ঢাকা ও চট্টগ্রাম দেশের দু’টি প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র। ঢাকা সবচেয়ে বড় শহর, এর পরেই চট্টগ্রামের অবস্থান। উন্নত জীবন যাপনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা এই দু’টি শহরেই বেশি বিদ্যমান। শহর দু’টিতে অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকা এবং আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে। নাগরিক সুবিধা প্রদানে দুই শহরেই সিটি করপোরেশন ও ওয়াসা রয়েছে। অবকাঠামো উন্নয়নে ঢাকায় আছে রাজউক ও চট্টগ্রামে সিডিএ। অথচ জলাবদ্ধতা এখনো শহর দু’টির অন্যতম সমস্যা। জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও শহর দু’টি এখনো জলাবদ্ধতামুক্ত হয়নি। একটু ভারী বৃষ্টিপাত হলেই দুই শহরের অনেক রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে যায়। রাস্তার পাশে বিদ্যমান দোকানপাটে এবং বসতবাড়ির নিচতলায় পানি ঢুকে যায়। এসব পানি ময়লাযুক্ত ও নোংরা। পানির পাম্প এবং মোটরগুলো পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে যায়। বাড়ির নিচতলায় বিশুদ্ধ পানির ট্যাংকিতে ময়লা পানি ঢুকে তা পানের অযোগ্য হয়ে যায়। রাস্তায় পানি জমায় যানবাহনের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হয় এবং যানজটের সৃষ্টি হয়। নাগরিক জীবনে তখন অবর্ণনীয় যন্ত্রণা নেমে আসে। তাই শহর দু’টি থেকে জলাবদ্ধতা দূর করতে হবে। তার জন্য নগরীর ড্রেনগুলো সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে এবং আধুনিক ড্রেনেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে।
পানি ছাড়া জীবন চলে না, তাই পানির অপর নাম জীবন। যেখানে পানি, সেখানেই জীবনের সৃষ্টি। যেখানে জীবন সেখানেই পানির ব্যবহার। জলাবদ্ধতা মানে রাস্তাঘাটে, মাঠে ময়দানে পানি জমে খাকা। শহুরে জীবনের প্রতিদিনের ব্যবহৃত এবং বৃষ্টির পানি খাল-নদী-সাগর-মহাসাগরে যাওয়ার জন্য প্রতিটি এলাকায় এবং রাস্তার পাশে ড্রেন নির্মাণ হয়েছে। ঘরবাড়ি, অফিস আদালত, বিপণি বিতান, রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ প্রতিটি স্থাপনায় প্রতিদিন প্রচুর পানি ব্যবহার হয়। বাড়িতে দৈনন্দিন নানা কাজে, বাথরুমে, গোসলে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায়, রান্নাঘরে প্রতিদিন প্রচুর পানি ব্যবহার হয়। এই পানি বিল্ডিং থেকে ড্রেনে, তারপর ড্রেন থেকে নালা-খালে, খাল থেকে নদীতে এবং নদী থেকে সাগরে যায়। শহরের প্রতিটি এলাকার বৃষ্টির পানিও একইভাবে নদী হয়ে সাগরে যায়। শহরের পানি নিষ্কাশনের জন্য এভাবেই ড্রেনেজ সিস্টেম গড়ে তোলা হয়েছে। নদী-সাগর-মহাসগর সবই প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এবং পানির ধারক-বাহক। এরা প্রত্যেকেই একে-অপরের সাথে সংযুক্ত। এসব দিয়েই এক দেশের পানি অন্য দেশে যায় এবং অন্য দেশের পানি আমাদের দেশে আসে। এই পানিই আবার পানিচক্রের মাধ্যমে বাষ্পীভূত হয়ে আকাশে যায় এবং মেঘ হয়ে বৃষ্টি হয়ে ভূপৃষ্ঠে পড়ে। স্বাভাবিক সময়ে মানুষের নিত্য ব্যবহৃত পানি ড্রেন হয়ে নালা-খালে-নদীতে চলে যায় এবং কোনো জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় না। মানুষের ব্যবহৃত পানির পরিমাণ প্রায় নির্দিষ্ট থাকে এবং তা বহনে ড্রেনগুলো সক্ষম। কিন্তু বর্ষাকাল অথবা অন্য সময়ে বেশি বৃষ্টি হলে, তা বহনের ক্ষমতা ড্রেনগুলোর থাকে না। এই সময় হঠাৎ করে অনেক পানি ভূপৃষ্ঠে পতিত হওয়ায় ড্রেনের ওপর বিরাট চাপের সৃষ্টি হয়। কয়েক দিনের বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। এই পানি দ্রুত সময়ে ড্রেন হয়ে নালা-খালে-নদীতে চলে যেতে পারে না এবং তখনই পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
দীর্ঘ দিন থেকেই ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের প্রায় প্রতিটি বড় শহরেই জলাবদ্ধতা স্থায়ী সমস্যার রূপ নিয়েছে। একটুখানি বৃষ্টি হলেই শহরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তখন যানজট আরো বেড়ে যায় এবং নাগরিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সুতরাং এসব শহর জলাবদ্ধতামুক্ত করা জরুরি। তার জন্য প্রতিটি শহরেই পরিকল্পিত ড্রেনেজ ও পয়ঃনিষ্কাশন সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে এবং নিয়মিতভাবে এসব ড্রেনেজগুলো পরিষ্কার করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি সব স্তরের জনগণকে সচেতন এবং দায়িত্ববান হতে হবে। আমরা পলিথিন, প্লাস্টিক বোতল, ছেঁড়া কাপড় ও ময়লা-আবর্জনা নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে না ফেলে যত্রতত্র ফেলি, যা শেষ পর্যন্ত ড্রেনগুলোতে গিয়ে পড়ে। ফলে ড্রেনগুলো ময়লা-আবর্জনায় ভরাট থাকে। বৃষ্টির পানি ড্রেন দিয়ে স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারে না এবং পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। জলাবদ্ধতা নিরসনে তাই ড্রেনগুলো সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে এবং কোনো অবস্থাতেই ড্রেনে ময়লা-আবর্জনা ফেলা যাবে না।
শহরগুলোর মাঝখানে অনেক খাল রয়েছে, যেগুলো প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। এসব খাল পুনর্খনন করতে হবে। শহরে বিদ্যমান পুকুর, লেক ও জলাশয় ভরাট করা যাবে না। পরিকল্পিত ড্রেনেজ এবং পয়ঃনিষ্কাশন নিশ্চিত করেই ঘরবাড়ি এবং হাইরাইজ বিল্ডিং নির্মাণ করতে হবে। হাউজিং কোম্পানিগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় কোড অব কন্ডাক্ট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য রাজউক, সিডিএসহ স্থানীয় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে কাজ করতে হবে। প্রতিটি বড় শহরই কোনো না কোনো নদীর তীরে অবস্থিত। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা এসব নদী খনন এবং নদীর তীর দখল বন্ধ করতে হবে। ভরাট হয়ে যাওয়ায় এসব নদী বেশি পানি বহন করতে পারছে না।
সরকারি হিসাবে ঢাকা শহরে ২৩টি খাল থাকলে ও বাস্তবে এসবের অস্তিত্ব নেই। বহু আগেই ভরাট হয়ে গেছে। এসব খাল খনন করে তার সাথে ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংযোগ ঘটাতে হবে, যাতে সহজেই ড্রেন থেকে পানি খালে আসতে পারে। খালগুলোর সাথে আবার নদীর সংযোগ ঘটাতে হবে। তাহলে নগরীর পানি ড্রেন হয়ে খালে এবং খাল হয়ে নদীতে চলে যাবে। এভাবেই পরিকল্পিত ড্রেনেজ সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য সিটি করপোরেশন বিশেষ পরিকল্পনা নিতে হবে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় ড্রেনেজ ম্যানেজমেন্ট কার্যক্রম প্রতিনিয়ত সক্রিয় ও কার্যকর রাখতে হবে, যাতে খালগুলো নিয়মিত খনন এবং পানির প্রবাহ ঠিক রাখা যায়। শহরের আশপাশের নিম্নাঞ্চলগুলো ভরাট করে হাউজিং কোম্পানি কর্তৃক আবাসিক এলাকা তৈরির কারণে শহরের পানি ঠিকমতো নামতে পারছে না। এসব সমস্যা সমাধান করে পরিকল্পিত শহর গড়ে তুললেই কেবল জলাবদ্ধতা কমবে এবং জলাবদ্ধতামুক্ত শহর প্রতিষ্ঠা করা যাবে। বাড়িঘর, আবাসিক এলাকা ও রাস্তা-ব্রিজ যা-ই নির্মাণ করি না কেন, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা আগে নিশ্চিত করতে হবে।
এই পৃথিবীই আমাদের বাসস্থান, এখানেই আমাদের বাস করতে হবে। এই পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা মানবজাতির কাছে নেই। সুতরাং এই পৃথিবীকে আমাদের স্বার্থেই বসবাসের উপযোগী রাখতে হবে। তার জন্য পরিকল্পিত শহর গড়তে হবে। প্রবাদ আছে, স্রষ্টা গ্রাম আর মানুষ শহর সৃষ্টি করেছে। আমাদেরকেই এসব শহরকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। তার জন্য সুন্দর এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। এসব শহরকে বিপর্যয়ের হাত থেকে আমাদেরকেই রক্ষা করতে হবে। এ জন্য নগর বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে সুচিন্তিত এবং সুনির্দিষ্ট পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক



