কলকাতার এক ঘনিষ্ঠ কলামিস্ট এখানকার এক বাংলা দৈনিকে এক উপ-সম্পাদকীয়তে লিখলেন ‘আমাদের দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ভারতের সাথে কী করতে চাইছে’ শীর্ষক একটি কলাম। যা হোক, আমি প্রশ্নটির উত্তর একটু ঘুরিয়ে দেবো। একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে ফিল্ড মার্শাল জেনারেল কারিয়াপ্পা ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন, মিসেস গান্ধী একটি শক্তিকে আপনি দু’ভাগে ভাগ করতে চাইছেন, ভবিষ্যতে কিন্তু দুটো শক্তি আমাদের বিরুদ্ধে চলে যাবে। কারিয়াপ্পার ভবিষ্যৎবাণী একেবারে নিখুঁত। পাকিস্তান সেই শুরু থেকে ভারতের শত্রু। পাকিস্তান ভেঙে ভারতের হাতে গড়া বাংলাদেশ এখন ঠিক একেবারে শত্রুরাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। শুধু বাংলাদেশকেইবা কেন বলব, ভারতের কোনো প্রতিবেশী দেশের সাথে দিল্লির মধুর সম্পর্ক রয়েছে? মোটেই না। তাহলে বছরতিনেক আগে কাঠমান্ডু কেন তার সংসদে পাস করিয়ে নিলো ভারতের বিহার, উত্তরাখণ্ড ও উত্তরপ্রদেশের বেশ কিছু জায়গা নেপালের। কেন ভুটান ভারতকে পানি দিলো না? শ্রীলঙ্কা বা মালদ্বীপের সাথে ভারতের সম্পর্ক ভালো রয়েছে? কেন নেই? এর মূলে কি ভারতের বিদেশনীতি বা পররাষ্ট্র নীতির গোপনীয়তা?
ভারতের পররাষ্ট্রনীতি বা বিদেশনীতি এখন প্রশ্ন চিহ্নের মুখে? পররাষ্ট্র নীতি প্রশ্নবিদ্ধ? তা কি মোদির আমলেই? এটাও মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন বটে। কেন স্বাধীন বিদেশনীতিই একমাত্র পথ? এর জবাব দিতে গেলে আমাদের একটু অতীতের দিকে নজর দিতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন ২০২০ সালে করোনাকালে ভারতের প্রদত্ত জাল করোনার টিকা ঘিরে বাংলাদেশের রাস্তায় রাস্তায় পোস্টারে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল। পোস্টারে লেখা ছিল, ‘ গো ব্যাক ইন্ডিয়া, ওয়েলকাম চায়না’।
রুশ বিপ্লবের রূপকার ভøাদিমির লেনিনের ভাষ্য হলো, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতি থেকে বিদেশনীতি থেকে পৃথক করার চেয়ে ভুল বা ক্ষতিকারক ধারণা আর কিছু হতে পারে না। যুদ্ধকালীন এই পৃথকীকরণের ভয়াবহ মিথ্যাচার আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠে। তবু বুর্জোয়ারা ধারণাটি পেশ এবং প্রচার করার জন্য সম্ভাব্য এবং অসম্ভব সবকিছু করছে। অভ্যন্তরীণ নীতির চেয়ে বিদেশনীতি সম্পর্কে জনগণের অজ্ঞতা অতুলনীয়ভাবে বেশি। কূটনৈতিক সম্পর্কের ‘গোপনীয়তা’ পবিত্রভাবে পালন করা হয়, সবচেয়ে মুক্ত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে এবং টেকসই গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রগুলোতে। লেনিন এ কথাগুলো বলেছিলেন ১৯১৭ সালের জুন মাসে তার লেখা ‘দ্য ফরেন পলিসি অফ দ্য রাশিয়ান রেভেলিউশন’ শীর্ষক প্রবন্ধে। লেনিনের এ কথার সাথে আজকের ভারতের মোদি সরকারের বিদেশনীতির মিলটা কিন্তু চোখে পড়ার মতো। বিশেষত ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে। এ কথা আজ দিনের আলোর মতো সত্য যে, মোদি সরকারের আমলে পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে সবচেয়ে একতরফা ও ‘গোপনচারিতা’ বজায় রাখা হয়েছে এবং বেহাল অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে। আর জাতীয় স্বার্থ সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তৃতীয় দফায় (২০২৪) ক্ষমতায় আসার পর। মোদি সরকারের আগেও ভারতের পররাষ্ট্রনীতি জটিলতার মুখোমুখি হলেও এতখানি অপমানিত হতে হয়নি। এটি হলো মোদ্দা কথা। রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং পররাষ্ট্রবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা এটিই মনে করছেন।
এখন আমরা দেখে নিতে পারি যে, ভারতের বিদেশনীতি বা পররাষ্ট্রনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী। স্বাধীন ভারতের পররাষ্ট্রনীতি বা বিদেশনীতির মৌলিক ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো হলো, বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদ আধিপত্যবাদ বিরোধিতা, ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধিতা, জোটনিরপেক্ষতা ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি সমর্থন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নত করা, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঐক্য ও সংহতির প্রতি সমর্থন, বর্ণবিদ্বেষ ও জায়নবাদের বিরোধিতা, যুদ্ধের বিরোধিতা ও নিরস্ত্রীকরণের প্রতি সমর্থন। কিছু দোদুল্যমান হলেও মৌলিক বিদেশনীতি অটুট থেকেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের একটা মর্যাদা ছিল। রাষ্ট্রসঙ্ঘের ভিতরে ও বাইরে ভারতের ভূমিকার একটা মর্যাদাসম্পন্ন স্বীকৃতি ছিল। ১৯৮৩ সালে ভারত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সভাপতি-রাষ্ট্র নিযুক্ত হয়।
দুঃখের বিষয়, ১৯৮৯-৯২ সালের মধ্যে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সাথে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পতনে বিশ্বরাজনীতির ভারসাম্যের গুণগত বদল হতে থাকে। ঠাণ্ডাযুদ্ধে জয়ী হয় আমেরিকা। ফলে গোটা বিশ্ব যেন হয়ে ওঠে আমেরিকার করতলগত। মধ্যপ্রাচ্যে হামলাবাজির মাধ্যমে তা শুরু হয়। আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ হয়ে উঠল বিশ্বের একমাত্র প্রভু। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম)। নতুন পরিস্থিতিতে আমেরিকা ও পশ্চিমা বন্ধুরা জায়নবাদী ইসরাইলকে ফিলিস্তিন দখলের সবধরনের অস্ত্রসহ সহযোগিতা করে যা আজও চলছে।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতির নেতিবাচক দিকগুলো স্পষ্ট হতে থাকে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অবলুপ্তির সাথে সাথে ভারত অবলম্বন করে উদারবাদী পথ। আমেরিকার সাথে ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তি, সামরিক সহযোগিতা, আমেরিকার সাথে কৌশলগত বোঝাপড়া, ন্যাটো শরিকদের সাথে বাড়তি বোঝাপড়া, ইসরাইলের মতো কট্টর দক্ষিণপন্থী পক্ষগুলোর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করার লক্ষণগুলো প্রকট হতে থাকে। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রতি ভারত ক্রমেই উদাসীন হতে থাকে। ১৯৯১-৯৬ সাল সময়ে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসীমা রাওয়ের নেতৃত্বে গঠিত কংগ্রেস সরকারের আমলে এ পরিবর্তন স্পষ্ট হতে থাকে।
কিন্তু ওই নব্বইয়ের দশকে বিজেপি-আরএসএসের শক্তি ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে তখনকার বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির রাম তীর্থ যাত্রায় উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তির বাড়-বাড়ন্ত হয়। ১৯৯৬ সালে দিল্লিতে বিজেপি ১৩ দিন সরকার চালায়। ১৯৯৮ সালে এক বছর। ১৯৯৯-২০০৪ পর্যন্ত অটলবিহারি বাজপেয়ির অধীনে বিজেপি বিজেপি পাঁচ বছর ক্ষমতাসীন। এই বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার ভারতের পররাষ্ট্রনীতি আরো দক্ষিণে ঠেলে দেয়। বলা চলে একেবারে তলানিতে চলে যায়।
আবার ২০০৪-২০০৯ ও ২০০৯-২০১৪ কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের আমলে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির ওপর জোর দেয়া হয় কিছুটা বামদলসহ বিরোধীদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে।
তবে সমস্যা গভীরতর হয়ে ওঠে ২০১৪ সালে মোদি জমানায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের আমলে। এই নরেন্দ্র মোদির আমলে ১১ বছর ভারতের পররাষ্ট্রনীতি তার অতীত অর্জনগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এটা জাতীয় স্বার্থের পক্ষে মোটেই ভালো হয়নি। ২০১৪ ও ২০১৯ সালে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া বিজেপি সরকার পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের যেন একটা বন্ধু হয়ে ভারত তার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিকে পুরোপুরি জলাঞ্জলি দেয়। যা করবে তাতে যেন আমেরিকার কর্তৃত্ব। ইসরাইল-ফিলিস্তিন নিয়ে এই মোদি সরকার প্যালেস্টাইনের প্রতি সংহতি জ্ঞাপনের পরিবর্তে ইসরাইলইকে সমর্থন জানায়।
মোদি জমানায় পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে বিরোধী দলগুলোর সাথে জাতীয় স্তরে ঐকমত্য গঠনের বিষয়টি সেভাবে কার্যকর হয়নি। এখানেও আরএসএসের গেরুয়া নীতি প্রধান হয়ে ওঠে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে যে সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন বা সার্ক গড়ে উঠেছিল তাতে ভারতের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা লক্ষণীয় মাত্রায় দৃশ্যমান হয়। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে মতবিনিময়ের কোনো স্থি’তিশীল ব্যবস্থা ছিল না বা এখনো নেই। এ ক্ষেত্রেও যেন আমেরিকা ভারতের নীতিনির্ধারণ করবে। যুক্তরাষ্ট্র যে কী বস্তু তা তো দেখা গেল ভারতের ওপর শুল্ক চাপানোর ঘটনায়। অপারেশন সিঁদুরেও সেই মার্কিননির্ভরতা। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের মান তলানিতে। ভারতের সাথে প্রতিবেশী দেশগুলোর কী সম্পর্ক তা তো বোঝাই যায়। মোট কথা ভারতের পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নচিহ্নের মুখে। এক কথায় প্রশ্নবিদ্ধ।
লেখক : পশ্চিমবঙ্গের কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও কবি