দুটি ঘটনার উল্লেখ করে আজকের প্রসঙ্গ শুরু করতে চাই। প্রথমটা সম্ভবত ১৯৫৪ সালের কথা। ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচন মেম্বর পদে। বর্তমানে ইউনিয়ন কাউন্সিল তখন ইউনিয়ন বোর্ড হিসেবে পরিচিত ছিল। আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তার এক ডিক্রি বলে ইউনিয়ন বোর্ডের নাম পরিবর্তিত হয়ে ইউনিয়ন কাউন্সিল হয়। ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচনে আমার ছোট ফুপা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মেম্বর নির্বাচিত হয়েছিলেন। মেম্বর পদটি পরবর্তী সময়ে কাউন্সিলর নামে পরিবর্তিত হয়। তখন মার্কা সংবলিত কোনো ছাপানো ব্যালট পেপার ছিল না। প্রিজাইডিং অফিসার নির্দিষ্ট মাপের একটি সাদা কাগজ সই ও সিল করে দিতেন। এটি পছন্দের প্রার্থীর বাক্সে ফেলতে হতো। ভোট শেষে প্রতিটি বাক্স খুলে ব্যালট গুনে যার বাক্সে সবচেয়ে বেশি ব্যালট পড়ত তিনি নির্বাচিত হিসেবে ঘোষিত হতেন।
প্রত্যেক প্রার্থী তার জন্য নির্দিষ্ট মার্কা-সংবলিত কাঠের বাক্স তৈরি করে ভোটের দিন কেন্দ্রে নিয়ে আসতেন। বাক্সগুলোকে একটি পৃথক কক্ষে সাজিয়ে রাখা হতো। ভোটাররা তাদের পছন্দমাফিক মার্কার বাক্সে প্রিজাইডিং অফিসারের স্বাক্ষর ও সিলযুক্ত ব্যালট ফেলে আসতেন। আমার ফুপার ভোটের দিন সকাল ৯টা। ভোট শুরু। ঘটনাটি ঘটল কিছুক্ষণ পর। দেখা গেল যে কক্ষে বাক্সগুলো রাখা ছিল সেখান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সাথে কাগজ পোড়া গন্ধ। প্রিজাইডিং অফিসার তার সহকর্মী দল এবং প্রার্থীদের নিয়ে সেই কক্ষে ছুটে গেলেন। ভেতরে গিয়ে বিস্ময়ে সবার চোখ ছানাবড়া। একজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন হারিকেন মার্কা নিয়ে। ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তিনি তার বাক্সের ওপর একটি হারিকেন জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। ভোটাররা ব্যালট পেপার বাক্সে না ফেলে হারিকেনের ভেতর ফেলে দেয়। যার ফলে ব্যালট পুড়ে ধোঁয়ার সৃষ্টি।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে নিয়ে। তার নির্বাচনী এলাকা আমেথির নির্বাচনী কর্মকর্তা তার মনঃপূত ছিল না। তাকে সরিয়ে দেয়ার জন্য তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অনুরোধ করেন। তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হলে তিনি ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিংয়ের কাছে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ব্যাপারে অভিযোগ তোলেন। রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিং রাজীব গান্ধীকে বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সত্তা। তার কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করার কোনো এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির নেই। রাজীব গান্ধীকে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত মাথা পেতে মেনে নিতে হয়েছিল অনিচ্ছা ও বিরক্তিসহ।
পর্যায়ক্রমে আরেকটি বিষয়ের কথাও উল্লেখ না করে পারছি না। আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও ঢাকার সব প্রার্থীর জন্য সমন্বিত প্রজেকশন মিটিংয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন ভোটারদের নিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায়। অবশ্যি ভোটার সংখ্যা ছিল সীমিত। শুধু ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্যরাই ছিলেন ভোটার। এর উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন, একই সময় একই স্টেজে সব ভোটারের সামনে প্রার্থীদের নিজস্ব নির্বাচনী ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করায় একদিকে যেন প্রার্থীদের পৃথক পৃথক সমাবেশ করার ভোগান্তি কমছিল, অপর দিকে তাদের নির্বাচনী ব্যয়ের সাশ্রয়ও হয়েছিল। বর্তমানে একেকটি নির্বাচনে জাতীয় সংসদ প্রার্থীদের কোটি কোটি টাকা খরচ হয়, যদিও নির্বাচন কমিশন কর্তৃক একটি অর্থসীমা নির্ধারণ করা আছে। এই পরিমাণ অর্থে একজনের পক্ষে কাউন্সিলর নির্বাচন করাই কঠিন। অথচ নির্বাচনের পর কমিশনে প্রতিটি প্রার্থী নির্বাচনী ব্যয়ের যে হিসাব দাখিল করেন এবং কমিশন তা গ্রহণ করেন তা দেখে বিশ্বাসের ভিত নড়ে যেতে বাধ্য। তাদের হিসাব নির্বাচন কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত খরচের মধ্যেই দেখানো হয়ে থাকে। যদিও দৃশ্যমান খরচ অনেক বেশি।
প্রথম ঘটনাটির মূলে যে কারণটি কাজ করেছে তা ছিল ভোটারদের অসচেতনতা। এ ব্যাপারে আরো একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না মনে হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, তিনি যদি কলাগাছ দাঁড় করিয়ে দেন, তাকে ভোট দিলে তিনি তা পেয়ে যাবেন। ফলাফল হয়েছিল তাই। কলাগাছ মার্কা কিছু ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে সে সময় সংসদে এসেছিলেন। এটি ভোটার অসচেতনতার একটি উদাহরণ। এবারের নির্বাচনী প্রস্তুতিতে ভোটার সচেতনতার ব্যাপারটি প্রায়ই অনুপস্থিত। রাজনৈতিক দলগুলোও এ ব্যাপারে খুব একটা গা করছেন না। তারা ভোটারদের সচেতন করার ব্যাপারটি নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচনপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলো খুব একটা ভাবছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। অথচ ভোটার সচেতনতা সুষ্ঠু নির্বাচনের একটি অন্যতম প্রধান শর্ত। এরাই নির্বাচনের মূল অংশীজন। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। নতুবা কলাগাছ মার্কা প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচনী ব্যয় সীমিতকরণ। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কাজ করার প্রচুর সুযোগ রয়েছে। পোস্টার নিষিদ্ধ করার জন্য কমিশনকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাই। নির্বাচনী ব্যয় সীমিত রাখার রোডম্যাপ তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এ ব্যাপারে যথাযথ দৃষ্টি রাখা এবং অনুসৃত ব্যয়ের জন্য প্রার্থীদের শক্ত আইনি কাঠামোয় আনা অপরিহার্য।
নির্বাচন কমিশন স্বাধীন প্রভাবমুক্ত কার্যক্রম পরিচালনা করার ব্যাপারে তার স্বাধীনতা, কর্তৃত্ব, সিদ্ধান্ত গ্রহণের দৃঢ়তার ক্ষেত্রে রাজীব গান্ধীর উদাহরণই যথেষ্ট শিক্ষণীয়। নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বা দলীয় প্রভাবের বাইরে নিরপেক্ষ থাকার জন্য নির্বাচন কমিশনকে প্রভাবমুক্ত ক্ষমতায়ন সময়ের দাবি। নির্বাচন কমিশন একটি স্বতন্ত্র জাতীয় সত্তা। এর অবমূল্যায়ন প্রতিহত করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামোর সংস্কার এখনই করা প্রয়োজন। অন্যথায় নির্বাচনী ফলাফল বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
[email protected]