আত্মহনন নাকি আত্মবিকাশ, কোনটি চান

শেখ হাসিনা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কখনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন না। বিশেষ করে অপর দুই দল জামায়াত-বিএনপিকে ষড়যন্ত্রকারী ও বিশ্বঘাতকতার প্রতীক হিসেবে তার মন-মগজে স্থায়ীভাবে প্রোথিত ছিল। আর সে জন্য দুই দলের ওপর চলেছে অবিরাম অত্যাচার-অবিচার, জেল, জুলুম-নির্যাতন। এখন ভাবতে হবে, আত্মঅনুসন্ধান করতে হবে, দেশের জন্য তারা এখন কী চান। আত্মহনন নাকি আত্মবিকাশ।

সালাহউদ্দিন বাবর
সালাহউদ্দিন বাবর |নয়া দিগন্ত গ্রাফিক্স

বাংলাদেশের জনদুর্ভাগ্যের কাহিনীর অন্ত নেই। এর অন্যতম একটি হচ্ছে- দেশে একসময় অনেক কিংবদন্তি নেতা ছিলেন। তারা সবাই নিজ নিজ সময়ে রাজনীতির অঙ্গনে সমুজ্জ্বল তারকা ছিলেন। সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা, এ জনপদের জনমনে আশা জাগাতে এবং কিছুটা সুস্থিতি দিতে সক্ষম। তারা কেউ অতিকথনের দোষে দুষ্ট ছিলেন না। তাই তো তারা এখনো মানুষের মন থেকে হারিয়ে যাননি। সততা ন্যায্যতা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনে এখনো তারা স্মরণীয় বরণীয় এবং উদাহরণ হয়ে আছেন। তবে সেই সব ব্যক্তিত্ব, যা করতে পারেননি বা ব্যর্থ হয়েছেন- অর্থাৎ তাদের শুদ্ধ রাজনীতির ধারাবাহিকতা জারি রাখার কোনো ব্যবস্থা করে যেতে পারেননি। মানে, তাদের মতো দক্ষ যোগ্য সক্ষম কোনো ‘ডিসাইপল’ বা উত্তরসূরি তৈরি করে যাননি। হতে পারে, এমন চেষ্টা তারা করেননি। এর ফলে বরং বিশৃঙ্খল কিছু ‘ফলোয়ার’ বা অনুসারী সৃষ্টি হয়েছে।

কিংবদন্তি নেতাদের আদর্শ এখন তাদের কথিত ফলোয়াররা অনুসরণ করেন না। তবে পূর্বসূরিদের অনুসারী হিসেবে নিজেদের প্রচার করা থেকে পিছিয়ে থাকেন না। নিজেদের ‘বাজারমূল্য’ বাড়াতে এসব করে থাকেন তারা। অর্থাৎ পূর্বসূরি নেতাদের নিয়ে জব্বর এক ব্যবসায় করে যাচ্ছেন। পূর্বসূরিদের জনসেবা করা থেকে, আদর্শচ্যুত হয়ে এখন শুধু আত্ম-প্রতিষ্ঠায় নিজের সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের মতো আরো যত পথচ্যুত ‘ডিসাইপল’ আছেন, তারা এখন নিজেদের রাজনীতি থেকে ফায়দা তুলতেন, পকেট ভরতে অকারণ অর্থহীন বিতর্ক জুড়ে দিয়েছেন। যাতে রাজনৈতিক অঙ্গনে তারা আলোচনায় থাকতে পারেন। তবে তাদের অন্তঃসারশূন্য কথা লোকসমাজে ক্যাওয়াস-কনফিউশন সৃষ্টি করছে।

একটি বড় দলের মহান নেতার কথিত উত্তরসূরিরা ইতোমধ্যে দেশব্যাপী যেসব কীর্তিকলাপ করেছেন; তা থেকে দলকে সুরক্ষা দিতে, দুষ্কর্মে লিপ্ত থাকা সাড়ে সাত হাজার কর্মী ও পাতিনেতাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখনো কথিত ডিসাইপলরা যত্রতত্র অপকর্ম অব্যাহত রেখেছেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে হিসাব করে দেখতে হবে, আরো কতশত হাজার কথিত ফলোয়ার এখনো দলের ভেতর ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছেন। এমন সব অপকর্ম দল ও দলের মহান নেতার ভাবমর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ করছে, ধুলায় লুটাচ্ছে মানমর্যাদা।

এসব নিয়ে সাধারণের দৃষ্টি অন্যত্র সরাতে, শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে নানা কৌশল আঁকছেন। অনাকাক্সিক্ষত এসব বিতর্ক জাতির মধ্যে দ্বিধা এবং ঐক্যকে অপরিসীম ক্ষতি করছে। সন্দেহ নেই, এমন পরিস্থিতিতে দল ও দেশের জন্য অশুভ-অচিন্তনীয় এক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। অথচ জাতীয় ঐক্যের মূল্য যে মহামূল্যবান এমন কথা ভাবছেন কি কোনো ‘মহৎ প্রাণ’। অমূল্যের সেই বিষয়-আসয়গুলো হয়তো অনেকের কাছে এখনো কুয়াশাছন্ন হয়ে আছে।

ঐক্যের মূল্য কত মূল্যবান, তা এ উপমহাদেশে কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবালের একটি কবিতায় উল্লেখ করা আছে- ‘কওম যব ইত্তেফাক হো, ইস মে কুছ শাক নাহি/কোউম কওম সে জিন্দা হ্যায়, আফরাদ সে নাহি।’ ‘কওম ইত্তেফাক হো, তো খোদা ভি বাদাল দেতা হ্যায়।’ এর বঙ্গানুবাদ করলে এমন দাঁড়ায়- যখন কোনো কওম (জাতি/সম্প্রদায়) ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন তার জন্য অসীম সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যায়। একটি জাতি জীবনধারণ করে একক সদস্যের সমষ্টি হিসেবে নয়; বরং একটি ঐক্যবদ্ধ সত্তা হিসেবে; জাতির জীবনীশক্তি ব্যক্তিগত জীবনের যোগফল থেকে আলাদা এবং উচ্চতর। সঙ্কল্প যখন দৃঢ় হয়, তখন স্বয়ং খোদাও ভাগ্য বদল করে দেন। তবে বাংলাদেশের বর্তমান ক্রান্তিলগ্নে জাতি যে মহাসঙ্কটে, সেখানে রাজনৈতিক অঙ্গনে তার কোনো প্রতিফলন কেউ দেখছেন না। এ জন্য না আছে কারো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। দেশে বহু প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে- ‘দশের লাঠি একের বোঝা’। এখন এমন বোঝা নিয়ে কাটছে লোকসমাজের সারাবেলা।

জাতীয় ঐক্য অবশ্যই কোনো বায়বীয় বিষয় নয়, দলে দলে ভাবনার যে পার্থক্য তাকে একপাশে সরিয়ে রেখে ন্যূনতম বিষয়গুলো নিয়ে সবার মধ্যে একটি সমঝোতা হতে হবে। সংশ্লিষ্ট সবাই মিলে অপরিহার্য নীতিগুলো গুচ্ছ আকারে সংবদ্ধ করা এখন জনমানসের দাবি। সেটি সংরক্ষিত করতে হবে। তাকে রাখতে হবে ধরাছোঁয়ার বাইরে, সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সময়ের বিবর্তনে কখনো কোনো নতুন নীতি সেখানে স্থান দেয়ার, আগে সেটি নিয়ে আলোচনা করে বিবেচনায় নেয়া হলে, জাতীয় ঐক্য স্থায়ী এবং দৃঢ়তর হবে। গত ৫০-৫২ বছর ধরে এমন একটি সর্বজনীন অবস্থায় পৌঁছাতে ঐকমত্যের জন্য আর কত অপেক্ষায় থাকতে হবে। এমন একটি সহজ অথচ অপরিহার্য বিষয় নিয়ে, এখনো রাজনৈতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনরা ঐকমত্যে পৌঁছতে পারছেন না।

মনে রাখতে হবে, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে বড় দেশ। এমনটি জাতির জন্য চরম দুর্ভাগ্যের পাশাপাশি প্রমাণ করে রাজনীতিকদের চরম ব্যর্থতা। ঐক্যের আলোচনায় পৌঁছানোর ব্যাপারে যত বিলম্ব হবে, তাতে নিত্য তৈরি হবে নানা বিভাজন আর বিড়ম্বনা। ঐক্যের মূল্য নিয়ে কবি-দার্শনিক আল্লামা ইকবালের ওপরে উল্লেখিত কবিতা থেকে এটি সহজবোধ্য হয়েছে যে, ঐক্যের মূল্য কত বেশি জরুরি এবং অপরিহার্য। সেই ঐক্য নির্মিত না হলে যেকোনো সমাজে বা জাতির মধ্যে সৃষ্টি হবে ভয়ঙ্কর এক অস্থিরতা। তখন কথায় কথায় ছড়িয়ে পড়বে বাক্যবাণের ‘ফলা’। এমনটি যদি ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে, তবে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে পথে প্রান্তরে হোঁচট খেতে হবে। এ দ্বিধাবিভক্তির সুযোগ নেবে ঘরের শত্রু বিভীষণরা। এমন সব বিভীষণের আশপাশে থাকবে বহু চর অনুচর আর অনাহূত অতিথিরা, তখন ছেলের ‘হাতের মোয়া’ কেড়ে নেয়ার মতো সহজ হবে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে কব্জা করা। এমন পরিস্থিতিতেও এখন দেশের হাটে-ঘাটে বসানো হচ্ছে তর্ক-বিতর্কের মেলা। কবি মধুসূদনের ভাষায় বলতে হয়- অলীক কুনাট্য রঙ্গে, মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে/ নিরখিয়া প্রাণে নাহি নাহি সয়।

এ দিকে দেশে ১৩ নম্বর নির্বাচন সম্ভাব্য একটি তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এখনো নির্বাচন নিয়ে দ্বিধা সন্দেহের শেষ নেই। এর কারণও আছে! আর তা পোকায় খাওয়া নির্বাচন, বারবার ধোঁকা খাওয়া মানুষের মন-মস্তিষ্কে গেঁথে আছে নির্বাচন নিয়ে প্রতারিত হওয়া বেদনার এক মনছবি। সে কারণে জনমনে সৃষ্টি হচ্ছে, এমন সব আস্থাহীনতা। নির্বাচন প্রাক্কালে- ডিম না মুরগি আগে, এসব অর্থহীন বিতর্ক অবশ্যই দ্বিধাদ্বন্দ্ব আরো উসকে দিচ্ছে। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে রাজনীতি অঙ্গনের পাত্র-মিত্ররা জড়িয়ে পড়ছেন নানা তর্ক-বিতর্কে। এ সুযোগে অসম্ভবকে সম্ভব করার দ্বিভাগে খোয়াব দেখছে পতিতজনেরা। নির্বাচন ভণ্ডুল করতে অনাহূত অতিথিরা যারপরনাই কৌশলে সর্বত্র বিষবাষ্প ছড়াতে তৎপর। সেই সাথে অতীতের সব খলনায়ক ও তাদের চর-অনুচররা মিলে দেশে আবারো আরেক লঙ্কাকাণ্ড বাধানোর কারসাজি করছে। এখন যে বিতর্ক আর বিভেদ চলছে, সেই সুযোগ নিয়ে তারা অনুপ্রবেশের মরণপণ চেষ্টা করছে। দেশে-বিদেশে এর আলামত স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, সব এক সূত্রে গাঁথা। তাদের দিবা ভাগের খোয়াব যদি রূপান্তরিত হয়ে রাতে আসে। তবে তার পরিণতি ভয়ঙ্কর হবে এর একটি মনছবি তৈরি করে নিতে হবে। যাতে সবাই ঐক্যের মর্ম ও মূল্য হৃদয়ে গেঁথে নিতে পারেন।

যা হোক, নিকট অতীতে পতিতদের বাংলাদেশ নিয়ে যে ন্যারেটিভ ছিল, প্রয়োজনে তা আরেকবার স্মরণ করা যেতে পারে। নিকট অতীতের কর্তৃত্ববাদী প্রশাসনের ‘মনমানসের’ মনস্তত্ত্ব ছিল- গোটা জাতিকে কব্জা করে, এর সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা। সমাজে বৈষম্য-বিভাজন তৈরি করে চূড়ান্তভাবে নৃশংসতার দিকে ঠেলে দেয়া। বিগত দেড় দশকে এক দেশ এক নেতার যে শাসনশৈলী ছিল, তার আচার-আচরণে এবং মনের গহিনে এমন তত্ত্ব চর্চিত হতো। তার ধরন ছিল রাষ্ট্র আর থাকবে না জনগণের হাতে। থাকতে হবে নেতার নিজের হাতে। ধীরে ধীরে সেখানে এমন পথনকশা তৈরি হবে, যেখানে সামাজিক অনাচার-অত্যাচার, অবক্ষয় ও নীতি-নৈতিকতা বেআব্রু হয়ে পড়বে। বস্তুত দেশকে চূড়ান্ত নৃশংসতার দিকে ঠেলে দেয়া। চালু করে দিতে হবে ব্যক্তি পূজার যত সংস্কৃতি ও কলা। নেতারা নিজেদের ভাববেন সব মানুষের চেয়ে তারা অনন্য অদ্বিতীয় এবং অসাধারণ। যাদের স্কন্ধে ঐতিহাসিক ও ঐশ্বরিক মিশন রয়েছে। ঠিক ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেমন প্রচার করেন তার জন্ম কোনো সাধারণভাবে নয়। তার পেছনে বিধাতার একটি সম্পর্ক আছে। বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে তার জন্ম।

বাংলাদেশে বিগত রেজিম নিজেদের জাতির ত্রাণকর্তা এবং ইতিহাসের অনিবার্য নায়ক হিসেবে দেখত। তাদের এমন ধারণা টিকিয়ে রাখতে তাদের প্রয়োজন বিরামহীন প্রশংসা ও প্রশ্নাতীত আনুগত্য। শেখ হাসিনার শাসনকালে রাষ্ট্রে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার কর্তৃক এমনি সব ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ছিল, তাকে ‘উন্নয়নের রূপকার’ গণতন্ত্রে মানসকন্যা’ সেই সাথে ‘মানবতার মা’ এভাবে নানা বিষয়ে মহামান্বিত করা। সেই সাথে চাটুকার কিছু সাংবাদিক তাকে প্রশংসার বাণে ভাসিয়ে দিতেন।

শেখ হাসিনা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কখনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন না। বিশেষ করে অপর দুই দল জামায়াত-বিএনপিকে ষড়যন্ত্রকারী ও বিশ্বঘাতকতার প্রতীক হিসেবে তার মন-মগজে স্থায়ীভাবে প্রোথিত ছিল। আর সে জন্য দুই দলের ওপর চলেছে অবিরাম অত্যাচার-অবিচার, জেল, জুলুম-নির্যাতন। এখন ভাবতে হবে, আত্মঅনুসন্ধান করতে হবে, দেশের জন্য তারা এখন কী চান। আত্মহনন নাকি আত্মবিকাশ।

[email protected]