মনিপুর ভারতের সেভেন-সিস্টার্সের অন্তর্ভুক্ত একটি স্থলবেষ্টিত রাজ্য। এর রাজধানী ইম্ফল। এ রাজ্যের উত্তরে নাগাল্যান্ড, দক্ষিণে মিজোরাম, পশ্চিমে আসাম ও পূর্বে মিয়ানমার। আয়তন ২২ হাজার ৩২৭ বর্গকিলোমিটার (আট হাজার ৬২১ বর্গমাইল)।
মেইতেইরা মনিপুরের সামগ্রিক জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ, নাগা ২৪ শতাংশ এবং নানা জো-জাতির (কুকিসহ বিভিন্ন ছোট ছোট জনগোষ্ঠী) মানুষ আছে ১৬ শতাংশ। প্রায় এক ডজন জো-জাতির মধ্যে কুকিরা আকারে বড়। মেইতেই উপজাতির মানুষ রাজ্যটির উপত্যকা অঞ্চলে বসবাস করে। মেইতেইরা পাঁচটি সামাজিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত। মেইতেই মারুপ (এরা মেইতেই সংস্কৃতি ও মেইতেই ধর্মে বিশ্বাস করে), মেইতেই খ্রিষ্টান, মেইতেই গৌরচৈতন্য মেইতেই ধর্ম ও হিন্দু ধর্ম উভয় বিশ্বাস করে, মেইতেই ব্রাহ্মণ (স্থানীয় নাম বামন) ও মনিপুরি মুসলমান (স্থানীয় নাম মিয়া মেইতেই বা পাঙ্গান)। মেইতেই বা মনিপুরি ভাষা তাদের মাতৃভাষা এবং এ রাজ্যের প্রধান সংযোগ রক্ষাকারী ভাষা।
মনিপুরের অর্ধেক মানুষ থাকে সমতলে, বাকিরা পাহাড়ি এলাকায়। ধর্মের দিক থেকে ৪০ শতাংশ হিন্দু-বৈষ্ণব, খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠী ৫০ শতাংশ এবং মুসলমান রয়েছে ১০ শতাংশ। হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সমতলে থাকে। সমতল মানে মূলত রাজধানী ইম্ফল ও এর আশপাশের অংশ। হিন্দু ছাড়া অন্যরা দূর পাহাড়ে থাকে। মেইতেই ছাড়াও আরো প্রায় ১০টি ভাষার প্রচলন আছে রাজ্যজুড়ে।
মনিপুর কাংলেইপাক রাজ্য নামে পরিচিত ছিল। এখানে রাজতন্ত্র কার্যকর ছিল। পীতাম্বর চারাইরঙবা এ রাজত্বের প্রথম রাজা।
১৮২৪ সালে বার্মার আসাম আক্রমণ থেকে নিষ্কৃতি পেতে মনিপুর রাজ গম্ভীর সিং ব্রিটিশ সাহায্য চাইলে তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম আমহার্স্টের নেতৃত্বে প্রথম অ্যাংলো-বার্মা যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধ-পরবর্তী মনিপুর ভারতের একটি দেশীয় রাজ্য হিসেবে অঙ্গীভূত হয়।
১৮৯১ সালে রাজা কুলচন্দ্র সিংয়ের সময়কালে ব্রিটিশদের সাথে বিরোধ বাধলে এক বছরের মধ্যে তিনি অপসারিত হন। কুলচন্দ্র সিংয়ের অপসারণপরবর্তী তার নাবালক ছেলে চুরাচন্দ্র সিং ক্ষমতায় আসেন। বোধচন্দ্র সিং এ রাজত্বের শেষ রাজা।
১৯৪৭ সালে মনিপুর স্বাধীন রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশের ইচ্ছা ব্যক্ত করে। পার্শ্ববর্তী বার্মার আগ্রাসী মনোভাবে ১৯৪৯ সালে রাজা বোধচন্দ্র সিং ভারত অন্তর্ভুক্তির সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করেন। ১৯৫৬ সালে এটি কেন্দ্রশাসিত রাজ্য হয় এবং ১৯৭২ সালে এটি পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে রাজ্যটির জনসংখ্যা ২৮ লাখ ৫৫ হাজার ৭৯৪ জন।
মনিপুরে তিন-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বাস, যথা- বিষ্ণুপ্রিয়া, মেইতেই ও পাঙ্গান। গন্ধর্বদের রাজত্বকালে মহাভারত খ্যাত পঞ্চপাণ্ডবদের তৃতীয় ভ্রাতা অর্জুন মনিপুর রাজ্যে পরিভ্রমণে গিয়ে গন্ধর্ব রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করেন। অর্জুনের সাথে ক্ষত্রীয় যোদ্ধা যারা মনিপুরে গিয়েছিল তাদের অনেকে গন্ধর্ব কন্যাদের বিয়ে করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদার একমাত্র ঔরসজাত সন্তান বভ্রুবাহন মনিপুরের সিংহাসনে অধিপতি হন। মনিপুরে গন্ধর্বদের পরে আর্য-ক্ষত্রীয়দের শাসন শুরু হয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞ করলে রাজা বভ্রুবাহন সেই যজ্ঞে যোগদান করতে মিথিলার রাজধানী হস্তিনেয় গমন করেন। যজ্ঞ শেষে মনিপুরে ফেরার সময় বভ্রুবাহন হস্তিনার বিষ্ণুপ্রিয়া মন্দিরের অনন্তশায়ী সুবর্ণ ও বিশাল বিষ্ণুমূর্তি সাথে নিয়ে আসেন। বিষ্ণু বিগ্রহ স্থাপনের পর থেকে মনিপুরের রাজধানী বিষ্ণুপুর নামে পরিচিতি পেতে থাকে। অর্জুনের বংশধর ক্ষত্রীয় বংশী এবং বিষ্ণুর উপাসক বলে তাদের বিষ্ণুপ্রিয়া বলা হয়।
মঙ্গোলীয় তিব্বতি বর্মি পরিবারের কুকিচিন গোত্রভুক্ত মেইতেইরা দশম-ত্রয়োদশ শতাব্দীর কোনো এক সময় চীন থেকে মনিপুরে প্রবেশ করেন। পৈরিতন নামে এক দলপতির নেতৃত্বে তারা মনিপুরের উত্তরে অবস্থিত কব্রু পর্বতে উপনিবেশ স্থাপন করে। মেইতেই মনিপুরিরা বিষ্ণুর উপাসক বিষ্ণুপ্রিয়া ও মেইতেই সনাতন বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত বলে এরা পেঁয়াজ, রসুন ও মাংস খায় না।
কথিত আছে, মনিপুর রাজ্যের ভারতবর্ষের কোনো এক অঞ্চলের পাঠান মুসলিম ব্যবসায়-বাণিজ্য করতে মনিপুর আসেন। তিনি এক মেইতেই মনিপুরি নারীর সাথে প্রেমে আবদ্ধ হন। সেই সাথে তাকে বিয়ে করে সন্তানাদিসহ সেখানে বসবাস করতে থাকেন। মা মেইতেই ও বাবা পাঠান মুসলিম বংশোদ্ভূত সম্প্রদায়কে পাঙ্গান জাতি বলে। তাদের মনিপুরি মুসলিমও বলা হয়। তারা মায়ের ভাষায় কথা বলে এবং পিতার ইসলাম ধর্ম পালন করে। তারা পেঁয়াজ, রসুন ও মাংসভোজী। তাদের মেয়েরাও বিষ্ণুপ্রিয়া ও মেইতেই মেয়েদের মতো নিজস্ব উৎপাদিত পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে।
সনাতনধর্মী মনিপুরিরা সাধারণত সাংস্কৃতিক জাতি হিসেবে উদারপন্থী। তারা নারী-পুরুষদের মধ্যে মানববন্ধনে যুবক-যুবতী একসাথে খেলাধুলা, গানবাজনা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে চলাফেরা এবং মেলামেশায় অভ্যস্ত। তাদের ছেলেমেয়ে নারী-পুরুষ সবাই নৃত্যগীতে অংশগ্রহণ করে। পাঙ্গান বংশের ছেলেমেয়ে ইসলামী শরিয়ত অনুসরণের চেষ্টা করে।
কিছুকাল আগেও মনিপুরে সব জাতিসত্তার একক দাবি ছিল স্বায়ত্তশাসন। স্থানীয় কোনো কোনো সংগঠন আরো বেশি কিছু চাইত। কিন্তু খ্রিষ্টান মিশনারি ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএসের তৎপরতা পাল্লা দিয়ে যত বেড়েছে তত মনিপুরের রাজনীতিতে ধর্মবিশ্বাসের অঙ্ক তীব্রতর হয়েছে। দাঙ্গার শুরু থেকে চার্চগুলো সচেতনভাবে আগুনের নিশানা হয়েছে।
মনিপুরের উত্তরে নাগাল্যান্ড, সেখানে খ্রিষ্টানদের সংখ্যা ৮৯ শতাংশ। দক্ষিণে মিজোরাম, সেখানে ৮৭ শতাংশ মানুষ খ্রিষ্টান। পশ্চিমে আসাম, সেখানে হিন্দু ৬২ শতাংশ। মিয়ানমারের চীন প্রদেশ ও স্যাগাইন বিভাগের সাথেও মনিপুরের সীমান্ত রয়েছে। চীনের ৮৫ শতাংশ অধিবাসী খ্রিষ্টান। এটি স্পষ্টত প্রতিভাত যে, মনিপুরকে ঘিরে খ্রিষ্টান একটি বলয় আছে। আসামের কারণে সে বলয় খানিক অসমাপ্ত। বিজিপির রাজনীতিতে আসামের বাড়তি গুরুত্ব এখানেই। একই কথা বলা যায় ত্রিপুরা নিয়ে।
মনিপুরের কুকিরা এখানকার প্রায় ২২ হাজার বর্গকিলোমিটার (৬০ শতাংশ এলাকা) নিয়ে যে আলাদা রাজ্য দাবি করছে সেটি যে আরেকটি খ্রিষ্টান অধ্যুষিত রাজ্য হবে এটি আরএসএসের জন্য অসহনীয়। মিজোরাম নাগাল্যান্ডের বাইরে মেঘালয় এবং অরুনাচলেও ইতোমধ্যে খ্রিষ্টানরা সংখ্যায় প্রথম স্থানে চলে এসেছে। ফলে মনিপুর ভেঙে একটি কুকিপ্রধান রাজ্য গড়া, যা এ মুহূর্তে দাঙ্গার ভেতরকার বড় দাবি। এর বৃহত্তর অর্থ দাঁড়ায়- আসাম ও ত্রিপুরা বাদে দক্ষিণ এশিয়ার বিশাল একটি অঞ্চলে খ্রিষ্টান প্রাধান্য তৈরি হওয়া।
বাস্তবে সীমান্তের ঊর্ধ্বে উঠে জোদের পরস্পরকে আশ্রয় দেয়ার ভ্রাতৃত্ববোধে এক দিকে আছে খ্রিষ্টান চেতনা অন্য দিকে আছে জাতিগত মমত্ববোধ। ঔপনিবেশিক শক্তির তৈরি সীমান্তে এ মমত্ববোধ সঙ্গত কারণে এখন অবৈধ। কিন্তু আন্তঃদেশীয় জালেন-গাম চৈতন্যকে সেই অবৈধতার শেকলে আটকানো দুরূহ।
উত্তর-পূর্ব ভারতীয় খ্রিষ্টান বলয়ে এ মুহূর্তে নাগা ও কুকিরা প্রধান জাতিগোষ্ঠী। প্রায় ৪৫টি জাতিসত্তার নাগারা বহুকাল নাগাল্যান্ড ঘিরে তাদের পুরনো নাগালিম গড়ার কথা ভাবে। তেমনি কুকিদের ১০-১২টি উপশাখা মিলে স্বপ্ন দেখে জালেন-গামের।
উপমহাদেশের মানুষ নাগালিমের কথা যতটা শুনেছে জালেন-গাম ততটা কম প্রচারিত। ভাষাগতভাবে জালেন-গাম অর্থ- মুক্তির ঠিকানা। শিক্ষিত কুকিরা যাকে বলে হোম অব ফ্রিডম। এবারের মনিপুর দাঙ্গায় ইতিহাসের সেই স্বাধীনতার রাজ্য পুরাণ থেকে আড়মোড়া ভেঙে রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের দরবারে হাজির হয়েছে আবার।
১৯৬০ সাল থেকে কুকিরা একটি পৃথক রাজ্য দাবি করে আসছে। ২০১০ সাল থেকে তারা এ দাবিতে নতুন করে সোচ্চার। পৃথক রাজ্য না হলে অন্তত মনিপুরের পাহাড়ি এলাকাগুলো তারা মিজোরামের সাথে যুক্ত করতে চায়। মেইতেইদের সাথে বহু আগে থেকে তাদের বনিবনা হচ্ছে না। একই সমস্যা হচ্ছে কুকিদের বাকি ছয় সীমান্তের ভেতরেও। চলমান এসব অবহেলা অতিক্রম করে স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বাঁচার চেষ্টাও আছে। এবারের দাঙ্গার ফাঁকে মেইতেইরা আসামের মতো নাগরিক গণনা চাইছে মনিপুরে। মনিপুরে এরকম কর্মসূচিতে জো-জাতির মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। আসামে এনআরসি নিয়ে মুসলমানরা উদ্বিগ্ন ছিল। মনিপুরে সে উদ্বেগ আছে খ্রিষ্টানদের মধ্যে, যে খ্রিষ্টানরা কুকি কিংবা মিজো বা চীন।
কোনো কুকি উপ শাখার এটি অজানা নেই, নতুন একটি পৃথক রাজ্য বা পৃথক দেশ তাদের শান্তি বা স্বস্তি এনে দেবে না। আজকে মনিপুর ভেঙে একটি পৃথক রাজ্য হলেও সেখানে নাগাদের সাথে তাদের বিরোধ বাধবে। কারণ, উভয়ে একই পাহাড়ে কাছাকাছি থাকে বহু যুগ ধরে। ১৯৯২-৯৬ পর্যন্ত নাগাদের সাথে কুকিদের বহু সংঘর্ষ হয়েছে।
নাগারা স্পষ্ট বলছে, মনিপুরের পাহাড়ি এলাকাগুলো তাদের পূর্বপুরুষদের জায়গা। কুকিরা যেখানে যাযাবর হিসেবে এসেছিল মাত্র। মনিপুরজুড়ে নাগা-কুকি সংঘর্ষের সময় মেইতেইরা কুকিদের পাশে দাঁড়ায়নি। আজ যেভাবে নাগারা মেইতেইদের পাশে নেই।
এ রকম অভিজ্ঞতার আলোকে এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, মেইতেই আর কুকিদের যে বিবাদ এখন সবাইকে ভাবাচ্ছে, নতুন কোনো রাজ্য হলে সেখানে কুকিদের সাথে নাগাদের একই ধাঁচের সঙ্ঘাত হবে।
মনিপুরে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়। এর আগে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পদত্যাগ করেন। এবারের রাষ্ট্রপতি শাসন যেমন দেশটির সংবিধানের ৩৫৬ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করে জারি করা হয়েছে; এর আগেও অনুরূপভাবে রাজ্যটিতে ১০ বার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়েছিল।
বীরেন সিং মেইতেই জাতিগোষ্ঠীর লোক ছিলেন। বীরেন সিংয়ের পদত্যাগ-পরবর্তী রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করাকে স্বাগত জানিয়েছে কুকিসহ অন্যান্য আদিবাসী সংগঠন। কুকিসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই নেতৃত্বাধীন রাজ্যে তাদের পক্ষে বাস করা সম্ভব নয়- এমন ধারণা ব্যক্ত করে আসছে। এখন দেখার বিষয়- ভারতের ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় সরকার মনিপুর রাজ্যের সমস্যা সমাধানে কতটুকু আন্তরিক ও কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক