কেনাকাটার উদ্দেশ্যে কলকতায় যাওয়া আর নয়

ভারত থেকে আমরা যেসব পোশাক-পরিচ্ছদ ক্রয় করি এর সবগুলো দেশে উৎপন্ন করা সম্ভব। আমরা নিজেদের দেশ থেকে এসব পণ্য ক্রয়ে আগ্রহী হলে আমাদের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ ও উৎপাদনে আগ্রহী হবেন।

ভারতবর্ষ বিভাগের আগে কলকাতা অবিভক্ত বাংলার রাজধানী ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে ১০০ বছরের বেশি সময় রাজধানী হিসেবে কলকাতা ঘিরে তাদের শাসনকার্য পরিচালিত হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে কলকাতার সাথে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। বিগত শতকের দ্বিতীয় দশকে কলকাতায় বিমানবন্দর স্থাপিত হলে শহরটির সাথে বিশ্বের বিভিন্ন শহরের আকাশপথে যোগাযোগের সূত্রপাত ঘটে।

ব্রিটিশ শাসনামলে পূর্ব বাংলার আসাম, বিহার ও উড়িষ্যা প্রভৃতি অঞ্চলের জনসাধারণ শিল্পজাত ব্যবসায়িক পণ্যের জন্য সম্পূর্ণরূপে কলকাতার ওপর নির্ভরশীল ছিল। সে সময় এতদ অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে শহরটিতে বিভিন্ন কৃষিজাত পণ্যের বিপণনের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়।

ভারতবর্ষ বিভাগের আগে যদিও সিদ্ধান্ত হয়েছিল, মুসলিম ও হিন্দু জনসংখ্যা অধ্যুষিত প্রদেশ সমন্বয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দু’টি পৃথক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হবে; কিন্তু পরবর্তী সময়ে যেকোনো কারণে হোক, মুসলিম অধ্যুষিত বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাজিত করে প্রথমোক্তটির পশ্চিম ও শেষোক্তটির পূর্বাংশ ইন্ডিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই সাথে প্রথমোক্তটির পূর্ব ও শেষোক্তটির পশ্চিমাংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলে এটি পূর্ব পাকিস্তান নামে অভিহিত হতে থাকে। পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হলে বাংলাদেশ নামে এর আত্মপ্রকাশ ঘটে।

ভারতবর্ষ বিভাগের পর পশ্চিম বাংলা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কলকাতার ওপর নির্ভরশীলতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। এ ছাড়া বিগত শতকের ষষ্ঠ দশকে তা প্রায় শূন্যের কোঠায় পৌঁছে। পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে ঢাকার গুরুত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। একই সাথে ঢাকার আশপাশে বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে। পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের শাড়ি-কাপড়ের চাহিদা অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এবং পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ অর্থাৎ- পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানির মাধ্যমে মেটানো হতো; তবে কিছু উন্নত মানের কাপড় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও জাপান থেকেও আমদানি করা হতো।

পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হলে পুনঃব্রিটিশ শাসনামলের মতো এ দেশের মানুষের মধ্যে শাড়ি-কাপড়ের জোগানদাতা হিসেবে কলকাতা পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে। বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের উন্নত মানের শাড়ি-কাপড় প্রস্তুত হলেও দেশের একশ্রেণীর নাগরিকের ভারতীয় শাড়ি-কাপড়ের প্রতি প্রবল আগ্রহ লক্ষ করা যায়। এ শ্রেণীর নাগরিকরা প্রতি বছর এক বা একাধিকবার কলকাতায় গিয়ে তাদের পছন্দ অনুযায়ী শাড়ি-কাপড় কিনতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। আবার এমনও কিছু নাগরিক রয়েছেন; যারা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে কলকাতা থেকে শাড়ি-কাপড় কিনে ঢাকাসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরের বিভিন্ন শহরে বিক্রি করে থাকেন।

মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে বর্তমানে নির্ধারিত শুল্ক দিয়ে ভারত থেকে যেকোনো ধরনের শাড়ি-কাপড় আমদানি বৈধ হিসেবে বিবেচিত হলেও দেশের একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী বৈধভাবে আমদানির চেয়ে বেশি লাভের আশায় চোরাইপথে আনতে আগ্রহী। ঢাকার বিভিন্ন বিপণিবিতানে ভারতীয় শাড়ি-কাপড়ের আধিক্য। এর বেশির ভাগ যে অবৈধভাবে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকেছে, এটি কারো অজানা নয়।

ভারতের যেসব শাড়ি-কাপড় আজ আমাদের বাজার দখল করে রেখেছে, একই ধরনের শাড়ি-কাপড় উৎপাদনে আমরাও সক্ষম। একজন ক্রেতার পক্ষে কোনটি ভারতে উৎপাদিত, কোনটি বাংলাদেশী, তা নিরূপণ করা কঠিন। ক্রেতাদের এই দুর্বলতার সুযোগে অনেক অসাধু বিক্রেতা বেশি মুনাফার আশায় বাংলাদেশী শাড়ি-কাপড় ভারতীয় বলে বিক্রি করে ঠকাতে একটুও কুণ্ঠাবোধ করেন না।

বাংলাদেশ থেকে যেকোনো বয়সের নারী-পুরুষের ভারত যেতে হলে ভিসা গ্রহণের আবশ্যকতা রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন দুই সহস্রাধিক যাত্রী ভারতের পথে পাড়ি জমান। তাদের এক বিরাট অংশ বাস ও রেলে আসা-যাওয়া করেন। একটু অবস্থাপন্নরা আকাশপথে যেতে-আসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

বাংলাদেশের যেকোনো বেসামরিক নাগরিকের জন্য ভারতের ভিসাপ্রাপ্তি যতটা জটিল, বর্তমানে ইউরোপের যেকোনো দেশ বা আমেরিকার ভিসাপ্রাপ্তি ততটা জটিল নয়। ভারতের ভিসার জন্য বর্তমানে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। অনলাইনে আবেদনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, একজন প্রকৃত আবেদনকারী সারা দিন চেষ্টা করেও সাক্ষাতের তারিখ পেতে ব্যর্থ হচ্ছেন। কিন্তু যে মুহূর্তে দালালদের মাধ্যমে আবেদন করা হচ্ছে- দেখা যায়, সাক্ষাতের তারিখ পেতে কোনো অসুবিধা হয় না। দালালের মাধ্যমে অনলাইনে আবেদনের অর্থ যে যাত্রার তারিখের ক্ষেত্রভেদে দালালকে অবৈধ অর্থ প্রদান, এটি এখন আর কোনো রাখঢাকের বিষয় নয়। সাক্ষাতের তারিখ পাওয়ার পর ভিসার জন্য আবেদনপত্র জমা এবং পাসপোর্ট নেয়ার সময় দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে দেশের সাধারণ নাগরিক যেভাবে হয়রানির সম্মুখীন হন, তা সত্যি অস্বস্তিকর ও বেদনাদায়ক। ভারতের দূতাবাস কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক অবহিত করা হলেও তাদের পক্ষ থেকে এটি নিরসনে এখনো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

আমাদের দেশ থেকে তিন ধরনের নাগরিক ভারত যান। এর একটি হলো কেনাকাটার উদ্দেশ্যে, অপর দু’টির একটি ভ্রমণ; আরেকটি চিকিৎসা। ভ্রমণের উদ্দেশ্য যা-ই হোক, ভারতে পৌঁছার পর হয়রানি বা প্রতারণার শিকার হননি এমন যাত্রীর সংখ্যা খুব কম; তবে যারা একাধিকবার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন; তাদের হয়রানির বা প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা পূর্ব অভিজ্ঞতায় অনেকটা কম।

আকাশপথে যারা ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা যান তারা বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে এসে মুদ্রা পরিবর্তনে যদি দালালের দ্বারস্থ হন তবে অবশ্যম্ভাবীভাবে তাকে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। অনুরূপ শহরের কেন্দ্রস্থলে আসতে ট্যাক্সি ভাড়ার ক্ষেত্রেও দেখা যায়, অনভিজ্ঞ যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ হাতিয়ে নেয়ার প্রবণতা। মিটারে যেতে চাইলে সোজাপথ পরিহার করে দূরবর্তী পথ দিয়ে এমনভাবে নিয়ে যাওয়া হয়- যাতে দেখা যায়, আরোহীদের প্রকৃত ভাড়ার চেয়ে আরো ১০০-৩০০ রুপি বাড়তি গুনতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ থেকে যারা কলকাতার উদ্দেশে যান তাদের বেশির ভাগ নিউ মার্কেটের চতুর্দিকের এক-দু’কিলোমিটার দূরত্বের হোটেলে আবাসন গ্রহণ করেন। কাগজ-কলমে বিভিন্ন হোটেল ভাড়া নির্ধারিত থাকলেও দরকষাকষি করে ভাড়া কমানোর সুযোগ রয়েছে। দরকষাকষির সময় সরকারি ট্যাক্সের বিষয়টি সুরাহা করা না হলে হোটেল ছাড়ার সময় চূড়ান্ত বিল পরিশোধ করতে গেলে সরকারি ট্যাক্সের অর্থ পরিশোধে বাধ্য করা হয়, যা হোটেল মালিক বা তার অধীনস্থরা আত্মসাৎ করে থাকেন। কেনাকাটার সময় দেখা যায়, কিছু দোকানে একদাম (ফিক্সড প্রাইজ) এবং কিছু দোকানে দরকষাকষির সুযোগ আছে। একদামের দোকানে রুচিশীল পণ্য থাকলেও তার মূল্য তুলনামূলক বিচারে একটু বেশি। অন্য দিকে যেসব দোকানে দরকষাকষির মাধ্যমে মূল্য ঠিক করা হয়, সেসব দোকানে ক্রেতা ঠকলেন কী জিতলেন তা তার দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। এমন একাধিক দোকান দেখা গেছে, যেখান থেকে আট-দশটি পণ্য কেনার পর যোগফলে ইচ্ছাকৃতভাবে ৫০০ থেকে হাজার টাকা বাড়তি ধরে হিসাব করা হয়। যেসব ক্রেতা মূল্য পরিশোধের সময় হিসাব যাচাই করেন না, তাদের অযথা ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। হোটেল থেকে বিমানবন্দরে আসার সময় ট্যাক্সি ভাড়ার দায়িত্ব হোটেলবয়দের দিলে তারা ট্যাক্সির চালক থেকে নিজের জন্য ৫০-১০০ টাকা ধরে ভাড়া নির্ধারণ করেন। এ টাকা ট্যাক্সি ড্রাইভার তাদের আগাম পরিশোধ করে থাকেন। হোটেলে খেতেও ক্ষেত্রবিশেষে প্রকৃত বিলের চেয়ে ৫০-১০০ টাকা বেশি বিল করা হয়ে থাকে। যারা বিল পরিশোধের সময় যাচাই করে দেখেন না, তাদের অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়।

কলকাতার বিভিন্ন দোকানে কেনাকাটার সময় যারা সরকার নির্ধারিত মুদ্রাবিনিময় দোকান পরিহার করে দালালদের মাধ্যমে মুদ্রা ভাঙান, তারা অযথা ডলার প্রতি ১০ পয়সা থেকে এক রুপি কম পেয়ে থাকেন। আবার অনেকসময় দেখা যায়, ডলার আসল হওয়া সত্তে¡ও মলিন হওয়ায় ভাঙিয়ে দিতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়। ডলারটি একজন ক্রেতার শেষ সম্বল হয়ে থাকলে এটি মলিন এভাবে তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তিনি অন্যত্র ভাঙাতে পারবেন না এ কথা বলে ১০০ ডলারে ৫০০ থেকে হাজার রুপি কম দেয়ার ঘটনা বিরল নয়।

বেশকিছু বছর ধরে আমাদের দেশের একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে লক্ষ করা যায়, ছেলে বা মেয়ের বিয়ে ঠিক হওয়ার পর বর-কনের সাজসজ্জার যাবতীয় পোশাক-পরিচ্ছদ কিনতে পরিবারের এক বা একাধিক সদস্য ক্ষেত্রবিশেষে বর ও কনেসমেত কলকাতায় চলে যান। তারা সেখান থেকে যা কিছু কেনেন এর কিছুই বাংলাদেশ বা ঢাকায় দুর্লভ নয়। তবে এখান থেকে খরিদ করলে কিছু বাড়তি অর্থ লাগলেও যাওয়া-আসার বিমানভাড়া, কলকাতায় অবস্থানকালীন হোটেল ভাড়া, খাওয়া খরচ এবং ট্যাক্সি ভাড়াসহ কেনাকাটার বাড়তি সময় বিবেচনায় নিলে মূল্য সাশ্রয়ের মধ্যে আর কিছু যে অবশিষ্ট থাকে না, কথাটি যাদের বুঝে আসে না, তাদের অর্বাচীন না বলে আর কিছু কি বলা যায়।

সত্তর ও আশির দশকে আমাদের দেশ থেকে যারা কলকাতায় যেতেন; তারা আসার সময় বৈদ্যুতিক পাখা, রাইসকুকার, প্রেসারকুকার, প্লাস্টিকের বালতিসহ বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী নিয়ে আসতেন। এখন এসব সামগ্রী দেশেই উৎপন্ন হয়। মূল্য ও মানের দিক থেকেও আমাদের এসব জিনিস ভারতীয় পণ্যের চেয়ে উন্নত। তাই এখন আর ভারতে ভ্রমণে গিয়ে কলকাতা থেকে এসব সামগ্রী কিনে কেউ অযথা নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করেন না। এসব সামগ্রীর অনুরূপ পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রেও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আবশ্যক।

ভারত থেকে আমরা যেসব পোশাক-পরিচ্ছদ ক্রয় করি এর সবগুলো দেশে উৎপন্ন করা সম্ভব। আমরা নিজেদের দেশ থেকে এসব পণ্য ক্রয়ে আগ্রহী হলে আমাদের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ ও উৎপাদনে আগ্রহী হবেন। আমরা বৃহৎ ও বৈচিত্র্যময় দেশ হিসেবে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে অবশ্যই ভারত যাবো; কিন্তু এ উদ্দেশ্যের সাথে যদি কেনাকাটা সম্পৃক্ত করে ফেলি তাহলে পরিণামে যে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি, কথাটি বুঝতে পারলে বোধকরি নিজ দেশের প্রতি আনুগত্য প্রগাঢ় হবে।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক