশিয়ার বিনিয়োগ ও প্রভাব বৃদ্ধি প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পৃক্ততা সেখানে বৃদ্ধি করবে। ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনকে সরাসরি শত্রু ভাবা হয়নি, তবু প্রতিযোগিতা স্পষ্ট- ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ে সাপ্লাই চেইন ও সামরিক জোট শক্তিশালী করা হবে, তবে সামরিক সঙ্ঘাত এড়িয়ে চলা হবে। ইউরোপীয় মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ন্যাটো থাকবে; কিন্তু ইউরোপকে বেশি আত্মনির্ভর হতে হবে; ইউক্রেন বা রাশিয়া-বিষয়ক সিদ্ধান্তগুলো রাষ্ট্রীয় স্বার্থের আলোকে নেয়া হবে- বøাঙ্ক চেকের অধিকার আর নেই। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বড় আকারের হস্তক্ষেপ কমবে; কিন্তু ইসরাইলসহ কিছু কোর স্বার্থে সমর্থন অব্যাহত থাকবে।

এই কৌশলগত পুনঃটিউনিংয়ের ফলে বিশ্বব্যবস্থা নতুনভাবে বিভক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে; একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইন্দো-প্যাসিফিক অংশীদারিত্ব, অন্যদিকে চীন-রাশিয়া সমন্বিত মেরুকরণ। কিন্তু এটি শীতল-যুদ্ধের মতো সম্পূর্ণ সামরিক বিভাজন নয়; বরং প্রযুক্তি-অর্থনীতির কেন্দ্রিক দ্বৈত ব্যবস্থা হবে, যেখানে সরবরাহ চেইন, প্রযুক্তি স্ট্যান্ডার্ড ও ডিজিটাল অবকাঠামোই বিভাজকের ভূমিকা নেবে।

বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে এনএসএস

বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে এনএসএস ২০২৫-এর তাৎপর্য অনস্বীকার্য। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর কৌশলগত নির্ভরতা বাড়ালে বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র-অর্থনীতিকে ভারসাম্যের নীতি বজায় রাখতে হবে- নিরপেক্ষতা ও কৌশলগত বহুমুখিতায় বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, সাপ্লাই-চেইন রি-ওরিয়েন্টেশনে বাংলাদেশ সম্ভাব্য বিজয়ী হতে পারে, টেক্সটাইল ও হালকা ইলেকট্রনিক্স শিল্পে বিনিয়োগ আকর্ষণের সুযোগ রয়েছে, যদি দেশটি দক্ষতা, অবকাঠামো ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ উপস্থাপন করে। তৃতীয়ত, মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ অপেক্ষাকৃত কঠোর না রেখে কৌশলগত বাণিজ্য ও প্রযুক্তি-সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিতে পারে; ফলে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে চাপে ছাঁকনি দেখা যেতে পারে, তবে তা হবে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের ভিত্তিতে। চতুর্থত, বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের জিওস্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব বেড়ে যাবে; তাই নৌপরিবহন, বন্দর ও ডিজিটাল ইন্টারকানেক্টিভিটির উন্নয়নে অভ্যন্তরীণভাবে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

এনএসএস ২০২৫-এর বাস্তবায়ন অবশ্যই সরাসরি ও সময়সাপেক্ষ হবে; তবে এর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনুষঙ্গ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তরঙ্গ সৃষ্টি করেছে। সমালোচকরা বলছেন, এই কৌশল বিশ্বে বিভাজন বাড়াবে, বহুপাক্ষিকতা ও আন্তর্জাতিক সহায়তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর চাপ বাড়াবে। অনেকে আশঙ্কা করছেন, প্রযুক্তি-জাতীয়তাবাদ ও সরবরাহ চেইন বিভাজন বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ধীরতর করবে। তবু যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য স্পষ্ট : তাদের গ্রাহ্য-স্বার্থ, শিল্প-সামর্থ্য ও সামরিক আধিপত্য রক্ষা করে নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাকে গ্রহণ করা।

যুক্তরাষ্ট্রের ভারত-নির্ভরতা : বাংলাদেশের জন্য নতুন পরীক্ষা

এনএসএস ২০২৫-এর ভাষ্য স্পষ্ট, ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তা কাঠামোতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ভূমিকাকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার স্তম্ভ হিসেবে দেখছে। এটি শুধু সামরিক সহযোগিতা নয়; প্রযুক্তি, সাপ্লাই-চেইন, সেমিকন্ডাক্টর, সাইবার সিকিউরিটি- সব খাতে ভারতের সাথে দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্বের ঘোষণা।

কিন্তু এর সরাসরি ভূরাজনৈতিক প্রতিফলন রয়েছে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান ও পররাষ্ট্রনীতিতে। ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ইকোসিস্টেমকে আরো ‘ভারতকেন্দ্রিক’ করে তুলতে পারে। ফলে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক এখন থেকে আরো বেশি দিল্লি-সংবেদনশীল হবে।

বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো- একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্য বিধান, অন্যদিকে ভারতের একতরফা আঞ্চলিক প্রভাব থেকে পরিপূর্ণ কৌশলগত স্বাধীনতা বজায় রাখা। বাংলাদেশ যদি ভারসাম্যনীতি সফলভাবে বজায় রাখতে পারে, চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে নেভিগেট করে- তাহলেই এই অঞ্চলিক পুনর্বিন্যাস তার সুদূরপ্রসারী ঝুঁকিকে সুযোগে রূপান্তর করতে পারবে।

সেমিকন্ডাক্টর, টেক্সটাইল ও ব্যাটারি-ভিত্তিক সাপ্লাই-চেইন পুনর্গঠন হতে পারে সেই সুযোগের একটি। এনএসএস ২০২৫-এ অন্যতম বড় বৈশ্বিক পরিবর্তন হলো চীন-নির্ভর উৎপাদন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ধীরে ধীরে বের হয়ে আসা। এর তিনটি খাতের বিশেষ গুরুত্ব আছে। চিপস ও ইলেকট্রনিক অ্যাসেম্বলি টেক্সটাইল-অ্যাপারেল-স্মার্ট ফাইবার ব্যাটারি ও ক্লিন-এনার্জি সাপ্লাই-চেইন।

যুক্তরাষ্ট্র সাপ্লাই-চেইন অংশীদার হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় বৈচিত্র্য আনতে চাইছে। এতে বাংলাদেশ একটি স্বাভাবিক লাভবান দেশ হতে পারে, কারণ : পোশাক-টেক্সটাইল খাতে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে; সেমিকন্ডাক্টর অ্যাসেম্বলিং ও প্যাকেজিং শিল্পে সম্ভাব্য নতুন বিনিয়োগ আসতে পারে; লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যাটারি শিল্পে আমদানি-নির্ভরতা কমানোর সুযোগ রয়েছে এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র-জাপান-ইউরোপীয় দেশগুলোর বিনিয়োগ আকর্ষণ হতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন হবে তিনটি বিষয়- নীতিগত স্বচ্ছতা, লজিস্টিক্স সংস্কার এবং রাজনৈতিক ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ পরিবেশ।

মানবাধিকার ইস্যুতে চাপ থাকবে, তবে সেটি হবে ‘কৌশলগত’ চাপ। এনএসএস ২০২৫-এর মানবাধিকার অধ্যায়ে একটি মাত্রাগত পরিবর্তন স্পষ্ট- এখন এটি নৈতিকতার চেয়ে কৌশলগত স্বার্থসংশ্লিষ্ট হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।

বাংলাদেশের জন্য এর প্রয়োগ হবে সেভাবে। মানবাধিকার ইস্যুতে ওয়াশিংটন আর ‘মূল্য-চালিত বৈদেশিক নীতি’ নয়, ‘সুদ-চালিত লিভারেজ’ হিসেবে ব্যবহার করবে। চাপ থাকবে বিশেষত নির্বাচনী প্রক্রিয়া, গণমাধ্যম স্বাধীনতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহির বিষয়ে। তবে চাপের প্রকৃতি হবে প্রসেস-ভিত্তিক, শাস্তিমূলক নয়- কারণ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক সাপ্লাই-চেইন ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় প্রয়োজনীয় অংশীদার হিসেবে দেখছে। অর্থাৎ- সম্পর্কে চাপ থাকবে; কিন্তু সম্পর্ক ছিন্ন হবে না; বরং চাপের উদ্দেশ্য হবে পুনর্গঠন, বিচ্ছিন্নতা নয়।

বঙ্গোপসাগর নতুন জিওস্ট্র্যাটেজিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্র হচ্ছে। এনএসএস ২০২৫-এ চীনকে ‘গতিশীল চ্যালেঞ্জ’ এবং ভারতকে ‘কৌশলগত অংশীদার’ হিসেবে সংজ্ঞায়ন করা- বঙ্গোপসাগরকে নতুনভাবে ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে তুলে এনেছে। আর বঙ্গোপসাগরের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা আছে : চীনা বেল্ট অ্যান্ড রোড সংযোগ; ভারতের ‘সাগর’ সিকিউরিটি ডকট্রিন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক মেরিটাইম আর্কিটেকচার। বাংলাদেশ এই তিন শক্তির মাঝামাঝি একটি সমুদ্র কৌশলগত নোড হয়ে উঠছে।

ফলে- নৌ-কৌশলগত সহায়তা; সমুদ্র নিরাপত্তায় যৌথ মহড়া ও নন-ট্র্যাডিশনাল সিকিউরিটি ইস্যু (পাইরেসি, সাইবার-মেরিটাইম, আন্ডারসি ডেটা কেবল নিরাপত্তা) এসব খাতে যুক্তরাষ্ট্র- বাংলাদেশ সহযোগিতা আরো বাড়বে। বঙ্গোপসাগর এখন শুধু সমুদ্র বাণিজ্যপথ নয়; এটি এআই ডেটা কেবল- সেমিকন্ডাক্টর-ব্যাটারি রেসের নতুন ফ্রন্টলাইন হয়ে উঠছে।

এ কারণে সাইবার নিরাপত্তা, এআই ও ডিজিটাল অবকাঠামোতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারিত্ব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এনএসএস ২০২৫ প্রথমবারের মতো এআইকে ‘গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা পরিকাঠামো’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এর মানে, এআই এখন সামরিক-অর্থনৈতিক-সাইবার ক্ষমতার কেন্দ্র।

বাংলাদেশের জন্য এর তিনটি কৌশলগত সুযোগ সামনে এসেছে : ক. সাইবার ডিফেন্স পার্টনারশিপ : বাংলাদেশের ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক, সরকারি ডিজিটাল অবকাঠামো এবং গুরুত্বপূর্ণ ডেটাসেন্টারগুলো ক্রমে আক্রমণের ঝুঁকিতে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথ থ্রেট-ইন্টেলিজেন্স প্ল্যাটফর্ম এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

খ. ডিজিটাল অবকাঠামো বিনিয়োগ : ডেটা সেন্টার, ক্লাউড আর্কিটেকচার, সিকিউর ডেটা স্টোরেজ- এসব খাতে যুক্তরাষ্ট্র চাইলে বড় বিনিয়োগকারী হতে পারে।

গ. এআই ও সাইবার দক্ষতা উন্নয়ন : প্রযুক্তি-শিক্ষা, স্কিল ডেভেলপমেন্ট, এআই গবেষণায় সহযোগিতা- এসব বাংলাদেশের শ্রমবাজারকে মূল্যবৃদ্ধি করবে এবং যুব জনগোষ্ঠীকে বৈশ্বিক এআই অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে।

এনএসএস ২০২৫ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিকে নতুনভাবে পুনর্গঠন করছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীন নিজেদের প্রভাববলয় বাড়াতে প্রতিযোগিতামূলক কৌশল অনুসরণ করছে। এই রূপান্তরের মধ্যে বাংলাদেশ একটি ক্রিটিক্যাল ব্যালান্সিং স্টেট। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্ক মানে বাংলাদেশকে একই নীতি নিতে হবে তা নয়। চীন বাংলাদেশ সম্পর্ক নির্মিত হবে বাংলাদেশের কৌশলগত সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা সামনে রেখে। পাকিস্তানের চীন-আমেরিকা সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা থেকে বাংলাদেশ পাঠ নিতে পারে। তবে নতুন এআই ও সেমিকন্ডাক্টর ও প্রতিরক্ষা খাতে অগ্রগতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি তুরস্কের মতো দেশের সাথে অংশীদারিত্ব তৈরি করতে হবে।

সঠিক কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিলে সাপ্লাই-চেইন, প্রযুক্তি, সাইবার নিরাপত্তা, সমুদ্রনীতি, ভূ-কৌশলগত অবস্থান- সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে। আর ভুল সিদ্ধান্ত নিলে, আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার ফাঁদে পড়ে অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি, সবখানেই ঝুঁকি বাড়বে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এখন এমন একটি মোড়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে সঠিক ভারসাম্যই হবে শক্তি; ভুল ভারসাম্যই হবে দুর্বলতা।

২০২৫ সালের যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল-২০২৫ একটি বাছাই করা, বাস্তববাদী এবং শক্তিনির্ভর কৌশল। এটি কেবল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বই নয়- এটি একটি বৈশ্বিক কৌশলগত নির্দেশিকা, যার প্রভাব আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, প্রযুক্তি নীতি ও আঞ্চলিক সংঘটনে দীর্ঘস্থায়ী হবে। বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকরা যদি সময়োপযোগী কূটনীতি, অর্থনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রতিরক্ষামূলক সক্ষমতা গড়ে তুলতে পারেন, তবে এই কৌশলগত পরিবর্তনকে সম্ভাবনায় রূপান্তর করা সম্ভব। নইলে, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার নতুন মানচিত্রে ইস্যু ও ঝুঁকি উভয়ই বাড়বে- আর সেটিই হওয়া সম্ভবত আগামী কয়েক বছরে আমাদের পরীক্ষার মঞ্চ।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক নয়া দিগন্ত