কাবুলে আশ্রয় নেয়ার পথ বন্ধ হওয়ার উপায়

আমাদের আজ পর্যন্ত এটি বুঝে আসেনি যে, গুলি দ্বারা বিদ্বেষ ও প্রতিশোধস্পৃহা জন্ম নেয়। বিদ্বেষ ও প্রতিশোধস্পৃহা আপনাদের যুবকদের কাবুলের পথ দেখায়, যেখানে তাদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতকে ব্যবহার করার সুযোগ মেলে।

পেশোয়ারে হায়াতাবাদ নামে একটি বড় এলাকা রয়েছে। হায়াতাবাদ আমাদের হায়াত খান শেরপাওয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, যিনি খাইবারপাখতুনখাওয়া প্রদেশের গভর্নর ছিলেন। এ ছাড়া নওশেরায় হায়াত শেরপাও রেলওয়ে স্টেশন, লাহোরে শেরপাও সেতুসহ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হায়াত শেরপাওয়ের নামে প্রতিষ্ঠিত আছে। ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৫ পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বোমা হামলায় তাকে শহীদ করা হয়।

খাইবারপাখতুনখাওয়ার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এবং কওমি ওয়াতন পার্টির নেতা আহমদ খান শেরপাও তার বড় ভাই হায়াত খান শেরপাওয়ের শাহাদতের পর রাজনীতিতে আসেন। হায়াত খান শেরপাওয়ের শাহাদতের ঘটনার পর অর্ধশতাব্দী পার হয়ে গেছে। এখন কারো মনে নেই, তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল কাবুলে। শেরপাওয়ের হত্যার পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এ হত্যা ষড়যন্ত্রের দায় চাপানো হয় তখনকার বিরোধী নেতা খান আবদুল ওলি খানের ছেলে ইস্কান্দার ইয়ার ওলির ওপর। অথচ বিষয়টির সাথে তার দূরতম সম্পর্ক ছিল না। এ অভিযানে চারসাদ্দার দুই যুবক আনওয়ার ও আমজাদ জড়িত ছিল। তারা পাখতুন জালমে নামে একটি সংগঠনের সদস্য ছিল, যা ন্যাপের নেতা আজমল খাটক কাবুল থেকে পরিচালনা করতেন।

আজমল খাটক ১৯৭৩ সালের ২৩ মার্চ রাওয়ালপিন্ডির লিয়াকতবাগে ন্যাপের সমাবেশে ফেডারেল সিকিউরিটি ফোর্সের (এফএসএফ) গুলিবর্ষণের পর তার অনেক সঙ্গীর সাথে আফগানিস্তান চলে যান, সরদার দাউদ যেখানে জহির শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করেন। লিয়াকতবাগে বিরোধী দলকে সমাবেশ করতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করা হয়; কিন্তু বিরোধী দল সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সমাবেশের আয়োজন করে, যা প্রতিহত করতে সরকার নির্বিচারে শক্তি প্রয়োগ করে। এতে ন্যাপের বহু সদস্য মারা যান। নিহতরা খাইবারপাখতুনখাওয়ার অধিবাসী ছিলেন। ওই ঘটনা পাকিস্তানের রাজনীতিতে যে বিদ্বেষ ও প্রতিশোধস্পৃহা জন্ম দেয়, তার ফল পাখতুন জালমে রূপে প্রকাশ পায়, যার সদস্যদের কাবুলে সন্ত্রাসের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। হায়াত খান শেরপাওয়ের দুই হত্যাকারীও তাদের অভিযান সম্পন্ন করে কাবুলে ফিরে গিয়েছিল। কাবুলে শুধু পাখতুন ও বেলুচ নেতাদের নয়; বরং সিন্ধুদেশের সমর্থকদেরও আশ্রয় দেয়া হয়েছিল, যারা কাবুলে ভারতের দূতাবাস থেকে অর্থ পেতেন।

হায়াত খান শেরপাওয়ের হত্যা এক দিকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ঘৃণা ও প্রতিশোধের প্রবণতার কারণ নিয়ে ভাবতে আহ্বান জানায়, আবার অপর দিকে এ কথাও বলে, আফগানিস্তান ও ভারত আজ নয়; বরং বহু দিন থেকে পাকিস্তানে সন্ত্রাস চালিয়ে আসছে। সাধারণভাবে এ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য ওই সব পাকিস্তানিকে ব্যবহার করা হয়, যারা রাষ্ট্রের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকে।

নির্মম পরিহাস দেখুন, লিয়াকতবাগে রাষ্ট্র যখন নিজের নাগরিকদের ওপর গুলিবর্ষণ করে এবং হায়াত খান শেরপাও নিহত হন, তখন জুলফিকার আলি ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। কয়েক বছর পর জেনারেল জিয়াউল হক ভুট্টোকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। একই সাথে পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে ফাঁসিতে ঝোলান। ওই ফাঁসি যে বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার জন্ম দেয়, তা মীর মুরতাজা ভুট্টোকে কাবুল পৌঁছিয়ে দেয়। মীর মুরতাজা যখন ১৯৮১ সালে পিআইএর একটি বিমান ছিনতাইয়ের দায় স্বীকার করেন, তখন আজমল খাটক ও মীর মুরতাজা ভুট্টো উভয় কাবুলে উপস্থিত ছিলেন। অনেকদিন আগে আমি দৈনিক জংয়ের জন্য আজমল খাটকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তিনি এ সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, খোদ মার্শাল ল সরকার পিআইএর বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়েছে, যাতে ছিনতাইয়ের দায় মীর মুরতাজা ভুট্টোর ওপর চাপিয়ে পিপলস পার্টির বিরুদ্ধে দমনাভিযান চালানো যায়, যে পার্টি অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে মিলে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালাতে চেয়েছিল। ওই বিমান ছিনতাইয়ের মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন সালামুল্লাহ টিপু। যিনি পরবর্তী সময়ে জেনারেল জিয়াউল হককে ১৯৮৩ সালে ভারত সফরকালীন দিল্লিতে হজরত নিজামুদ্দিন আওলিয়ার মাজারে উপস্থিত হওয়ার সময় হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে টিপুকে হ্যান্ড গ্রেনেড ও কালাশনিকভ সরবরাহ করার দায়িত্ব ছিল তার সহযোগী পারভেজ শিনওয়ারির। পারভেজ শিনওয়ারি এ কাজ করতে পারেননি। টিপু কাবুল প্রত্যাবর্তন করেন এবং শিনওয়ারিকে হত্যা করেন। শিনওয়ারির হত্যার অভিযোগে আফগান প্রেসিডেন্ট ড. নজিবুল্লাহর নির্দেশে সালামুল্লাহ টিপুকে কাবুলে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ দাবিও করা হয়, মীর মুরতাজা ভুট্টোর সন্দেহ ছিল, টিপু পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য কাজ করত, এ জন্য তিনি দিল্লিত জেনারেল জিয়াকে হত্যা করেননি। তাই মুরতাজার অনুরোধে টিপুকে গুলি করে মারা হয়। মোটকথা, পিআইএর বিমান ছিনতাইকারী টিপুকে পাকিস্তান সরকার শাস্তি দিতে পারেনি। অবশেষে আফগান সরকার নিজে কাবুলে তাকে গুলি করে হত্যা করে।

অন্য কোনো দেশের সাথে মিলে নিজের দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত বেশির ভাগ যুবকের পরিণাম সালামুল্লাহ টিপুর মতো হয়ে থাকে। আমাদের এটি অবশ্যই ভাবা উচিত, সালামুল্লাহ টিপু করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাবুল কিভাবে পৌঁছলেন? যদি জুলফিকার আলি ভুট্টোকে ফাঁসিতে না ঝোলানো হতো, তাহলে তার ছেলে মীর মুরতাজা ভুট্টো সেই কাজ করতেন না, যা আজমল খাটক কাবুলে বসে আগে থেকে করছিলেন। যদি ভুট্টো সরকার রাওয়ালপিন্ডির লিয়াকতবাগে বিরোধী দলের সমাবেশে গুলিবর্ষণ না করত, তাহলে আজমল খাটক কাবুলে গিয়ে পাখতুন জালমে গঠন করতেন না। আফসোস হচ্ছে, আমরা আমাদের অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি না।

আমরা পাকিস্তানের রাজনীতি থেকে গালি ও গুলি দূর করার কোনো সচেতন চেষ্টা করিনি। মনে রাখা দরকার, রাজনীতিতে গালি প্রদানকারী নিজেও একটি গালিতে পরিণত হয়। রাজনীতিতে গুলি ব্যবহারকারী নিজেও গুলির নিশানা হয়ে যায়। লিয়াকতবাগে গুলি চালানো হয়, বেলুচিস্তানে সেনা অভিযান চালানো হয়। তার ফল আফগানিস্তানের পথ হয়ে পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদরূপে দেখা দেয় ভারত আফগানিস্তানের পথ দিয়ে পাকিস্তানে বোমা হামলা করায় এবং হায়াত খান শেরপাওকে হত্যা করায়। ওই হত্যাকাণ্ডের পর একটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তবে সেই দল এখনো এএনপি (আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি) রূপে বিদ্যমান। জুলফিকার আলি ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। ওই ফাঁসির প্রতিশোধ নিতে ভুট্টোর ছেলে কাবুল চলে যান। অবশেষে নিজের বোনের শাসনামলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন।

যে-ই গুলি চালান, তিনি হয়তো বিপ্লবের ¯েøাগান দেন, নয়তো রাষ্ট্র রক্ষার দাবি করেন। ইতিহাস বলে, গুলি দ্বারা রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে না। গত বছর (২০১৪ সালে) নভেম্বরে ইসলামাবাদে গুলি চালানো হয়েছিল। রাষ্ট্র বলেছিল, আমরা আমাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছি। এখন মুরিদকেতে তেহরিকে লাব্বাইকের কর্মীদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। রাষ্ট্রের কাছে গুলি চালানোর সেই একই কারণ রয়েছে, যা ১৯৭৩ সালে লিয়াকতবাগে গুলি চালানোর সময় বলা হয়েছিল। ১৯৭৩ থেকে ২০২৫ সাল চলে এসেছে।

আমাদের আজ পর্যন্ত এটি বুঝে আসেনি যে, গুলি দ্বারা বিদ্বেষ ও প্রতিশোধস্পৃহা জন্ম নেয়। বিদ্বেষ ও প্রতিশোধস্পৃহা আপনাদের যুবকদের কাবুলের পথ দেখায়, যেখানে তাদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতকে ব্যবহার করার সুযোগ মেলে। এখন একজন যুবক খাইবারপাখতুনখাওয়ার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। ওই মুখ্যমন্ত্রীর বাচনভঙ্গি নিয়ে মতভেদ করা যেতে পারে, তবে তাকে কাবুলের প্রক্সি অভিহিত করা বহু যুবককে কাবুলের দিকে ঠেলে দেয়ার নামান্তর। আপনারা যদি নিজেদের লোকদের সাথে গালি ও গুলির ভাষায় কথা বলা বন্ধ করেন, তাহলে তারা কাবুলে কেন যাবে? কাবুলের পথ বন্ধ করতে হলে আপনাদের নিজেদের লোকদের সাথে সমঝোতার পথ অবলম্বন করতে হবে।

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ১৬ অক্টোবর,

২০২৫-এর উর্দু থেকে ভাষান্তর

ইমতিয়াজ বিন মাহতাব

হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট