চট্টগ্রাম বন্দরে এনবিআর-কাস্টমস জটিলতা

দেশের অর্থনীতির প্রধান প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরে দীর্ঘদিন ধরে চলমান ভয়াবহ আর্থিক ও পরিচালনগত সঙ্কট সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য সূত্রে অবগত।

দেশের অর্থনীতির প্রধান প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরে দীর্ঘদিন ধরে চলমান ভয়াবহ আর্থিক ও পরিচালনগত সঙ্কট সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য সূত্রে অবগত। এ নিবন্ধ লেখার অন্যতম কারণ হলো, দুই দশক আগে শুল্ক বিভাগে কাজ করার সময় আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, সঠিক নীতি ও সময়মতো সিদ্ধান্ত কিভাবে রাজস্ব আয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে সে বিষয়টি তুলে ধরা। একইভাবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা একটি দেশের পুরো অর্থনৈতিক প্রবাহকে কিভাবে স্থবির করে দিতে পারে, তা দীর্ঘ দুই দশক আগেই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি।

প্রকৃত বাস্তবতা হলো, চট্টগ্রাম বন্দরে আজ যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে, তার মূলে রয়েছে শুল্ক বিভাগের দীর্ঘস্থায়ী আমলাতান্ত্রিক জট, কাজে ধীরগতি ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি প্রয়োগ। ফলে চট্টগ্রাম বন্দর কার্যত পঙ্গু হয়ে পড়েছে। পরিণতিতে জাতীয় রাজস্ব আহরণের সক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমছে। কৌশলগত ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের দিক থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের এই অচলাবস্থা শুধু বন্দরের সঙ্কট নয়, এটি জাতীয় অর্থনীতির শ্বাসরোধের নামান্তর।

উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপও যেখানে ব্যর্থ

গত ১৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভার ৭.১ নম্বর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বন্দরের অপারেশন ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং দ্রুত স্বাভাবিক করতে প্রয়োজনীয় আইন সংস্কার প্রস্তাব চেয়ে এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয়া হয়। সর্বোচ্চ পর্যায়ের এমন নির্দেশনার পরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। এ থেকে বোঝা যায়, সঙ্কটটি কেবল টেকনিক্যাল নয়, এটি একটি গভীর প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।

অতীত ভুল থেকে শিক্ষা : নীতিহীনতার ভয়াবহ মূল্য

বাংলাদেশ অতীতে নীতিহীনতার যে অভিশাপ ভোগ করেছে, তার একটি বড় উদাহরণ মোবাইল লাইসেন্স নীতি। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার চারটি মোবাইল কোম্পানিকে মাত্র ৩৬ কোটি টাকায় লাইসেন্স দেয়। অথচ একই সময়ে পাকিস্তান চারটি মোবাইল কোম্পানির কাছ থেকে সাত হাজার ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে। যেখানে বাংলাদেশের ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরের বাজেট ছিল ২৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, তার প্রায় এক-পঞ্চমাংশের সমপরিমাণ অর্থ হারিয়ে যায় শুধু ভুল নীতির কারণে। পরে আমার একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করেন। সেই সাথে জাতীয় সংসদে এক বক্তৃতায় তিনি স্বীকার করেন, ‘শুধু অজ্ঞতা, উদাসীনতা ও স্বার্থান্বেষীদের কারণে আমরা মোবাইল লাইসেন্স ফি থেকে বিপুল রাজস্ব হারিয়েছি।’ (২০০৫ সালের ৩০ জুন প্রথম আলো, নয়া দিগন্ত, দ্য ডেইলি স্টারসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়)। এটি শুধু একটি উদাহরণ নয়, এটি প্রমাণ যে, সঠিক নীতি ও দেশাত্মবোধক জ্ঞান ছাড়া রাষ্ট্রীয় পলিসি কীভাবে আত্মঘাতী হতে পারে।

২০ বছরের নিলামের জট : বন্দরের রক্তক্ষরণ

চট্টগ্রাম বন্দরে সবচেয়ে ভয়াবহ সঙ্কট হলো নিলামযোগ্য কনটেইনারের পাহাড়সম জট। বহু বছর ধরে শুল্ক বিভাগ ও বন্দর কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতায় নিলামপ্রক্রিয়া প্রায় বাক্সবন্দী অবস্থায় পড়ে আছে। উদ্বেগজনক বাস্তবতা হলো, নিলামযোগ্য কনটেইনার : ১০ হাজার ২২৫ টিইইউএস বন্দরের মোট ধারণ ক্ষমতার ২০-২২ শতাংশ জায়গা দখল করে আছে। এই আটকে থাকা জায়গার অর্থমূল্য প্রায় সাত শ’ কোটি টাকা। এতে স্টোর রেন্ট হারানোয় দৈনিক ক্ষতি হচ্ছে ৩ দশমিক ৫ কোটি টাকার। শুধু তাই নয়, বহু বিপজ্জনক পণ্যবাহী ডিজি কার্গো কনটেইনার বছরের পর বছর পড়ে আছে। সিপিএর হিসাব অনুযায়ী, বর্তমান গতিতে এ জট দূর করতে সময় লাগবে ২০ বছর। তাই এ কথা বলা অন্যায় হবে না, একটি দেশের প্রধান বাণিজ্য প্রবেশদ্বারের নিলাম-প্রক্রিয়া যদি ২০ বছরেও শেষ না হয়, এটি শুধু অদক্ষতা নয়, এটি প্রশাসনিক ব্যর্থতার চরম নজির। অথচ দক্ষতা বাড়িয়ে অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। বন্দরের কর্মক্ষমতা কমার আরেকটি বড় কারণ কাস্টমসের পুরনো ও অকার্যকর পরিচালন ব্যবস্থা।

প্রধান বাধা

এফসিএল (ফুল কনটেইনার লোড) কনটেইনারের প্রায় ৭০ শতাংশ এখনো বন্দর অভ্যন্তরে ডেলিভারি নিতে হয়, যা অপারেশনাল দক্ষতা ৪০ শতাংশ কমিয়ে দেয়। শতভাগ স্ক্যানিংয়ের জটিল নীতি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা ৪৭৫টি গাড়ি গুরুত্বপূর্ণ ইয়ার্ড স্পেস দখল করে আছে। যদি প্রি-অ্যারাইভাল প্রোসেসিং (পিএপি) বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে সিপিএর মূল্যায়ন অনুযায়ী বন্দর হ্যান্ডলিং সক্ষমতা কমপক্ষে ৩০ শতাংশ সহজে বাড়ানো যায়। সেই সাথে বছরে কমপক্ষে ৪০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব পাওয়া সম্ভব হবে। পাশাপাশি নতুন অবকাঠামো নির্মাণে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ব্যয় সাশ্রয় হবে।

বর্তমান নেতৃত্ব ও বন্দরের সমস্যা সমাধানের প্রত্যাশা

নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি- নির্ভুল নীতি, দক্ষ নেতৃত্ব ও দেশাত্মবোধ ছাড়া রাষ্ট্র বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ে। অতীতে শুল্ক বিভাগে ডেপুটেশনে থাকাকালীন কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছিলাম, যার মধ্যে সিমভিত্তিক ট্যাক্স উদ্যোগ ছিল অন্যতম। এ উদ্যোগে রাষ্ট্র প্রায় আট হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আহরণের সুযোগ পায়, যা ২০০৪-০৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশের সমতুল্য। এই অভিজ্ঞতার প্রতিফলন পাওয়া যায় দৈনিক আমার দেশে প্রকাশিত ‘সিমভিত্তিক ট্যাক্স, আট হাজার কোটি : দূরদর্শিতার রূপকার এনবিআর’ এবং নয়া দিগন্তে প্রকাশিত ‘জেগে উঠুক এনবিআর’ নিবন্ধে। এই অভিজ্ঞতা শিখিয়েছে, দৃঢ়সিদ্ধান্ত নিতে হলে পলিসি জানতে হবে, বাস্তবতা বুঝতে হবে। এ ছাড়া সবচেয়ে বড় কথা, রাষ্ট্রের অর্থ সুরক্ষায় দেশপ্রেম থাকতে হবে।

বর্তমান এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খানকে একজন আধুনিক চিন্তার সংস্কারক বলা হয়। তিনি অটোমেশন, মানবসম্পদ পুনর্বিন্যাস এবং রাজস্ব নীতি ও প্রশাসন পৃথকীকরণের মাধ্যমে এনবিআরকে একটি কার্যকর ও স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে কাজ করছেন। আইএমএফের পরামর্শ ও সরকারের নীতিগত অঙ্গীকারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এসব উদ্যোগ রাজস্ব খাতকে নতুন যুগে প্রবেশ করাচ্ছে। নিঃসন্দেহে জাতির প্রত্যাশা এখন তার দিকে, চট্টগ্রাম বন্দরের স্থবিরতার এই দীর্ঘ অচলায়তনের অবসান যেন তার নেতৃত্বে হয়।

সমাধানের পথ : অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে ঐতিহাসিক সুযোগ

বছরের পর বছর রাজনৈতিক সরকারগুলোর সময় প্রশাসনিক অদক্ষতা ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বন্দরের সঙ্কট বাড়িয়েছে। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে একটি বিরল সুযোগ এসেছে, রাজনৈতিক লাভক্ষতির বাইরে গিয়ে কঠোর, দ্রুত ও রাষ্ট্রমুখী সিদ্ধান্ত নেয়ার।

জরুরি করণীয়

বন্দর ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা করা। যাতে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও কাস্টমসের মধ্যে দীর্ঘদিনের সঙ্ঘাত নিরসনে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন তিনি। সময়সীমা বাধ্যতামূলক করে বিপজ্জনক পণ্য দুই দিনের মধ্যে এবং পচনশীল পণ্য চার দিনের মধ্যে নিলাম করার উদ্যোগ নেয়া দরকার। একই সাথে পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন ও নীতি সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই সাথে কাস্টমস-বন্দর সমন্বয় কাঠামোকে আইনগত শক্তি দেয়া আবশ্যক। নিলামপ্রক্রিয়া মাসভিত্তিক মূল্যায়ন করা এবং দায় নির্ধারণ করাও প্রয়োজন। চট্টগ্রাম বন্দর জাতির অর্থনৈতিক ফুসফুস। এই ফুসফুস আজ শ্বাসরোধ অবস্থায় রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সাহসী সিদ্ধান্ত পারে এই বন্ধ গলিপথ খুলে দিতে।

লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও উপউপাচার্য, বিইউপি