বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ কিছু বিষয় সংবেদনশীল। এসব বিষয় নিয়ে কথা বললে যাচিত অথবা অযাচিতভাবে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে। সংবেদনশীল এসব বিষয়ের মধ্যে রয়েছে- ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় নেতৃত্ব ও ছাত্ররাজনীতি। ইসলাম আমাদের নিরঙ্কুশ জনগোষ্ঠীর জীবনবোধ। মুক্তিযুদ্ধ এ জাতির অস্তিত্বের সাথে জড়িত বিষয়। জাতীয় নেতৃত্বের প্রতি আমাদের ভালোবাসা এতটাই তীব্র যে, পক্ষে কিংবা বিপক্ষে মন্তব্য করলে তোলপাড় শুরু হয়। এমনি আরেকটি বিষয় ছাত্ররাজনীতি। নীতিগতভাবে ছাত্ররাজনীতিকে স্বাভাবিক মনে করেন না, বৈধতা দিতে চান না এবং পারলে নিষিদ্ধ করেন- এ রকম লোকের সংখ্যা স্বল্প হলেও গুরুত্বপূর্ণ। মনে পড়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কথা।
বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে যেসব ব্যক্তি নিরাসক্তভাবে, রাজনীতিনিরপেক্ষভাবে এবং শুধু দেশপ্রেমসঞ্জাত প্রেরণা থেকে রাষ্ট্রিক স্বার্থে কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন একজন পুরোধা পুরুষ। তিনি সেই ব্যক্তি যিনি ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করার পর ‘নির্বাচন বাতিল’-এর আওয়ামী আবদার অগ্রাহ্য করেছিলেন। তারা তাকে বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত করেছিল। তারা এতই পীড়ন করেছিল তাকে যে, সেই কম কথার মানুষটি অবশেষে একটি বিবৃতি দিয়ে জনসম্মুক্ষে সেই তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধকরণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশের অতিমাত্রিক রাজনৈতিক অঙ্গনে এটি ছিল একটি সাহসী পদক্ষেপ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্রনির্ভরতা একটি বাস্তব সত্য কথা। সাহাবুদ্দীনের বিবৃতিটি বিদ্বজ্জনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। প্রধান দু’টি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এ বিষয়ে শর্ত দিয়েছিল যে, একদল যদি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়টি মেনে নেয়, তাহলে অন্য দলও মেনে নেবে। সুতরাং যা হওয়ার তাই হয়েছে।
সাহাবুদ্দীন সাহেব চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। ওসমানী মিলনায়তনে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দীন নিজে উপস্থিত ছিলেন। ভিসিরা ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছিলেন। বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রীকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। সেখানে প্রায় সবাই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলছিলেন। বিপুল করতালির মধ্যে নিষিদ্ধের প্রস্তাবনা সমাদৃত হচ্ছিল। কিন্তু বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসিরা হিসাব কষে কথা বলছিলেন। সবাই ছাত্রনেতাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে ইনিয়ে-বিনিয়ে ছাত্ররাজনীতির পক্ষেই কথা বলছিলেন। সত্য কথাটি বলতে তারা নারাজ ছিলেন। কারণ ক্ষমতা সবাইকে মোহগ্রস্ত করে। পরে ইধহমষধফবংয ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঝঃৎধঃবমরপ ঝঃঁফরবং-ইওওঝঝ মিলনায়তনে আরেকটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে শুধু ছাত্রনেতারাই বক্তব্য রাখেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা বিষয়টিকে সাদা চোখে দেখেননি। এর পেছনে ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন তারা। দুটো সেমিনারেই আমার অংশগ্রহণ ছিল। আমি লিখে, বলে ও জনমত গঠন করে বিষয়টির সপক্ষে অবদান রাখার চেষ্টা করেছিলাম।
সন্দেহ নেই, এই বাংলাদেশী জাতির ইতিহাস নির্মাণে ছাত্রসমাজের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। এই গৌরবময় ইতিহাস সত্তে¡ও ১৯৭১ সালের পর বিগত অর্ধশতাব্দীর ইতিহাস যদি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে- এই রাষ্ট্রব্যবস্থাটিই যেমন স্বাভাবিকভাবে চলেনি! ঠিক তেমনি যুব তথা ছাত্রসমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করা হয়নি। ১৯৭২ সালে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। এটি ছিল বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের একটি ইতিবাচক ঘটনা। যারা ওই আদর্শের সমর্থক নয়, তাদের চোখেও এটি নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থার উদাহরণ হিসেবেই গৃহীত হয়েছিল; কিন্তু শাসক দলের রোষানলে পড়তে হয় তাদের। ১৯৭৪ সালের ১ জানুয়ারি ভিয়েতনাম যুদ্ধের পক্ষে এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে ছাত্র ইউনিয়ন একটি বিক্ষোভের আয়োজন করে। তোপখানা রোডে প্রেস ক্লাবের বিপরীতে তখন মার্কিন তথ্যকেন্দ্র ছিল। সেখানে বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে ছাত্র ইউনিয়নের মতিউর-কাদের নামে দু’জন স্কুলশিক্ষার্থী নিহত হয়। প্রতিবাদে ডাকসুর ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম পল্টন ময়দানে শেখ সাহেবের বিপক্ষে কিছু কঠিন কথা বলে ফেলেন। এর ফলাফল হয় জঘন্য। ছাত্রলীগের ছেলেরা ছাত্র ইউনিয়নের ওপর এমনভাবে চড়াও হয় যে, ক্ষমা প্রার্থনা করে অস্তিত্ব রক্ষা করতে হয়। সেই যে তারা আওয়ামী ঘরানায় উঠলেন পরবর্তীকালে ত্রি-দলীয় ঐক্যজোট করে পতন না হওয়া পর্যন্ত তাঁবেদারি বজায় রাখলেন। ’৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচনে ‘জাসদ’ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ প্যানেল দেয়। এতসব করেও বিপর্যয় ঠেকানো যায়নি। ‘জাসদ’ ছাত্রলীগের নিশ্চিত বিজয়কে বানচাল করার জন্য ব্যালট বাক্স ছিনতাই করা হয়। শেখ কামালের নেতৃত্বে এই সুকর্মটি করা হয়! এই কলামিস্ট এসব ঘটনার প্রত্যক্ষ নীরব সাক্ষী। ছাত্ররাজনীতিকে সঠিকভাবে যে পরিচালিত করা হয়নি তা বলার চেষ্টা করছি আমরা। সে সময়ে জাসদ ছাত্রলীগ অপ্রতিরোধ্য জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাদেরকে অন্যায়-অত্যাচার করে অবদমন করা হয়। ১৯৭৪ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাওকালে নৃশংসভাবে গুলি বর্ষণ করা হয়। জাসদের অভিযোগ- রক্ষীবাহিনীর হাতে তাদের ৪০ হাজার নেতাকর্মী প্রাণ দেন।
তখন গুম শব্দটির প্রচলন হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধরে নিয়ে গিয়ে এদেরকে হত্যা করা হয়। পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু হলে চড়ষরঃরপধষ চধৎঃু জবমঁষধঃরড়হ-চচজ-এর আওতায় ছাত্ররাজনীতিকে অনুমোদন দেয়া হয়। জিয়াউর রহমান ব্যক্তিগতভাবে ছাত্ররাজনীতির অনুকূলে ছিলেন না। যেহেতু ছাত্ররাজনীতি চলমান আছে, সেটির বৈধতা দেয়া এবং বিরোধী রাজনীতির মোকাবেলার বাস্তবতায় ছাত্ররাজনীতিকে গ্রহণ করা হয়। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল গঠনের প্রাক্কালে জিয়াউর রহমান নিজেই ছাত্ররাজনীতির তত্ত¡াবধান করতেন। যেখানে তিনি বিদ্যায়তনিক ব্যতিক্রম দেখেছেন, সেখানেই ব্যবস্থা নিয়েছেন। জিয়াউর রহমান সম্পর্কে একজন অনসন্ধিৎসু গবেষক হিসেবে এসব তথ্য নিশ্চিত করা যায়। এরশাদ সাহেবও প্রথম দিকে ছাত্রসংগঠন করতে রাজি ছিলেন না। পরে রাজনীতিবিদরা বিরোধীদের মোকাবেলায় ছাত্রসংগঠনের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সক্ষম হন। সে সময়ের ছাত্রসংগঠন ‘জাতীয় ছাত্র সমাজ’ সন্ত্রাস, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও ঠ্যাঙ্গারু বাহিনী হিসেবে গণ-অভ্যুত্থান ঠেকানোর চেষ্টা করে। অবশেষে তারা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়।
আওয়ামী লীগ কোনো সময় কোনোকালে জনভিত্তিক বা জনসমর্থিত রাজনৈতিক দল ছিল না। তাদের শাসনের উৎস ছিল জবরদস্তিমূলক ক্ষমতা (ঈড়বৎপরাব চড়বিৎ)। আর এর প্রধান হাতিয়ার ছিল ছাত্রলীগ। বিগত ১৬ বছরে তারা যে অন্যায়-অনাচার, নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়েছে, সেটি কাউকে বলে কয়ে প্রমাণ করতে হবে না। এ দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তাদের সে নির্মমতার ইতিহাস বিস্তৃত। তারা ছাত্রলীগকে ফ্যাসিস্টদের মতো দমন-পীড়নের সরকারি হাতিয়ারে পরিণত করেছিল। মানুষ বলে ‘যাহাতে উৎপত্তি তাহাতে ক্ষয়’। যে ক’দিন টিকে ছিল ছাত্রলীগের মতো হেলমেট বাহিনী দ্বারাই টিকে ছিল। আপনাদের মনে করিয়ে দিই কাউয়া কাদেরের সেই দম্ভোক্তি- ‘এদের মোকাবেলার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট’। এত কথা দ্বারা আমরা প্রমাণ করার চেষ্টা করছি যে, ছাত্ররাজনীতি বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনোই সুন্দর ও সুখকর ছিল না।
এখন ছাত্ররাজনীতি নিয়ে বিরাজমান সংবেদনশীলতা অতিক্রম করে কথা বলতে হবে। কারণ চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি নতুন ধারা, একটি নতুন ইতিহাস ও একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মিত হতে যাচ্ছে। জুলাই ঘোষণাপত্র, জাতীয় সনদ, রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং সার্বিক সংস্কারের মাধ্যমে একটি নতুন অধ্যায় রচিত হতে যাচ্ছে। ছাত্র-জনতার রক্তে এক ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান ঘটে গেল। সে দিন থেকে বাংলাদেশের সচেতন নাগরিক সমাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন রাখছে। যে ছাত্ররাজনীতি ক্যাম্পাসে ছাত্রদের ভ্যানগার্ড থাকার পরিবর্তে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই রাজনীতির বৈধতা আছে কি না সেই প্রশ্ন উঠছে সবখানে। এসব বিবেচনা করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সচেতন মহলে প্রচলিত ধারার ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের রব উঠেছে। ২০১৯ সালে বুয়েটের আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই মূলত দেশের নাগরিকরা এ দাবিতে সোচ্চার। এ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে এক জরিপে বুয়েটের ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে মত দেন। (ইনকিলাব, ৪ এপ্রিল ২০২৪) অভ্যুত্থানের পর থেকে গণমাধ্যমে যে মতামত, পর্যবেক্ষণ ও সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায়, দেশের গরিষ্ঠ জনসাধারণ এবং সাধারণ ছাত্রসমাজ লেজুরবৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে। ইদানীং রাজনীতির ঘনঘটায় বিষয়টি সরব নেই। জাতীয় ঐকমত্যের ঘোষণা, জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা এবং ঘোষিত ডাকসু, জাকসু ইত্যাদি নির্বাচনকে সামনে রেখে বিষয়টি আবার জনসাধারণ্যে গুরুত্ব পাচ্ছে। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান তো দেশের মানুষের চোখে আর একবার আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের ক্যাম্পাসগুলোতে প্রচলিত ছাত্ররাজনীতি এখন আর দেশের জন্য আশীর্বাদ নয়; বরং তা অভিশাপ। বিবেকবান মানুষেরা বারবার আহ্বান জানাচ্ছেন, দেশের প্রচলিত লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে প্রত্যেকটি ক্যাম্পাসের ছাত্রসংসদ সক্রিয় করতে- যাতে ছাত্ররা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত হয়ে সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করতে পারে। বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে।
জুলাই বিপ্লবের প্রথম দিকে বিষয়টি নিয়ে যখন ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা চলছিল তখন অন্তর্র্বর্তী সরকার বলেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে ঠিক করা হবে, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির কাঠামো কেমন হবে। বিএনপি মহাসচিব তখন বলেছিলেন, তারা জাতীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি চলুক, সেটিই চান। কিন্তু ছাত্রসংগঠনগুলো এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের দাপুটে কার্যক্রম চালু করেছে। বর্তমানে বড় তিনটি রাজনৈতিক দল চাচ্ছে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি চালু থাকুক; কিন্তু আমার মতো অনেক লোকের প্রশ্ন, অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার সবকিছু করলেও লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির দায় অনুভব করছে না কেন?
২১ আগস্ট ২০২৪ একটি জনপ্রিয় দৈনিকে প্রকাশিত জরিপে জানা যায়, ৯৩ শতাংশ মানুষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন। ফেসবুকে পরিচালিত এই জরিপে প্রায় ৩.৫ লাখ মানুষ অংশ নেন। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ আরেকটি অনলাইন জরিপের সূত্রে দাবি করা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ৮৩ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি ‘একেবারেই নিষিদ্ধ’ চান এবং ৮১ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী নিয়মিত ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন’ দেখতে চান। (সমকাল, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪) এ তথ্য থেকে এটি বলা যায়, ঢাবি শিক্ষার্থীদের চার-পঞ্চমাংশের বেশি শিক্ষার্থী জাতীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিকারী ছাত্ররাজনীতি পছন্দ করেন না। অন্যত্র একটি গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থীই রাজনীতির বিরুদ্ধে। ৯৬ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন, দলীয় ছাত্ররাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। রাজনীতিবিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের রাজনীতিবিমুখতার পেছনে ১৬ বছরে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনই বেশি দায়ী। গত এক বছরেও ছাত্ররাজনীতি নিয়ে ক্যাম্পাসে হানাহানি ঘটেছে।
গত ২৯ জুলাই ডাকসু নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশে জাতীয় সংসদের পর ‘মিনি সংসদ’ হিসেবে কথিত এই নির্বাচনকে জাতীয় রাজনীতির ব্যারোমিটার হিসেবে গণ্য করা হয়। একইভাবে রাকসু ও জাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতি চূড়ান্ত হয়েছে। চাকসু নির্বাচনের কথাও শোনা যাচ্ছে। সবমিলিয়ে সব ক্যাম্পাসে একটি নির্বাচনী আবহাওয়া তৈরি হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় যে, লেজুরবৃত্তিক রাজনীতি পরিহার করে স্বাধীন ও স্বকীয় ধারার যে রাজনীতির সূচনা হওয়ার কথা- সেটি এখন আর দৃশ্যমান হচ্ছে না। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন হিসেবে পরিচিতি দিয়ে এসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এটি ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান চেতনার বিপরীত।
উপর্যুক্ত আলোচনা, মতামত, পরিসংখ্যান ও গবেষণা প্রমাণ করে, সাধারণ ছাত্রসমাজ রাজনৈতিক পরিচয়ের মাধ্যমে ক্যাম্পাসকে আবার আগের মতো অস্থির দেখতে চায় না। যেখানে যে ছাত্রসংগঠন শক্তিশালী তারা শক্তির মহড়া দিতেই ব্যস্ত। বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ক্যাম্পাসে শক্তিশালী। অপর দিকে, জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরও ক্যাম্পাসে প্রভাবশালী। এনসিপির ছাত্রসংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ জনপ্রিয়তার প্রমাণ দিচ্ছে। সাধারণ ছাত্ররা এই ত্রিমুখী প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নিজেদেরকে অসহায় মনে করছে। ভবিষ্যৎ নির্বাচনে ক্ষমতার দাবিদার এই তিনটি সংগঠন। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার স্বার্থে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বহাল রাখতে চায় এবং যেহেতু সাধারণ ছাত্ররা লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি প্রত্যাখ্যান করছে, অন্তর্র্র্বর্তীকালীন সরকারের উচিত লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার জন্য আইনগত ও নির্দেশনামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার যেহেতু একটি নিরপেক্ষ সরকার, তারাই পারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে। তারা যদি চায় ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে আবার ছাত্রলীগের উদয় না হোক, তাহলে তাদের দ্বিধাদ্ব›দ্ব ও সংবেদনশীলতা অতিক্রম করে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এখনই সময়।
লেখক : অধ্যাপক (অব:), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়